ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আশরাফ পিন্টু

শরৎচন্দ্র কেন জনপ্রিয়

প্রকাশিত: ০৭:০২, ৫ জানুয়ারি ২০১৮

শরৎচন্দ্র কেন জনপ্রিয়

বাংলা কথাসাহিত্যে অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৫ সেপ্টেম্বর ১৮৭৬-১৬ জানুয়ারি ১৯৩৮)। রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’, ‘নষ্টনীড়’ প্রভৃতি রচনা যে সমাজ সচেতনতার পরিচয় দিয়েছে শরৎচন্দ্রের হাতে তারই বিকাশ ঘটেছে। মনস্তত্ত্বমূলক উপন্যাস সৃষ্টির যে বৈশিষ্ট্য রবীন্দ্রনাথের হাতে পরিদৃষ্ট হয়, শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের মধ্যেই তারই অভিনব দৃষ্টিভঙ্গির সার্থক প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। বঙ্কিমের রোমাণ্টিক ও ঐতিহাসিক উপন্যাসের পথরেখা ছেড়ে যখন তিনি বর্তমানের সমস্যা জর্জরিত জীবনের সমতলে এসে দাঁড়ালেন, বলতে গেলে তখন থেকেই শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি রাতারাতি ছড়িয়ে পড়ল। অবশ্য প্রত্যক্ষ জগত থেকে আহৃত উপাদানই যে কেবল উপন্যাসে তার জনপ্রিয়তা এনেছে তা নয়, প্রেমের বিচিত্র রহস্য উদঘাটনেও তিনি যথেষ্ট পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। শরৎচন্দ্রই সর্বপ্রথম বঙ্কিম মতবাদের প্রতিবাদ করে দেখালেন যে বিধবা, পতিতা তথা সমাজ বিগর্হিত নারীর অন্তরেও আছে নিষ্পাপ প্রেম। তিনি নীতির কাছে শিল্পীর পরাজয় মেনে নেননি। কেননা নারীর সতীত্বের চেয়ে নারীর নারীত্বই শরৎসাহিত্যে নারী চেতনার মর্মবাণী। মূলত তিনি আধুনিক পাশ্চাত্য সাহিত্যের যে মানবতাবাদের মূলসূর তারই রূপায়ণ ঘটিয়েছেন তাঁর গল্প-উপন্যাসে। ওয়াল্ট হুইটম্যানের মতো তিনিও পতিতাকে মানব মহিমার আদর্শোজ্জ্বল দাবিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ‘পাপকে ঘৃণা কর, পাপীকে নয়’Ñ বাইবেলের এই পবিত্র বাণীই শরৎ সাহিত্যে আদর্শ হয়ে উঠেছে। শরৎচন্দ্রের বাউ-ুলে জীবন তাকে দিয়েছিল চরম অভিজ্ঞতা। আর সেই অভিজ্ঞতার বীজই তার জীবনে সোনা ফলিয়েছিল। দরিদ্র ও ছন্নছাড়া জীবনের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে তিনি নিংড়ে সৃষ্টি করেছিলেন নতুন আঙ্গিকে নতুন সাহিত্যরস ও শিল্পাদর্শ। তার সেই বিচিত্র অভিজ্ঞতালোকে যে রস সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছিল তা আজও পাঠকের হৃদয়তন্ত্রী ধরে টানে। নিচে তার জনপ্রিয়তার প্রধান কারণগুলো তুলে ধরা হলো ঃ ১.শরৎচন্দ্র তার লেখনিতে বাংলাদেশের নিতান্ত সাধারণ নর-নারীর মলিন ও তুচ্ছ জীবনকেই উপাদান হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তাতে বঙ্কিম বা রবীন্দ্রনাথের কল্পোলোকচারী প্রেম বা রোমান্সের বিপুল ঐশ্বর্য নেই বললেই চলে। চরিত্রগুলোতেও বাইরের দিক থেকে কোন অভিনবত্বের চমক নেই, বিপুল আবেগ নেই, কোন আকাশস্পর্শী আদর্শ এবং সমাজজীবন সমন্ধে কোন মৌলিক তত্ত্ববাদের অবতারণাও তিনি করেননি। কিন্তু মানবজীবনের এমন সুখ-দুঃখ ও অশ্রু-বেদনাকে সহানুভূতির রসে জারিত করে ইতোপূর্বে আর কেউ সাহিত্য রচনা করতে পারেননি। ২.শরৎচন্দ্রের কাহিনীগুলো শুধু বাস্তবজীবন আশ্রিত বলেই এত জনপ্রিয়তা পায়নি। রমেশ চন্দ্র দত্ত ও তারকানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বাস্তব আশ্রিত জীবনের কাহিনী লিখেছেন কিন্তু তার আকর্ষণ এত দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পক্ষান্তরে শরৎচন্দ্র বাস্তবজীবনকে গ্রহণ করে অতি বিচিত্র কৌশলে তার সঙ্গে রোমান্সের অদ্ভুত মিল ঘটিয়েছন। ফলে তার রচনাগুলো রহস্য গল্পের মতো নেশায় আসক্ত করে। ৩.শরৎচন্দ্র তার রচনার চরিত্রগুলো সাধারণ স্তর থেকে গ্রহণ করেছেন কিন্তু সেসব চরিত্র লেখকের হাতে বিস্ময়করভাবে অসাধারণ রূপ লাভ করেছে। তবে সে বিস্ময় সূক্ষ্মভাবে বাস্তবের সঙ্গে মিশে আছে বলে তাতে প্রভাত কুমারের গল্পের মতো বাস্তব প্রতীতি খ-ন হয় না; বরং বাস্তবের সঙ্গে রোমান্সের অপরিমেয় রহস্য কিঞ্চিত জড়িয়ে থাকার জন্য পাঠক তার প্রতি প্রবল আকর্ষণ অনুভব করে। ৪.শরৎচন্দ্র অত্যন্ত সহানুভূতি ও আবেগের সঙ্গে সাধারণ মানুষের দুঃখের মধ্যে নেমে গিয়ে তাকে আপন করে নিয়েছেন। মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখ নিজের দোষে, সমাজের চাপে কিংবা সংস্কারের চাপেই আসুকÑ তাকে তিনি সহানুভূতি ও আবেগের সঙ্গে এমন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যে, পাঠক পড়তে পড়তে সেই চরিত্রগুলোর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। কখনো বা সেই দীন-দরিদ্র দুঃখ ভাবাতুর ছায়ামূর্তিগুলোকে নিজের পাশেই উপলব্ধি করতে পারে। তাই তার চরিত্রগুলো দুঃখ-লাঞ্চনা ও রিক্ততার দ্বারাই পাঠকচিত্তে আপন অধিকার স্থাপন করে। ৫.শরৎচন্দ্রের সবচেয়ে বড় গুণ তিনি বড়কে বড় করে দেখেননি। সমাজের অখ্যাত অবহেলিত নর-নারীগুলোর বিবর্ণ চরিত্রের মধ্যে এমন দু-একটি বৈশিষ্ট্যের ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, নিতান্ত তুচ্ছ সাধারণ ব্যক্তিও অসাধারণ হয়ে উঠেছে। যেমন তিনি চরিত্রহীনকে আত্মত্যাগে পরিশুদ্ধ করেছেন, লম্পটকে বেদনা সমুদ্রে ¯œাত করিয়ে তাকে মনুষ্যত্বের মহিমায় উজ্জ্বল করেছেন। মদ্য আসক্তকে সহানুভূতির রসে অপূর্বতা দান করেছেন। ফলে কাহিনীতে চরিত্রগুলো পাঠকের মনে অক্ষয় আসন অধিকার করেছে। ৬.শরৎচন্দ্রের অনেক পারিবারিক উপন্যাস আছে যেখানে পরিবারের চিত্র অঙ্কিত আছে। তাতে নেই কোনো সামাজিক বাণী ঘটিত প্রশ্ন, কোন বিরাট আবেগ হাহাকার। ‘বিন্দুর ছেলে’, ‘পরিণীতা’, ‘প-িত মশাই’, ‘মেজদিদি’, ‘পল্লীসমাজ’, ‘বৈকুণ্ঠের উইল’, ‘নিস্কৃতি’, ‘অরক্ষণীয়া’ এ রচনাগুলোর কাহিনী বাংলাদেশের পরিচিত ঘটনা। সামান্য ভুল বোঝাবুঝি, ঈষৎ মান-অভিমান, মনো-মালিন্যতা, একটু অশ্রু বিসর্জনের পর সে মেঘ কেটে গেলে সংসার যেমন চলছিল তেমনি চলতে লাগল। এই ধরনের ঘরোয়া কাহিনীগুলো রচনার সহজ প্রসন্নতায় এবং সহানুভূতির রসে আর্দ্র হয়ে একেবারে পাঠকচিত্তের অন্তঃপুরে গিয়ে আশ্রয় লাভ করে। আসলে প্রগতিবাদী নতুনের দল শরৎচন্দ্রের ভিতরে এমিলজোলা, ওয়াল্ট হুইটম্যান, দস্তয়ভস্কির প্রতিফলন দেখেছিলেন। বড়দিদি, বিরাজ বৌ, শ্রীকান্ত, দেবদাস, গৃহদাহ, দেনা-পাওনা, শেষ প্রশ্ন প্রভৃতি উপন্যাস পড়ে পাঠকসমাজ যেমন কেঁদেছে তেমনি সমাজের তথাকথিত চরিত্র নীতি, সতীত্ব, সংযম প্রভৃতি গতানুগতিক আদর্শ উড়িয়ে দিয়ে সমাজের অনাচার ও অবিচারের রথচক্র তলে পিষ্ঠ মানব-মানবীর মর্মন্তুদ কাহিনী লিখে সমাজের শিষ্ট ও শিক্ষিত স্তরে প্রচ- আঘাত দিয়েছেন। কেননা বাস্তব কাহিনীকে অবলম্বন করে শিল্পরস পরিবেশন করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। তাই তিনি হুইটম্যান, দস্তয়ভস্কির মতো মানবসমাজের কাছে খেটে খাওয়া মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা, নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়েছেন। ফলশ্রুতিতে তার রচনাগুলো পাঠক-হৃদয়ে দীর্ঘস্থায়ী আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। শরৎচন্দ্রের পর্যবেক্ষণের নিবিড়তা, বিশ্লেষণের পুক্সক্ষাণুপুক্সক্ষতা, বর্ণনায় বাস্তবতা সর্বজন বিদিত। এ প্রসঙ্গে ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘বাস্তবতা নির্ভর জীবন-রহস্য বিশ্লেষণে ও জীবন্ত চরিত্র সৃষ্টিতে শরৎচন্দ্রের কৃতিত্ব বঙ্কিমের চাইতেও বেশি।’ নিজের রচনা সম্পর্কে শরৎচন্দ্রের অভিমত, ‘নিজের জীবনটাকে নীরবে দগ্ধ করে যে অভিজ্ঞতা বাস্তব থেকে আহার করেছে, এখন মনে হয় আমার সাহিত্যেও সেটাই ফুটে উঠেছে বারংবার।...আর একটা কৃত্রিম সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত বলেই বোধ হয় এত সহজে ছোট-বড় সবার কাছে আবেদন পেয়েছে।’ পরিশেষে বলা যায়, সাহিত্যে ‘ঞৎঁব ংঃৎঁপঃঁৎব ড়ভ ঃযরহমং’ Ñএর সঙ্গে সম্পর্কিত। সত্যের সাথে সাহিত্যের সম্পর্ক অতি নিবিড়। দেশজ মাটি ও মানুষের রসে সিঞ্চিত নিশ্চিত উপাদানই সাহিত্যের খাঁটি উপাদান। নিজস্ব সময় ও নিজ শিকড়ে নিরঙ্কুশ প্রতিষ্ঠা থাকলে তবেই সে সাহিত্য গভীর সঙ্কীর্ণতা থেকে মুক্ত হয়ে সার্বজনীনতা লাভ করে। শরৎ-সাহিত্যের জনপ্রিয়তার মূলে রয়েছে এই সত্য।
×