ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান

প্রভাবশালী পাঁচ শিল্প মতবাদ

প্রকাশিত: ০৭:২০, ১২ জানুয়ারি ২০১৮

প্রভাবশালী পাঁচ শিল্প মতবাদ

শিল্পের জগতে নতুন একটি ধারা তখনই সৃষ্টি হয়Ñযখন প্রচলিত চিন্তা, চেতনা ও উপস্থাপন থেকে সরে এসে শিল্পীরা স্বাতন্ত্র্য একটি ঢংয়ের আলোয় নিজেদের উদ্ভাসিত করেন। এই উপস্থাপন শিল্পের দুনিয়ায় কেবল নতুনত্বই যোগ করে না, পাশাপাশি এটি শিল্পের প্রবাহকে হাজার হাজার বছর ধরে গতিশীল রাখতে সবচেয়ে অর্থবহ ভূমিকাও পালন করে। বিশ^ চিত্রকলার যে বৈচিত্র্য, সহ¯্র চিন্তার বর্ণিল প্রকাশÑতার উৎসমূলে খোঁজ করতে গেলে আমরা ধারা ভেঙ্গে নতুন ধারা সৃষ্টি করার সমগ্র প্রক্রিয়াটি দেখতে পাব। চিত্রকলার প্রতিটি ইজমই প্রথমে একজনের চিন্তার ফসল হলেও পরবর্তীতে বহুল চর্চার কারণে ওই ধারাটির একটি নিজস্ব বলয় সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন শিল্পীদের চিন্তায় ও চর্চায় মতবাদের বিকাশ ঘটে এবং সমৃদ্ধ হয় চিত্রকলার ভুবন। আলোচ্য নিবন্ধে শিল্পের প্রভাবশালী মতবাদ ইমপ্রেশনিজম, ফভিজম, কিউবিজম, ডাডাইজম ও সুররিয়ালিজম নিয়ে দু-চার কথা বলার প্রয়াস পেয়েছি। ইমপ্রেশনিজম উনিশ শতকের চিত্রকলায় যেসব মতবাদ গতানুগতিক চিন্তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তার মধ্যে ‘ইমপ্রেশনিজম’ অন্যতম। শিল্পের রাজধানী প্যারিসে ১৮৭৪ সালে (১৫ এপ্রিল থেকে ১৫ মে পর্যন্ত) প্রথমবারের মতো ইমপ্রেশনিস্টদের আঁকা নিয়ে মাসব্যাপী একটি চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। এ প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত ক্লদ মোনের ‘ওসঢ়ৎবংংরড়হ, ঝঁহৎরংব’ ছবিটিকে ইমপ্রেশনিজম ধারার প্রারম্ভলগ্নের উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৮৭৪ সালে ছবিটির প্রদর্শনী হলেও ক্লদ মোনে এটি এঁকেছিলেন ১৮৭২ সালে। মোনে তাঁর জন্মশহর ল হাভরে গিয়ে এই ছবিটি এঁকেছিলেন। ‘ওসঢ়ৎবংংরড়হ, ঝঁহৎরংব’ ছবিটি থেকেই পরবর্তীতে ‘ওসঢ়ৎবংংরড়হরংস’ শব্দটি নেয়া হয়। ওই প্রদর্শনীতে ৩০ জন শিল্পী তাঁদের ২ শতাধিক কাজ প্রদর্শন করেছিলেন। ক্লদ মোনে ছাড়াও শিল্পের ইতিহাসের উজ্জ্বল এ প্রদর্শনীতে অ্যাডগার দেগা, কামিল ফিসারো, পিয়েরে অগাস্ট রেনোয়া, আলফ্রেড সিসলি প্রমুখরা অংশ নেন। ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীরা এ আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রচলিত রীতি-নীতি ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। এ ভাঙ্গন কেবল ছবি আঁকায় ফর্মের পরিবর্তন কিংবা রোমান্টিসিজম, রিয়ালিজম থেকে দূরে সরে নয়, এ পরিবর্তন সামাজিকও। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে না গিয়ে, সরকারী সহযোগিতা না নিয়ে শিল্পীরা একজন ফটোগ্রাফারের বাড়িতে এ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন। শিল্পীর স্বাধীনতার বিষয়ে তাঁরা ছিলেন আপসহীন। যেহেতু প্রথা ভেঙ্গে, প্রথার বাইরে গিয়ে নতুন কিছু করার চেষ্টা ছিল শিল্পীদেরÑতাই স্বাভাবিকভাবে সমালোচকদের নিষ্ঠুর সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে ইমপ্রেশনিস্টদের। প্রথমবারের মতো আয়োজন হলেও ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের ছবি দেখতে ৪ হাজারের বেশি দর্শনার্থী প্রদর্শনীতে এসেছিলেন। ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের চিন্তার জগতে একবার ডুব দিয়ে আসা যাক। ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীরা উপলব্ধি করেছিলেন সময় ও আলোর পরিবর্তনে রঙের পরিবর্তন হয়। আলোর তারতম্যের কারণে রং একেক সময় একক রূপ লাভ করে। এ ধারার শিল্পীরা জীবন ও প্রকৃতির সংবেদনশীল মুহূর্তগুলোকে ক্যানভাস-বন্দী করতে আগ্রহী ছিলেন। ফলে তাঁরা চার দেয়ালের স্টুডিওকে বাদ দিয়ে বেছে নিলেন খোলা আকাশ। কেননা, স্টুডিও-এর বদ্ধ রুমে জীবন ও প্রকৃতির মুহূর্তের দৃশ্য অবলোকন করা সম্ভব নয়। যেহেতু মুহূর্তের তারতম্য, রঙের পরিবর্তনকে তুলিতে প্রকাশের ইচ্ছে রাখেন ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীবৃন্দÑতাই তাঁদেরকে বিপুল মনোযোগ সহকারে জীবন ও জগতের মুহূর্তের দৃশ্যকে দেখতে হতো, উপলব্ধি করতে হতো মুহূর্তের পরিবর্তনগুলোকে। আলো ও বিশুদ্ধ রঙের প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল এ ঘরানার শিল্পীদের। তাঁরা উজ্জ্বল রঙে ছোট ছোট আঁচড়ে ছবি আঁকতে আগ্রহী ছিলেন। ইমপ্রেশনিজম সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রখ্যাত সমালোচক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর বলেছেন, ‘ইমপ্রেশনিজম বাস্তববাদের দৃশ্যমান পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাড়িয়ে দিয়েছে। এই স্টাইলে প্রতিফলিত হয় দুই মনোভঙ্গি। প্রথমটি হচ্ছে স্থানিক রং সম্বন্ধে উৎসাহ। ...দ্বিতীয়টি হচ্ছে পরিচিত দৃশ্য কিংবা বস্তুকে অপরিচিত ধরনে কিংবা অপ্রত্যাশিত কোণ থেকে দেখার উত্তেজক মোহনীয়তা। বাস্তববাদের ক্যামেরা চোখে শিল্পীর ভূমিকা প্রকৃতির বর্ণনে পর্যবসিত।...তাঁদের ব্রত ‘চোখ’ হয়ে ওঠা।’ যদিও সেসময়ে এ ধারাটি নতুন ছিলো, তবু ক্লদ মোনে বলতেন, ইমপ্রেশনিজম হচ্ছে সরাসরি সংবেদন। প্রত্যেক মহান শিল্পীই কম বা বেশি ইমপ্রেশনিস্ট ছিলেন। কেননা, এটি মূলত সহজাত প্রবৃত্তির প্রশ্ন। ইমপ্রেশনিজম ধারার প্রখ্যাত শিল্পীদের মধ্যে থেকেও অ্যাডওয়ার্ড মনে আলাদা ছিলেন। তিনি বলতেন, ‘প্রকৃতিতে কোনো রেখা নেই।’ রেখাবিহীন কেবল রঙের মিশ্রণে তিনি চিত্রকর্ম আঁকতেন। আবার ক্লদ মোনে ভাবতেন চিত্রকর্ম হচ্ছে ‘বৈজ্ঞানিক মানসের প্রতিশ্রুতি’। অ্যাডগার দেগা মনে করতেন চিত্রের মধ্যে গতিময়তা থাকতে হবে। আবার ইমপ্রেশনিজমে তিনি শরীরী প্রতীক ব্যবহার করেছেন। শুধু অ্যাডগার দেগা কিংবা মোনে নন, ফ্রেডরিক বাজিল, কামিল পিসারো, পিয়েরে অগাস্ট রেনোয়া, আলফ্রেড সিসলি, গুস্তাভ ক্লাইলবট, মেরি ক্যাসাট, পল সেজান, বার্থ মরিসট প্রমুখ ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীরা প্রত্যেকেই পরস্পর থেকে আলাদা ছিলেন। রঙের ব্যবহারে, চিন্তায় ও উপস্থাপনে তাঁদের স্বাতন্ত্র্যের কারণেই ইমপ্রেশনিজম শক্তিশালী মতবাদে রূপ লাভ করে। ফলে এ ধারার চিত্রকর্মের ভা-ার খুব দ্রুতই সমৃদ্ধ হয়েছে। অ্যাডওয়ার্ড মোনের দখঁহপযবড়হ ড়হ ঃযব এৎধংং’, আলফ্রেড সিসলির দঋড়ম, ঠড়রংরহং’, বার্থ মরিসট-এর দওহ ধ চধৎশ’, অ্যাডগার দেগার দঞযব অনংরহঃযব উৎরহশবৎ’, ম্যারি ক্যাসার্টের দঅঃ ঃব ড়ঢ়বৎধ’, পিয়েরে অগাস্ট রেনোয়া দএরৎষ রিঃয ধ ঐড়ড়ঢ়’, গুস্তাভ ক্লাইলবটের দচধৎরং ঝঃৎববঃ, জধরহু উধু’, ক্লদ মোনের দঠবঃযবঁরষ রহ ঃযব ঋড়ম’, কামিল পিসারোর দঞযব ইড়ঁষবাধৎফ গড়হঃসধৎঃৎব, অভঃবৎহড়ড়হ’ ইমপ্রেশনিজম ধারার উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম। আধুনিক চিত্রকলার ইতিহাসে ইমপ্রেশনিজম প্রথম শিল্প আন্দোলন হলেও এ ধারাটির কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। জীবনের অতলে ঘুরে আসা ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের উদ্দেশ্য নয়। অনেক শিল্পসমালোচক মনে করেন, ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীরা জীবনের সুখকে এঁকেছেন। বেদনা-বিদীর্ণতা, দুঃখ ও দহন তাঁদের তুলিতে তেমনভাবে উঠে আসেনি। অনেকদিকে বিষয়ের বৈচিত্র্যতাও উল্লেখযোগ্য ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইমপ্রেশনিজম পরবর্তীতে নতুন নতুন ধারা সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছিল। বলা হয়, ইমপ্রেশনিজম হলো সকল আধুনিক চিত্রকলার উৎস। এ ধারাটির পথ ধরেই পরবর্তীতে নিউ ইমপ্রেশনিজম, পোস্ট ইমপ্রেশনিজম, ফবিজম ও কিউবিজম মতবাদের জন্ম নেয়। প্যারিসে ইমপ্রেশনিজম ধারার যে শিল্প আন্দোলন শুরু হয় পরবর্তী সময়ে সেটি দেশ ও কালের সীমানা ভেঙে ফেলে। প্রায় শতবর্ষব্যাপী এ ধারার গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীরা ক্যানভাসে ঝড় তোলেন। চিত্রকলার এ ধারা পরবর্তীতে সাহিত্যসহ শিল্পের অন্যান্য শাখায় প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়। যার কারণে এখনো ইমপ্রেশনিজম শিল্পীদের চর্চা ও শিল্পরসিকদের আগ্রহের বিষয়। ফভিজম সময়কে খ-িতভাবে যদি ‘শিল্পের সময়’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তবে শিল্প যে কালে কালে বর্ণিল হয়ে ধারণ করেছে বহুমুখী সময় ও প্রতিক্রিয়াÑতার শেকড়ে রয়েছে বিভিন্ন মতবাদের উদ্ভব ও বিকাশ। এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত প্রত্যেকটি মতবাদই শিল্পের জন্যে নতুন চিন্তা বহন করেছে এবং নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোয় শৈল্পিকভাবে তুলে ধরেছে মানুষের দর্শন, অনুভব ও উপলব্ধির বিচিত্র রূপকে। স্বতন্ত্র্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার কারণেই প্রেম, প্রতিবাদ, প্রকৃতি, কষ্ট, দহনসহ আরও নানা অনুষঙ্গকে একেক শিল্পী একেকভাবে শিল্প মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। এতে কেবল শিল্পের ভুবন প্রসারিত-ই হয়নি, সমৃদ্ধও হয়েছে। বিগত মতবাদগুলোর মতই ফভিজম শিল্পের জগতে ভিন্ন একটি চিন্তা নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। ফরাসি ‘ফভ’ থেকেই ফভিজম শব্দের উৎপত্তি। ফরাসী ভাষায় ফভ বলতে বন্যপশুকে বোঝায়। এ ঘরানার শিল্পীদের ফভিস্ট বলা হতো। ফভিজম আন্দোলনের অগ্রগামী শিল্পী ছিলেন হেনরী মাতিস ও আন্দ্রে ডেরাঁ। যদিও ১৮৯৮ সালে হেনরী মাতিস এ ধারার ছবি এঁকেছিলেন কিন্তু এ আন্দোলনের পরিপূর্ণ রূপটি প্রকাশিত হতে আরও ক’বছর সময় লেগেছিল। ফভিজম শিল্প আন্দোলনের প্রথম প্রদর্শনী হয় ১৯০৫ সালে। এ প্রদর্শনী থেকেই ফভিজম শব্দটির প্রচলন শুরু হয়। ১৯০৫ সালে হেনরী মাতিস, আন্দ্রে ডেরাঁ, আলবার্ট মারকোয়ে প্রমুখ শিল্পীরা প্যারিসের ‘সালো দ্য অটাম’-এ তাঁদের চিত্রকর্ম প্রদর্শন করেন। গ্যালারির চারদিকে চিত্রকর্ম টানানো হলেও মাঝখানে ইতালীয় রেনেসাঁসের বিখ্যাত ভাস্কর্য ‘দোনাতেলেস্তা’ রাখা হয়েছিল। লুই ভকসেল নামের একজন সমালোচক সেই প্রদর্শনীতে গিয়েছিলেন। সম্ভবত গ্যালারিতে নতুন ধারার অদ্ভুত চিত্রকর্মের মধ্যে নান্দনিক ভাস্কর্য ‘দোনাতেলেস্তা’র উপস্থাপন তাঁর কাছে উদ্ভট মনে হয়েছিল। এ যেন চারদিকে অসংখ্য বাঁদরের মাঝে একটি মুক্তার মালা! লুই ভকসেল তখন এ প্রদর্শনী সম্পর্কে ‘গিল ব্লেস’ পত্রিকায় সমালোচনা করতে গিয়ে দপধমব ধীঁ ভধাঁবং শব্দ প্রবন্ধটি লিখেছিলেন। পরবর্তীতে এই ঋধাঁবং শব্দটি থেকেই ফভিজম শব্দটির প্রচলন হয়। ফভিজমের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সংক্ষেপে কিন্তু বিস্তৃতভাবের একটি মন্তব্য করেছেন বরেণ্য চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর। তিনি লিখেছেন, ফভিজম ‘চিত্র-আন্দোলনের মূলভিত্তি হলো অমিশ্র রঙের উল্লাস। এই চিত্রমালার অবিমিশ্রিত রঙের ভেতর দিয়ে অভিব্যক্তির স্বাধীনতা ও পরিপ্রেক্ষিত দর্শককে প্রথম দর্শনে হতবুদ্ধি ও হতভম্ব করে দেয়। গতানুগতিক ও ক্লাসিসিজমের বিরুদ্ধে যেমন ইম্প্রেশনিস্টদের উপস্থিতি, তেমনি নিউ ইম্প্রেশনিস্টদের বিরুদ্ধাচারণ করে ফভ্বাদের প্রকাশ।’ এজন্যেই ফভিজম ধারার শিল্পীরা উজ্জ্বল রঙের প্রয়োগ করতেন। শুধু তাই নয়, তাঁরা রঙের বৈপরীত্য মানেননি। প্রকৃতি ও জীবনে যে রঙ স্বাভাবিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল এ ধারার শিল্পীরা স্পষ্টত তার বিরুদ্ধাচরণ করলেন। বাস্তবতার রঙের জগৎ থেকে তাঁরা নিজেদের অনেক দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। কেননা তাঁরা মনে করতেন, অনুভূতির সাথে রঙের সুস্পষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। অনুভূতির পরিবর্তনের কারণেই রঙের মধ্যে তারতম্য দেখা দেয়। বাহ্যিক রং-কে উপেক্ষা করে নিজেদের অনুভূতি ও চেতনার পরিবর্তনশীল রঙের ওপর দাঁড়িয়ে শিল্পীরা তাঁদের ক্যানভাস রাঙিতে আগ্রহী ছিলেন। যার কারণে অন্যসব শিল্পীর তুলিতে বৃক্ষ, ফুল, নদীসহ পরিচিত বিষয়-আশয় যেভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, ফভিজমে এমন দৃশ্যাবলি সেভাবে উপস্থাপিত হয়নি। মূলত পরিচিত রঙের পৃথিবীকে ভেঙে চুরে দিয়েছিলেন ফভিজমের শিল্পীরা। ফভিজমের নেতৃত্বদানকারী শিল্পী হেনরী মাতিস তাঁর চিন্তা সম্পর্কে বলেছেন : ‘বর্ণ যেহেতু আমাদের চেতনার সারথি এবং তার নিজস্ব একটা ক্ষমতা আছে তবে তাকে আমরা ভিন্ন পথে চালিত করি না কেন। আমাদের দেহে ও অবয়বে তো সাদা, বাদামি, কালচে, ঈষৎ গোলাপি ছাড়া কোনো রং নেই। এতকাল তাহলে আমরা লাল, হলুদ, নীল আর সবুজের অমিশ্র ছোপে এবং আরো কত বিমিশ্র বর্ণযোজনে মানুষকে এঁকেছি কেন। তার অর্থ বর্ণের সত্য হচ্ছে চিত্রকলার মর্মকথা। আমি যদি পরস্পরবিরোধী রঙের বিন্যাস মানুষের মুখে চাপাই তাহলে তার অন্তর্লীন সংক্ষুব্ধতা আর জর্জর ভাষা পাবে।’ ফবিজমের চিত্রকর্ম সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে আন্দ্রে ডেরাঁর ‘ঈযধৎরহম ঈৎড়ংং ইৎরফমব’ চিত্রকর্মটি নিয়ে একটু কথা বলা যাক। তাহলে এ ধারা সম্পর্কে সহজে উপলব্ধি করা যাবে। ডেরাঁ ছবিটি এঁকেছিলেন ১৯০৬ সালে। এ ছবি কোন ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পী আঁকলে নিঃসন্দেহে প্রকৃতির স্বাভাবিক স্বভাব বজায় থাকতো। চেষ্টা থাকতো মুহূর্তকে ফ্রেমবন্দী করার। কিন্তু আন্দ্রে ডেরাঁ ছবিতে প্রচলিত রঙের ব্যবহার করেননি। এ ছবিতে রঙের ব্যবহার খুব তীব্র। ব্রিজের নিচের প্রবাহমান পানির কিছু অংশকে হলুদ, কিছু অংশকে নীল রঙ দিয়ে আঁকা হয়েছে। ঢেউ বোঝাতে আলাদা রঙের আঁচড় দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে দূরের বাড়িঘর, বৃক্ষসম্ভার অর্ধেক সবুজ, অর্ধেক নীল রঙে মোড়ানো। আকাশকে আঁকা হয়েছে লালচে আভায়। তবে পুরো ছবিতেই লাল রঙের আধিপত্য বেশি। নিঃসন্দেহে প্রচলিত যে রঙের ধারণা তার তোয়াক্কা করেননি আন্দ্রে ডেরাঁ। যার ফলে দঈযধৎরহম ঈৎড়ংং ইৎরফমব’ চিত্রকর্মে তিনি অনুভূতির পরিবর্তনশীল রঙকে ব্যবহার করেছেন। প্রচলিত রং দিয়ে ক্যানভাস না রাঙিয়ে তিনি অন্তর্গত চেতনার রঙে ক্যানভাসকে সাজিয়েছেন। শুধু ডেরাঁ নন, ফভিস্ট সব শিল্পীই রং ব্যবহারের এই স্বাধীনতা উপভোগ করেছিলেন। ফবিজম ধারার শিল্পীরা শিল্পের ‘বুদ্ধিবৃত্তিক’ অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। আন্দ্রে ডেরাঁ বলতেন, `Art must not be intelligent; art is a jouisance, an enjoyment.’ হেনরী মাতিস তাঁর আঁকাআঁকি নিয়ে বলেছেন, আমি কখনো কোন জিনিসপত্র আঁকি না। আমি কেবল জিনিসপত্রের মধ্যে পার্থক্য আঁকি। প্রত্যেকটি মতবাদকেই প্রতিষ্ঠা পেতে প্রতিকূল পরিবেশকে অতিক্রম করতে হয়েছে। যেহেতু এ ধারার শিল্পীরা উপস্থাপনের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন-স্বাভাবিকভাবেই অনেক মানুষ তাঁদের আঁকাকে গ্রহণ করতে পারেনি। ১৯০৫ সালের প্রদর্শনীতেই তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে হেনরী মাতিসের আঁকা ‘ওমেন উইথ এ হ্যাট’ ছবিটি। সে সময়ে কোন এক বিক্ষুব্ধ দর্শনার্থী রাগে-ক্ষোভে এ ছবিটিতে নখের আঁচড় পর্যন্ত দিয়েছিলেন। হেনরী মাতিস প্রথম দিনে এ প্রদর্শনীতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর অভিজ্ঞতা সুখকর হয়নি। প্রথম দিনের আগত দর্শনার্থীরা মাতিসকে সমালোচনার বাণে জর্জরিত করেছিলেন। এ বাণ এতই তীব্র ছিল যে, মাতিস আর গ্যালারিতে যাননি। কিন্তু বহু প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এ শিল্প আন্দোলন থেমে থাকেনি। যার ফলে ফভিজম পরবর্তীতে শক্তিশালী একটি মতবাদে পরিণত হয়। হেনরী মাতিস, আন্দ্রে ডেরাঁ, ডেনেন, ভøামিনক, মেটজিঙ্গার, ব্রাক, রাওল ডুফি, ম্যানগুয়িন, আলবার্ট মারকোয়ে, এলিস বেইলি, জর্জ রুয়ো প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ফভিস্ট শিল্পী। ফভিজমের উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম হলো : হেনরী মাতিস-এর , Blue Nude II, Lxuury, Calm, and Desire, The Green Stripe, A Glimpse of Notre-Dame in the Late Afternoon, The Joy of Life; Av‡›`« ‡Wivu-Gi Portrait of a Young Girl, , The Drying Sails, Charing Cross Bridge; føvwgbK-Gi The River Seine at Chatou, Barges on the Seine; জেন মেটজিঙ্গার-এর Colored Landscape with Aquatic Birds, কিস ভেন ডেনেন-এর Woman with Large Hat ইত্যাদি। ফভিস্টরা শিল্প আন্দোলনে নতুন দৃষ্টি ও চিন্তা যুক্ত করেছিলেন। পাশাপাশি রঙের উপস্থাপন নিয়েও তাঁরা সমকালে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিলেন। ফভিজম একটি প্রভাবশালী শিল্প আন্দোলন হলেও এটির জোয়ার দীর্ঘস্থায়ী ছিল। ১৯০৪ সাল থেকে প্রভাব বিস্তার করা এ মতবাদটি ১৯১০ সালের দিকে এসে স্তিমিত হয়ে পড়ে। যদিও এর পরবর্তী সময়েও ফভিজমের চর্চা জার্মানি, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের শিল্পীদের চিত্রকর্মে লক্ষ্য করা যায়। (চলবে)
×