ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মিহির কুমার রায়

পল্লী অর্থনীতির জন্য প্রয়োজন টেকসই বিনিয়োগ

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ১৪ মার্চ ২০১৮

পল্লী অর্থনীতির জন্য প্রয়োজন টেকসই বিনিয়োগ

সম্প্রতি ইতালির রাজধানী রোমে আইএফএডিএর ৪১তম পরিচালন পর্ষদ সভায় উদ্বোধনী ভাষণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, দারিদ্র্য ও ক্ষুধা দূর করতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগ একটি বিবেচ্য বিষয়, যা অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা ছাড়া অর্জন সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। যার জন্য একটি ব্যাপকভিত্তিক টেকসই গ্রামীণ অর্থনীতি প্রয়োজন। এখানে বিনিয়োগ বলতে প্রধানমন্ত্রী উন্নয়ন সহযোগীদের আরও বেশি করে বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে আসতে বলেছিলেন। স্থিতিশীল দারিদ্র্য বিমোচন নিশ্চিত করার জন্য শুধু শহর নগর নয়, গ্রামীণ অর্থনীতিতেও বিনিয়োগ একটি বিবেচ্য বিষয় হওয়া বাঞ্ছনীয়। বিশ্বব্যাপী অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা ছাড়া এই অর্জন করা সম্ভব নয়। এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ও ইফ্দ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ছয়টি জেলায় অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বাজার সম্প্রসারণে ৯২.০৩ মিলিয়ন ডলারের একটি ঋণচুক্তি সম্পাদন করতে যাচ্ছে। যার মাধ্যমে ৩.৩০ কোটি মানুষ উপকৃত হবে। উল্লেখ্য, সাম্প্রতিককালে দেশের দরিদ্রের হার ১২.৩ শতাংশে এবং চরম দরিদ্রের হার ১৩ শতাংশে নেমে এসেছে, যার মধ্যে দেশের গ্রামাঞ্চলের অবস্থার উন্নতি শহরের তুলনায় অনেক বেশি। এখনও দেশের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ গ্রামে বসবাস করে; কিন্তু ক্রমাগতভাবে গ্রামের সংখ্যা কিংবা গ্রামীণ অর্থনীতির অবয়ব কমে আসছে অব্যাহতভাবে নগরায়ণের কারণে। একটি তথ্যে দেখা যায়, এক শতাংশ হারে কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে, যার সিংহভাগই হলো শিল্পায়ন ও বসতি স্থাপনের কারণে। বর্তমানে মাথাপিছু জমির পরিমাণ এক ডেসিমেলের নিচে চলে এসেছে বিশেষত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ও প্রকৃতি সৃষ্ট দুর্যোগে। গ্রামীণ জনপদে বসতি স্থাপনকারীরা উন্নততর জীবন ধারণের জন্য শহরে চলে আসছে ক্রমাগতভাবে। এখানে শহর বলতে সর্বনিম্ন যে সকল উপজেলা পৌরসভা কর্তৃক স্থানীয়ভাবে শাসিত এবং গ্রাম বলতে বোঝায় যেসব উপজেলা ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক স্থানীয়ভাবে শাসিত, যাদের সংখ্যা বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদ ৪৫৪৩ ও গ্রাম ৮৭,৩২০টি। এখন গ্রামীণ অর্থনীতিতে যেসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে তার মধ্যে পদ্মা সেতু ছাড়া আর সব প্রকল্পেই দাতাগোষ্ঠীর অবদান রয়েছে, যার ফল গ্রামীণ অর্থনীতিতে বসবাসকারী জনগণই সুবিধা পাচ্ছে। সময়ের আবর্তে দেখা যাচ্ছে যে, দাতাদের বিনিয়োগ ক্রমশই কমছে, যা বর্তমান বছরে মোট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর (এডিপি) মাত্র ১২ শতাংশ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এই হার ৩ শতাংশে নিয়ে আসার চিন্তা-ভাবনা চলছে বিশেষত স্বনির্ভর অর্থনীতির কথা চিন্তা করে। তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, আমরা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতি হিসেবে এরই মধ্যে অনেক অগ্রগতি সাধন করেছি বিশেষত অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বর্তমানে একটি উদীয়মান অর্থনীতির তালিকায় স্থান পেয়েছে সত্যি; কিন্তু স্থায়িত্বশীলতার জন্য আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। এখন উন্নয়নে বিনিয়োগের কোন বিকল্প নেই সত্যি; কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে বেসরকারী বিনিয়োগ স্থবির হয়ে গেছে, যা জিডিপির মাত্র ২৮ শতাংশ। এর মূল কারণ হিসেব চিহ্নিত করা হয়েছে অপর্যাপ্ত অবকঠামো, আর্থিক সীমাবদ্ধতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও জমির স্বল্পতা। আবার শহর-গ্রামের তুলনামূলক বিচারে গ্রামের অবস্থা খুব করুণ, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে উঠে এসেছে। বাংলাদেশে মোট ব্যাংক শাখার সংখ্যা ৮৪২৭টি যার মধ্যে ৫৭.২৮ শতাংশ গ্রামে এবং ৪২.৭২ শতাংশ শহরে রয়েছে। অর্থাৎ অগণিত গ্রামীণ শাখাই গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগের মুখ্য মাধ্যম। বিনিয়োগের সিংহভাগ আসে গ্রাহকদের সঞ্চয় আমানত থেকে। সেখানে দেখা যায় শহরে ও গ্রামের শাখার সঞ্চয়ের হার যথাক্রমে মোট সঞ্চয়ের ৮২.০ শতাংশ ও ১৮.০ শতাংশ। আমরা যদি বিনিয়োগের চিত্র বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখা যায়, মোট বিনিয়োগের মাত্র ১০.২৪ শতাংশ গ্রামীণ অর্থনীতিতে হয়ে থাকে। যা দিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন কতটুকু সম্ভব? আবার যদি বিভাগওয়ারী বিনিয়োগ চিত্র দেখি তা হলে পাওয়া যায় শহর-গ্রামে বিনিয়োগের চিত্রে ঢাকা বিভাগ সর্বোচ্চ এবং বরিশাল বিভাগ সর্বনিম্ন রয়েছে। আরও তথ্যে দেখা যায়, ঢাকা বিভাগে মাথাপিছু বিনিয়োগ ৬১,০৩৬ টাকা এবং বরিশাল বিভাগে মাত্র ৫৬৭০ টাকা, যা সর্বনিম্নে। যা আঞ্চলিক বৈষম্যের একটি উজ্জ্বল চিত্র। এই ধরনের একটি পরিস্থিতিতে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের সাম্প্রতিক ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়াতে এবং সরকারী অর্থায়নে ব্যাংক ঋণের ব্যবহার কমাতে উদ্যোগী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কারণ নির্বাচনী বছরে সরকারী ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ প্রবাহ অনোৎপাদন তথা নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কাজেই এই প্রেক্ষাপটে আমরা যদি গ্রামীণ অর্থনীতিতে কেবল দাতা সংস্থা কর্তৃক বিনিয়োগ কিংবা এর মাধ্যমে উন্নয়নের কথা চিন্তা করি তাহলে দেখা যাবে উন্নয়ন সহযোগীরা তাদের মডেলের মাধ্যমে একটি সময়ের আবর্তে কাজ করে দেয়। কিন্তু চুক্তি মোতাবেক কাজ সমাপনান্তে সরকারকেই তার প্রাতিষ্ঠানিক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিতে হয়। আবার সেগুলো যদি বিনিয়োগ প্রকল্প হয় তখন ঘূর্ণায়মান তহবিল (Resolving Fund) হিসেবে সেগুলো কাজ করে থাকে। কিন্তু দেশ স্বাধীনতার ৪৬ বছরের অভিজ্ঞতা বলে দিচ্ছে যে, যে গতিতে গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন হওয়ার কথা ছিল তা হয়ে ওঠেনি কেবল উদ্যোক্তা সৃষ্টির দীনতার কারণে। কারণ, এই ধরনের অনেক বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প মেয়াদ শেষে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে রূপ নিয়েছে, যেমন আর.ডি ১০ প্রকল্প বর্তমানে পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন, ক্ষদ্র কৃষক উন্নয়ন প্রকল্প যেমন ক্ষুদ্র কৃষক উন্নয়ন ফাউন্ডেশন, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, যেমন পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক ইত্যাদি। কিন্তু তাদের কার্যক্রম গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে কি সুফল নিয়ে এসেছে তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। আবার পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) তাদের সম্প্রতি উন্নয়ন মেলায় দেখলাম সারা দেশ থেকে আগত তিন শ‘রও বেশি পার্টনার অর্গানাইজেশন তাদের উন্নয়নের সুফল মেলায় প্রদর্শন করেছে, যার বেশীরভাগই শিল্পপণ্য তৈরীর আয়োজন, যা অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক দৃষ্টি থেকে পরিচালিত। কিন্তু ব্যবসার উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন, যার কতটুকু সেই সফল সহযোগী সংস্থা উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করছে তা বোঝা যাচ্ছে না কিংবা উৎপাদনমুখী উদ্যোক্তা উন্নয়নে তাদের কতটুকু অবদান তাও বোঝা যাচ্ছে না। আবার গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃক প্রায় ৮৫ লাখ গরিব পরিবারকে ক্ষুুদ্র ঋণের মাধ্যমে যে তাদের কর্মক্ষমতার উন্নয়নে অবদান রাখছে, যার সবটুকুই প্রায় বিনিয়োগ কর্মসূচী, যা আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এখন তাদের স্থায়িত্বশীলতার অবস্থাটা কি হবে যদি গ্রামীণ ব্যাংক তাদের ঋণ সহায়তার দরজাটি বন্ধ করে দেয়। গ্রামীণ অর্থনীতির একটি বড় খাত হলো শস্য উৎপাদন, পশু পালন, মৎস্য খামার তৈরি, বনায়ন ইত্যাদি। কিন্তু সনাতনী কায়দায় পরিবারভিত্তিক কৃষি কাজে বিনিয়োগের তেমন খুব একটা সুযোগ থাকে না প্রথাগত ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে। আবার গ্রীন হাউসভিত্তিক কৃষি কাজের অপূর্ব সুযোগ থাকলেও উদ্যোক্তা যেমন পাওয়া দুষ্কর, অপরদিকে বিনিয়োগের প্রাপ্তির রাস্তাটিও খুব সহজতর নয়। অথচ চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কৃষি কাজ করে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক সফলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। যা আমরা পাড়ছি না কেন? কারণ একটাই, উদ্যোক্তা সৃষ্টি হচ্ছে না কিংবা আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা আমাদেরকে এ ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করতে বিরত থাকছে। তারপরও গ্রামীণ অর্থনীতিতে কিছুটা রূপান্তর এসেছে মৎস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে এবং বাজারে এখন যে মাছের কেনাবেচা চলছে তার সিংহভাগ চাষকৃত মাছ, প্রাকৃতিক জলাশয় যেমন হাওড়, বাঁওড়, বিল ইত্যাদি থেকে নয়। তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে তেমন সফলতা আসছে না কেবল উদ্যোক্তার অভাবে তা বলা যাবে না। তার সাথে যোগ হয়েছে সরকারী খাতে সহায়ক নীতিমালার অভাব। পশুখাদ্যের অত্যধিক মূল্য, ওষুধের অপর্যাপ্ততা, ঘাস চাষের আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে অদক্ষতা, গুঁড়া দুধ আমদানি ইত্যাদির কারণে পশুসম্পদ খাতটি প্রতিযোগিতামূলক বাজারে গ্রামীণ অর্থনীতিতে আশানুরূপ অবদান রাখতে পারছে না। এ সকল সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও সময়মতো উদ্যোগ গ্রহণ ও তার সফলতার চিত্র আমরা চ্যানেল আইয়ের মাটি মানুষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অবহিত হয়ে থাকি, যার একটা প্রাদর্শনিক প্রভাব (Demonstration Effect) অবশ্যি রয়েছে; কিন্তু সামষ্টিক অর্থে তা খুবই কম। আমাদের দেশে ব্যবসা প্রশাসনে ডিগ্রি নিয়ে উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী হয় না কিংবা একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হতে স্বপ্ন দেখে না। এটা আমাদের ব্যবসা প্রশাসনে শিক্ষক-শিক্ষা-প্রশিক্ষণের দুর্বলতা ছাড়া আর কিছুই নয়, যা কেবল মজুরিনর্ভর চাকরি বান্ধব, স্বনিয়োজিত কর্মবান্ধব নয়। এখন আমাদের ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে যেতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮.৫ শতাংশ থেকে ১০.০ শতাংশে উন্নীত করার প্রয়োজন রয়েছে, যা কেবল গ্রামীণ অর্থনীতিতে পরিচালিত গ্রাম্যপণ্য উৎপাদনের মাধ্যমেই সম্ভব, যার বেশিরভাগ খাদ্যপণ্য যার সঙ্গে পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তার সম্পর্ক রয়েছে। এখন আমাদের সময় এসেছে বহুমাত্রিক চিন্তা-ভাবনা করার এসব বিষয়ে যেমন- এক. আমাদের নিবিড় চাষবাস বিশেষত কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমেই করতে হবে এবং এই দায়িত্বটি সনাতনী কৃষকের দ্বারা পালন সম্ভব হবে না। তাই কৃষি উদ্যোক্তাকে (Agriculture Entrepreneur) এগিয়ে আসতে হবে প্রশিক্ষিত হয়ে। শস্য কিংবা সবজি উৎপাদনে গ্রীন হাউসভিত্তিক খামার প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যার মাধ্যমে বছরজুড়েই সবজি সরবরাহ ভোক্তাদের মাঝে করা যাবে। এখন শহরভিত্তিক ভোক্তাদের চাহিদা বিশেষত বিদেশী সবজির প্রতি এবং ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে নতুন নতুন ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, যেমন আগুরা, স্বপ্ন ইত্যাদিতে ভোক্তারা টাটকা উন্নত জাতের সবজি খেতে চায়, যা এসব পণ্যের জন্য একটি নির্ধারিত বাজার হতে পারে। কিন্তু একটি গ্রীন হাউস তৈরি করতে মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ প্রয়োজন, যা অনেকাংশে পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে হতে পারে, যদি সে ধরনের উদ্যোক্তা পাওয়া যায়; দুই. শস্য বিশেষ করে খাদ্যশস্য (ধান) উৎপাদনের জাত, জমি কর্ষণ, সেচ সরবরাহ, কীটনাশকের ব্যবহার ইত্যাদিতে আধুনিকায়ন হয়েছে। কিন্তু ব্যবসাভিত্তিক একটি নীতিমালার মাধ্যমে প্রযুক্তির ফলে যে উৎপাদন বাড়ছে তার সুফল পাওয়ার জন্য একটি সুসংগঠিত বাজার ব্যবস্থার প্রয়োজন তা অনেকাংশে নেই, যার সঙ্গে ব্যবসার লাভ-ক্ষতি জড়িত। তাই এ ধরনের বিনিয়োগভিত্তিক কৃষি ব্যবসা হতে হবে রফতানিমুখী, যার জন্য যত ধরনের সহায়তা দরকার তা দিতে হবে সরকারের বাণিজ্য, অর্থ ও বিমান মন্ত্রণালয়কে। কৃষিপণ্যের ব্যবসা হতে হবে একটি সুসংগঠিত শিল্প, যেখানে একদিকে থাকবে উৎপাদন এবং অন্যদিকে থাকবে বিপণন। সরকারের অর্থায়নে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় অনেক গ্রাম্য হাট-বাজার তৈরি হলেও তাদের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তেমন স্থায়িত্ব পায় না, যা প্রকল্প বাস্তবায়নের দুর্বলতা মাত্র; তিন. গ্রামীণ অর্থনীতির রূপান্তরে ষাটের দশকে সমবায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বিপণনের ক্ষেত্রে এবং সমবায় সমিতিগুলোর ভূমিকা তখন দৃশ্যমান ছিল। কিন্তু সমবায়ভিত্তিক দুগ্ধ শিল্পের প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটা স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও সারাদেশে তাদের শাখা-প্রশাখা বিস্তার করতে পারেনি। আবার অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে দুগ্ধ উৎপাদনকারীরাও জাতীয়ভাবে খুব যে রেকর্ড পরিমাণ দুগ্ধ খামারের মাধ্যমে উৎপাদন করতে পেরেছে তাও বলা যাচ্ছে না। অর্থাৎ সার্বিকভাবে বিষয়টি একটি বন্দোবস্তের মধ্যে পড়ে রয়েছে। আশির দশকে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় কৃষি ব্যাংক তার পশুপালন শাখার মাধ্যমে দুগ্ধ খামারিদের অর্থায়নে এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু সেসব খামার লাভজনকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি উপকরণ খরচ ও উৎপাদিত দুধের মূল্যের ব্যবধানের কারণে। এখানে প্রশ্ন আসে পাস্তুরিত এবং কেবল তরল দুধ বিক্রি না করে তা প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে যদি দুগ্ধজাত দ্রব্য বাজারজাত করা যেত তাহলে লাভের সম্ভাবনা অনেক বেশি হতো। কিন্তু কৃষি ব্যাংকের অর্থায়ন এই দিকগুলো বিবেচনায় না নিয়েই খামার তৈরিতে অর্থায়ন করা হয়েছে, যা সঠিক নয়। একই অবস্থা পোলট্রি শিল্পের। সেখানে ওষুধ ও খাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় বিগত দু’বছরে প্রায় ১ হাজার খামারি ঋণের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে পোল্ট্রি খামার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে এবং আরও বন্ধ হওয়ার পথে রয়েছে ১ হাজার খামার। এ ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার ডিম ও মাংস আমদানি করে থাকে ভোক্তার স্বার্থ বিবেচনায়। কিন্তু খামারিদের স্বার্থরক্ষা করবে কে? চার. গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগের একটি বড় ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে জমি ক্রয়। বিশেষত রেমিটেন্সের মাধ্যমে আয়কৃত গরিব মানুষের অর্থে যা একটি অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ। এই সময়ে উৎপাদন খাতে বিনিয়োগে পরামর্শ দেয়ার জন্য কোন প্রতিষ্ঠান যদি থাকে তা এই বিনিয়োগের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেতে পারে। সর্বশেষে বলা যায়, বিনিয়োগ অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র এবং এই ধারাকে যদি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ধরে রাখা যায় তাহলে গ্রামীণ অর্থনীতি থেকে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে মূল্য সংযোজন বৃদ্ধি পাবে এবং টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে। লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ ও গবেষক
×