বাংলাদেশের সাহিত্য কাগজের রূপবদল-পালাবদলের ধারাবাহিকতার পরিক্রমায় সৃজন বিশুদ্ধ পাঠকের কাছে অনন্য কাগজ বলে বিবেচিত। এক সময়ের উজ্জ্বল সাহিত্য কাগজ শৈলী পূর্বের উত্তরাধিকার বর্তমানের অন্যদিন, অনন্যা, কালি ও কলম, শব্দঘর এবং ভারতের দেশ এর অবয়বয়ে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের বিশেষত্বের সাহিত্য কাগজ-সৃজন। এই সারিতে সৃজন তার আলাদা শিল্পস্বর পাঠকের মননে স্থান করে নিয়েছে। একই সঙ্গে বলা যায় এই কাগজের সূচনাসংখ্যা থেকে আজ অবব্দি শুদ্ধ এবং মননশীলতায় সাহিত্যর্চ্চার প্রতীক হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে চায়। চোখে পড়ে কাগজের মূল কনসেপ্টকে ধারণ করে মানবিক মূল্যবোধের পক্ষে বলিষ্ঠ উচ্চারণ ঘোষিত হয়েছে মাত্রানির্ভর সম্পাদকীয়তে। প্রত্যেক সংখ্যার মতো বর্তমান অক্টোবর-২০১৭, বর্ষ ১, সংখ্যা ৩, শিল্প সাহিত্য ও সমাজ রাজনীতির পত্রিকা সৃজনের মোড়কি বিশেষত্ব- উপন্যাস-উদ্ভব ও প্রকৃতি নামক বিষয়টি। বাংলাসাহিত্যর্চ্চার মূলধারার সঙ্গে সৃজন নামক কাগজটি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বিশেষ করে আলোচনা, গদ্যরচনা এবং গুচ্ছকবিতা পর্বটি। নান্দকিতার চরম উৎকর্ষ সাধনে এই কাগজটির শিল্প সম্পাদক দেওয়ান আতিকুর রহমান, অলংকরণ করেছেন- শতাব্দী জাহিদ। সৃজন-শিল্প, সাহিত্য ও সমাজ রাজনীতির পত্রিকার সম্পাদনা পরিষদে মোট নয়জন রয়েছেন-যথাক্রমে-সাজ্জাদ আলম খান, সাইফুর রহমান, ব্যারিস্টার মীর হেলাল, ব্যরিস্টার আব্দুল্লাহ মাহমুদ হাসান, আদিত্য নজরুল, তৌফিক জোয়ার্দার, খাজা মাসুদ, আব্দুল্লাহ ওমর সাইফ এবং জুননু রাইন। এই সংখ্যায় বেশকিছু চমকপ্রদ বিষয় পাঠককে তৃপ্তিদান করে- যেমন, উপন্যাসের উদ্ভব ও প্রকৃতি, উপন্যাস: পরকীয়া রোমান্স, বিশ্বসাহিত্যের গতিবিধি, সমুদ্র অর্থনীতি এবং সমকালীন গল্পসহ-কবিতা-কবিতাগুচ্ছ।
সারে চার ফর্মার ফোরকালারের মলাটে ভেতর অত্যন্ত মূল্যবান প্রবন্ধ লিখেছেন-সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী উপন্যাসের উদ্ভব ও প্রকৃতি নিয়ে। এই রচনাটি পাঠককে ঋদ্ধ করবে আর উপন্যাসের উদ্ভব থেকে তার গতি-প্রকৃতি বদলের ধারা তথা রূপের পরিধি সম্পর্কে জানার আগ্রহ বাড়িয়ে দেবে। দ্বিতীয় প্রবন্ধ- উপন্যাসে পরকীয়া ও রোমান্স প্রসঙ্গ- বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎ, মানিক, বুদ্ধদেব, তারাশংকর এবং জীবনানন্দের রোমাঞ্চকর পরকীয়া রোমান্স উপন্যাসের বিষয় উঠে এসেছে।এই প্রবন্ধটি পাঠকের স্মৃতিকে আরও স্মৃতিতাড়িত করবে। পাশাপাশি বিশেষ ব্যক্তিত্ব সরদার ফজলুল করিমের অপ্রকাশিত একটি অপ্রকাশিত মূল্যবান সাক্ষাতকার প্রকাশ করেছে সৃজন। অত্যন্ত তৃপ্তিদায়ক দুটো গল্প: সুরাইয়া বেগমের ছারপোকা এবং রাজীব সরকারের শ্বশুরবাড়ি মধুরহাঁড়ি নামক গল্প প্রকাশিত হয়েছে। মঈনুল সুলতানের- সৈকতের নাম প্লায়া লাস পেনিটাস খুব ভাল লেগেছে। আক্কেল হায়দারের বিশ্বসাহিত্যের গতিবিধি শীর্ষক রচনাটি ক্ষীণতনু হওয়ায় পাঠক চরম অতৃপ্তিতে ভোগে-যা এই কাগজের কাছে পাঠক প্রত্যাশা করে না। এই সংখ্যায় সময়ের দাবি- মোহাম্মদ আলীর নেয়া সরদার ফজলুল করিমের একটি দীর্ঘ অপ্রকাশিত সাক্ষাতকার ছাপা হয়েছে। এর ভেতর তার বর্ণাঢ্য জীবনের টানাপোড়েন, সাম্প্রদায়িক সম্পীতি, মানুষ এবং দেশের নানা প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। এছাড়া সমুদ্র অর্থনীতিবিষয়ক মজাদার রচনা লিখেছেন- গোলাম শফিক। শফিকের সমুদ্র অর্থনীতিনামক রচনার মধ্য থেকে বেরিয়ে এসেছে- কারিগরি জ্ঞানের অভাব, অর্থনীতির ব্যয়বহুল, আত্মবিশ্বাসহীনতা ও যথাযথ উদ্যোগের অভাবে সমুদ্র অর্থনীতি পিছিয়ে পড়ার প্রসঙ্গটি জোরালোভাবে উঠে এসেছে। বেশ লক্ষণীয় বিষয় হলো বরাবরেই কবিতার দুটো পর্ব থাকে- একটি একক কবিতাগুচ্ছ আর সাধারণ নির্বাচিত কবিতা। কবিতা লিখেছেনÑ মোশাররফ হোসেন ভূঞা, মাসুদ হাসান, ফারুক আহমেদ, আহমেদ বাসার, মেঘ অদিতি, হুমায়ুন কবীর বাদল এবং রাসেল রায়হান। সব শেষে আন্দালীবের একগুচ্ছ হৃদয়ছোঁয়া কবিতা ছাপা হয়েছে। সৃজনের এই সংখ্যাটি নান্দনিক সৃজনশীলতায় ভরপুর এবং বিষয় নির্বাচনের গুরুত্ব অনুসারে অনেক কাজে দেবে। কাগজের অপূর্ব ইলাসট্রেশান যে কোন পাঠকে মোহিত না করেই পারে না-তবে সেই সঙ্গে পাঠকের মনোযোগে বিজ্ঞাপনের বিরক্তি অনেকখানি বিচ্যুতি ঘটেছে। সৃজন ভালবাসার দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার ক্ষমতা রাখে বলে বিশ্বাস। পাঠক প্রতিক্রিয়ায় আর পাঠকপ্রিয়তায় এই নিপুণ কাগজটি সাহিত্যের অভাব পূরণ করুক এমন সুখকর প্রত্যাশা আমরা সৃজনের কাছে করতে চাই। সৃজনের প্রতি স্যালুট-