ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিদায় বীরমাতা

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ৯ মার্চ ২০১৮

 বিদায় বীরমাতা

মৃত্যু এসে তাকে নিয়ে গেছে পরপারে। কিন্তু তিনি রয়ে গেছেন মানবমনের সকল প্রহরে। বীরের বেশে বীরত্বের গৌরবগাথা নিয়ে জেগেছিলেন তিনি এই বাংলার মুক্তির কামনায়। যার হাতের স্পর্শে মৃত বৃক্ষও পেয়ে যেত বুঝি নতুন প্রাণ। প্রাণের প্রবাহ তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন মুক্তিকামী বাঙালীর যুদ্ধ জয়ের দিনেও। নির্যাতিত হয়েছিলেন একাত্তরে। জীবন থেমে থাকেনি তারপরও। হতাশা, ক্লান্তি গ্লানি বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হননি। দুর্বিষহ অতীত ভুলে সামনের দিকে এগিয়ে এসে হয়েছিলেন তিনি একাত্তরের নির্যাতিতদের মুখপাত্র। কাষ্ঠখ-ের মাঝে খুঁজে নিয়েছিলেন জীবনের নতুন অর্থ। সাহসের বরাভয় কাঁধে সমাজজীবন জগতকে উপেক্ষা করে বর্ণনা করেছেন একাত্তরের হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হওয়ার ভয়াল ঘটনাসমূহ। নির্যাতনের ঘটনা তিনি চেপে রাখেননি। বরং নীরবতা ভেঙ্গে সেগুলো বীরদর্পে জাতিকে জানিয়েছেন। হয়ে উঠেছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের কণ্ঠস্বর। জাতি তার সেই বীরত্বকে সম্মান জানিয়েছে। নিজের ওপর সংঘটিত নির্যাতন সম্পর্কে প্রকাশ্যে বলতে চাইতেন না। এ জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে তিনি সময় নিয়েছেন, তারপর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এ বিষয়ে জনগণকে জানানোর। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা মুক্তিযুদ্ধের সময় কী ঘৃণ্য তৎপরতা চালিয়েছে তা মানুষকে জানাতে হবে। জানানোর পর তিনি বিচার দাবি করেছিলেন। তিনি ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, সংগ্রাম ও সাহসে অদ্বিতীয় নারী। শুধু তিনি নন, একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের দোসরদের হাতে নির্যাতিত নারীদের সবাই এমন সংকোচের দেয়ালে আবদ্ধ ছিলেন যে, সেদিনের ঘটনা জনসমক্ষে তুলে ধরার সাহস দেখাননি। স্বাধীনতার পর থেকেই তাদের চারপাশে ঘেরা ছিল অবহেলা, অপমান ও বেদনার দেয়াল। ফেরদৌসী প্রথম সেই দেয়াল ভেঙ্গে ফেলেন। শুধু নিজের দেয়াল ভাঙ্গা নয়, একাত্তরে নির্যাতিত অন্য নারীদেরও উদ্বুদ্ধ করেছেন এ বিষয়ে কথা বলতে। একাত্তরে নির্যাতিত যারা আড়ালে ছিলেন, তাদের সামনে আসার জন্য, কথা বলার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলাকালে সে সময় নির্যাতিত নারীরা যে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন এটা সম্ভব হয়েছে ফেরদৌসীর কারণে, তার কারণেই একাত্তরে নির্যাতিত নারীরা যেন সম্মান ও ঠিকানা খুঁজে পেয়েছেন। বর্তমান সরকার যে নির্যাতিত নারীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন, এর পেছনেও রয়েছে তার ভূমিকা। বলতেনও তিনি, আমরা নির্যাতিত বটে, একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাও। আমাদের ত্যাগ ও যন্ত্রণার সীমা পরিসীমা নেই। একাত্তরের ঘটনা সামনে আনার জন্য তাকে বিভিন্ন মহল হতে অপমান, এমনকি লাঞ্ছনার শিকারও হতে হয়েছে। কিন্তু তার সাহসের কাছে সব বাধা দূর হয়েছিল। শুধু বাংলাদেশে নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও ফেরদৌসী হয়ে উঠেছিলেন যুদ্ধকালীন নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক। তিনি চাইতেন, বাংলাদেশের নির্যাতিত নারীদের কথা সবাই জানুক। গ্রামে গ্রামে গিয়ে একাত্তরের নির্যাতিত নারীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের সাহস যুগিয়েছেন। সারাজীবন তিনি শুধু বাংলাদেশের কথা ভাবতেন। তিনি অসীম সাহসিকতার সঙ্গে যেভাবে এগিয়ে এসেছেন, তাতে আমাদের আরও অনেক কিছু লেখার আছে। ফেরদৌসী তার ভাস্কর্য বা শিল্পকর্মেও নিজের যন্ত্রণাকে তুলে ধরেছেন। ১৯৯৯ সালেও তিনি বলেছিলেন, শরীরে আবর্জনা বয়ে নিয়ে বেড়ানোর অনুভূতি হতো তার। শিল্পকর্মেও তিনি আবর্জনা থেকে মহৎ কিছু করতেন। বেদনা ও কষ্টকে তুলে ধরেন শিল্পের মাধ্যমে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহ-সভাপতি হিসেবে সারাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন। স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। একাত্তর বছর বয়সে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুতে একটি বিরাট শূন্যতা তৈরি হলো। যা পূরণ হওয়ার নয়। তবে তার সাহস ও সংগ্রাম অনুপ্রাণিত করবে মুক্তিকামী মানুষকে। তার প্রয়াণে আমরাও ব্যথিত। তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। বিদায় বীরমাতা। বিদায় মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী।
×