ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মফিজ ইমাম মিলন

নক্সীকাঁথার কবি

প্রকাশিত: ০৭:১৪, ৯ মার্চ ২০১৮

নক্সীকাঁথার কবি

‘পৃথিবী থেকে ধীরে ধীরে নক্সী কাঁথার মাঠ অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, মুছে যাচ্ছে আল্পনার দিন, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে পুঁথি পাঠে অবসর এবং বিদায় নিয়ে যাচ্ছে এই সব সনাতন ধারার বাহক বহুশিল্পী কবি এবং সাহিত্যিক।’ এই চিরায়ত সত্যগুলো নতুন করে মনের ভেতর মোচড় খেয়ে উঠল, যখন মনে পড়ল ১৪ মার্চ কবি জসীমউদ্্দীনের তিরোধান দিবস। সেই শৈশব থেকে পাঠ্যপুস্তকের পাতাতেই কবি জসীমউদ্্দীনের সঙ্গে পরিচয়। ’কবর’ কবিতার প্রথম আট লাইন মুখস্থ অথবা ’নিমন্ত্রণ’ শব্দার্থ লিখ, এই প্রচলিত পড়া থেকেই জসীমউদ্্দীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। কবি কিংবা কবিতা নিয়ে ভাববার বয়স হয়নি। শুধু ’কবর’ কবিতা সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত থাকায় বার বার পড়তে হয়েছে। এ কবিতাটির সঙ্গে নিদারুণ কষ্টের এক গল্পের আমেজ থাকায় আরও বেশি করে পড়া হয়েছে। মধুমালা, বেদের মেয়ে, সোজন বাদিয়ার ঘাট, নক্সী কাঁথার মাঠের এই কবির সঙ্গে ধীরে ধীরে পরিচয় ঘটে। টকবি জসীমউদ্্দীন সামগ্রিক বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর কবি। তাঁর সৃষ্টিকর্মের স্বভাব ও মেজাজ সমসাময়িক কালের অন্য কবিদের থেকে তাঁকে করেছে স্বতন্ত্র, স্বাধীন এবং বিচিত্র বিভায় আলোকিত। তাঁর লেখা আমাদের এক অলৌকিক গ্রামবাংলার দিকে ধাবিত করে নিয়ে যায় মাটিও তার মানুষের খুব কাছাকাছি। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের বিশালত্বের বলয় থেকে বেরিয়ে জসীমউদ্্দীন এক নতুন ঘরানার জন্ম দিয়েছেন বাংলা কবিতায়। কিন্তু দু’জনের দেশাত্মবোধ দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক সচেতনতার চেয়ে জসীমউদ্্দীনের দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক সচেতনতা কোন অংশেই কম ছিল না। তাঁকে পল্লীকবি, মাটি ও মানুষের কবি, গ্রামবাংলার কবি আবার অনেকে গেও কবিও বলে থাকেন। কবি মনে প্রাণে ছিলেন প্রগতিশীল। প্রগতিশীল চিন্তার শুধু ধারকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ বাহক। রাজনৈতিক সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত না হয়েও প্রগতিশীল কর্মকান্ডে তাঁর উপস্থিতি ছিল বিশেষভাবে লক্ষণীয়। পল্লীকবি নিজেই বলেছেন-’ গ্রামবাসীদের দুঃখ ও শোষণ পীড়নের কাহিনী বলিয়া শিক্ষিত সমাজের মধ্যে সহানুভূতি জাগাইতে চেষ্টা করি। আর চাই, যারা দেশের এই অগণিত জনগণকে তাহাদের সহজ সরল জীবনের সুযোগ লইয়া তাহাদিগকের শোষণ করে, তাহাদের মুখের আহার কাড়িয়া লইয়া তাহাদিগকে দারিদ্র্যের নির্বাসনে ফেলিয়া রাখে, তাহাদের (শাসকদের) বিরুদ্ধে দেশের শিক্ষিত সমাজের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বালাইতে।’ তিনি ছিলেন বাঙালীর গৌরব, বাঙালীর অহংকার। কবি বলেছেন ‘আমি সারা জীবন আমার দেশের জনগণকে লইয়া সাহিত্য করিয়াছি, তাহাদের সুখ-দুঃখ-স্নেহ-মমতা, ভালবাসা লইয়া কবিতা লিখিয়াছি, নাটক লিখিয়াছি, উপন্যাস লিখিয়াছি।’ সাহিত্যে এ দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে তিনি একাকার হয়ে গিয়েছিলেন। মানুষের জীবন ও সংগ্রাম থেকে নিজেকে তিনি বিচ্ছিন্ন করেননিপপ। কেবল সাহিত্য নয় ব্যক্তি অনাকাক্সিক্ষত এবং গণবিরোধী শক্তিকে কবি আমৃত্যু ঘৃণা করেছেন মনে প্রাণে। প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতি তার বিরূপ অভিব্যক্তি সাহিত্যকর্মে প্রকটভাবে প্রকাশিত না হলেও ব্যক্তি জীবনে তার কমতি ছিল না। কবি শিশুকালে সংসার বিবাগী হতে চেয়েছিলেন। স্বদেশী হয়ে দেশে ঘুরে বেড়ানোর প্রবল ইচ্ছা পোষণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ’বন্দে মাতরম’ ধ্বনি শুনিলে আমার মন চঞ্চল হয়ে উঠে। আমার আর পড়াশোনা করতে ইচ্ছা করে না। তাঁর মনের গহনে ছোটবেলা থেকে রাজনৈতিক ভাবনার জন্য একটি পিড়ি আসন ছিল। তবে রাজনীতিকে তিনি জীবনের সিংহাসনে উপবিষ্ট করাননি। তবুও ব্যক্তিজীবনে রাজনীতি থেকে খূব বেশি দূরে বা বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। এক সময় কংগ্রেস অফিসের সাময়িক স্বেচ্ছাসেবক হয়ে তাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে করতে কবি কোলকাতায় উপস্থিত হন তরুণ অবস্থায়। শাসক চক্রের চক্রান্তে পূর্ব বাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করা হয় ১৯৬৫ সালে। নিরীহ দরিদ্র হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নেমে আসে অনাকাক্সিক্ষত সাম্প্রদায়িক চক্রের বিষাক্ত ছোবল। বহু লোক হয় হতাহত। আগুন লাগিয়ে দরিদ্র হিন্দুদের ঘরবাড়ী পুড়িয়ে দেয়া হয় ঢাকা নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে। জাতির এই দুঃসময়ে কবি সোচ্চার হলেন, ঝাঁপিয়ে পড়লেন দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে। ’বাঙালী রুখিয়া দাঁড়াও’ ডাক দিলেন সাহসী বাঙালীদের। নিজে সংগঠিত করলেন শান্তি মিছিল। শান্তি মিছিল নিয়ে পরিভ্রমণ করলেন দাঙ্গা উপদ্রুত এলাকাসমূহে। ‘যে দেশে মানুষ বড়’ গ্রন্থটি তিনি কমিউনিস্ট নেতা মনি সিং কে উৎসর্গ করেন। তাঁর এই উপহার ছিল শাসিত মানুষের মুক্তি আন্দোলনের সপক্ষে, নির্যাতিত মানুষকে সংগ্রামী করে তোলার লক্ষ্যে। অবসর গ্রহণের পর ন্যাপ দলে যোগদান কবির অভিপ্রায় ছিল। ন্যাপের কয়েকটি অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দিয়েছেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ন্যাপ তাকে ফরিদপুর আসনে মনোনয়ন দিয়েছিল। কিন্তু তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। পরবর্তী সময়ে তিনি দেশের মহৎ প্রাণ নেতা বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শে আসায় তার রাজনৈতিক দলীয় মতবাদের পরিবর্তন ঘটে। সাংগঠনিকভাবে না হলেও লেখায় ও কথায় তিনি বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা হয়ে উঠেন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তুজম্বর আলী ছদ্ম নামে বলিষ্ঠ বক্তব্য নিয়ে কিছু কবিতা লেখেন। মুক্তিযুদ্ধের উপরে রচিত এই কবিতা আমেরিকায় মেয়ে হাসনা মওদুদের নিকট পাঠিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। ভারতে কবিতাগুলো প্রকাশিত হলে বিশ্ববরেণ্য সাহিত্যিক মুল্লুকরাজ আনন্দসহ বহু লোক তাঁর সাহসিকতার ভূয়সী প্রশংসা করেন। মানুষের জাগতিক দুঃখের রূপকার ছিলেন কবি জসীমউদ্্দীন। গ্রাম বাংলার হিন্দু মুসলমান উভয় সমাজের জীবন প্রবাহ যিনি উপস্থাপন করেছেন সমান দরদ দিয়ে। কবির সকল সৃষ্টিকর্মে তার মানবপ্রেমের সার্থক অভিব্যক্তি ঘটিয়েছেন। কবিতা, গান, লোকনাট্য, ভ্রমণকাহিনী ও শিশু সাহিত্য লিখেও যিনি যশস্বী হয়েছেন। অমর হয়েছেন পল্লী-জীবনের কবিতা ও কাহিনী লিখে। লোক-জীবন থেকে সংগ্রহ করেছেন তাঁর কাব্যেও উপকরণ। শুধু কবিতার বস্তু সম্পদে নয়, শব্দ সম্পদে কবি ছিলেন গ্রামনিষ্ঠ । তাই তিনি ছিলেন পল্লী কবি। কবি জসীমউদ্্দীনের মতো করে গ্রামের আল পথে, ধান ক্ষেতে, গ্রামের রোদ হাওয়া গায়ে মেখে বেদের বহরের হাসি কান্নায় সুর মেলাতে আর কোন কবি আবার পারবেন কিনা তা ভবিষ্যতই বলতে পারে। কেন না, পৃথিবী থেকে ধীরে ধীরে নক্সী কাঁথার মাঠ সত্যিই অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সেই উদার মনমানসিকতা। নিজেরা ভুগছি অজ্ঞাত এক সামাজিক রোগে। যে রোগ কাছকে দুর করছে প্রতিনিয়ত। আসুন, জসীমউদ্্দীনের গ্রামে যাই যেখানে দল নয় মানুষ বড়।
×