ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ জাভেদ হাকিম

নদী আর গহীন অরণ্যের পথ সুন্দরবন

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৭

নদী আর গহীন অরণ্যের পথ সুন্দরবন

ডিসেম্বর থেকে মার্চ। এই চার মাস হলো বিশ্বের বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন ভ্রমণের সুবর্ণ সময়। ভ্রমণের প্রধান স্থান নির্ধারণ করা হলো সুন্দরবনের অহঙ্কার হিরণ পয়েন্ট। দলে আমরা দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের নয় বন্ধু। ভ্রমণে সার্বিক সহযোগিতা করলেন মংলা পৌর সভার কাউন্সিলর। রাতে গাড়িতে চড়ে খুব ভোরে মংলা ঘাটে পৌঁছাই। ফজরের নামাজ পড়েই জালি বোটে উঠি। কাউন্সিলরের মাধ্যমে জনসংখ্যা অনুযায়ী কাঁচা বাজার, ওষুধ, ফল ও মিনারেল পানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা ছিল। জোয়ারের সঙ্গে সঙ্গে বোট হিরণ পয়েন্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। সে কি আনন্দ বলে বুঝানো সম্ভব নয়। একটা সময় এলো সেল ফোনের নেটওয়ার্কের বাইরে চলে এলাম। পশুর নদীর উপর দিয়ে চলছি, চারদিকে অথৈ পানি, দূর থেকে সুন্দরী গাছগুলো যেন আমাদের স্বাগত জানায়। পশুর, সিবশা ও হংসরাজ এই তিন নদীর পানি একটি হতে আরেকটি উঁচু এবং তা স্পষ্ট দৃশ্যমান। পশুর নদীর পানি স্বচ্ছ এবং হংসরাজ নদীর পানি ঘোলা, সত্যিই সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমা। বোট ভেসে চলছে, সকাল পেড়িয়ে দুপুর। কিন্তু এখনও পর্যন্ত বাঘ, হরিণ, কুমির তো দূরের কথা একটি গাংচিলের দেখাও মিলল না। দুরবীন নিয়ে যারা ব্যস্ত আছে, তারাও হতাশ। হঠাৎ একজন সঙ্গীর চিৎকার- পেয়েছি পেয়েছি! আরে বেটা কি পেয়েছিস বল! ওর বলার আগেই আমরা সবাই খালি চোখেই দেখতে পাই এক পাল হরিণ পড়ন্ত বিকেলে নরম ঘাসের বুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আনন্দে সবাই আত্মহারা। ধীরে ধীরে আমাদের চোখে ধরা পড়তে লাগল গাংচিল, বক, অচেনা পাখিসহ জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য। বোট হতেই দেখে নিলাম সুবুজে ঘেরা উলির চড়। প্রায় সন্ধ্যার সময় স্বপ্নের সেই হিরণ পয়েন্টের পল্টুনে এসে পৌঁছাই। সরকারী রেস্ট হাউসে উঠে আমাদের মনে হলো আমরা যেন কিছু একটা জয় করে বীরের বেশে এখানে এসেছি। মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণও ছিল। আমরা ছাড়া আর কোন ট্যুরিস্ট তিন তলার বিশাল রেস্ট হাউসে ছিল না। সম্ভবত দুর্গম পথ ও বাঘের পদচারণা বেশি হওয়ায় এখানে পর্যটক আসার খুব একটা ঝুঁকি নেয় না। সেদিক থেকে আমরা একটু ব্যতিক্রম। যেখানে ভয় সেখানেই আমাদের ভ্রমণের জয়। মংলা হতে হিরণ পয়েন্টের দূরত্ব প্রায় ৮০ কিমি.। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ লোনা বন। হিরণ পয়েন্ট সুন্দরবনের দক্ষিণাংশের একটি সংরক্ষিত অভয়ারণ্য। এর আরেক নাম নীল কমল। প্রমত্তা কুঙ্গা নদীর পশ্চিম তীরে, খুলনা রেঞ্চ এর অবস্থান। হিরণ পয়েন্ট ইউনেস্কো ঘোষিত অন্যতম একটি বিশ্ব ঐতিহ্য। ভারত ও বাংলাদেশ জুড়ে রয়েছে সুন্দরবনের বিস্তৃতি। সুন্দর বনের মোট আয়তনের প্রায় ৬২ শতাংশ বাংলাদেশে এবং বাকি অংশ ভারতে। এই বন বাংলাদেশের আয়তনের প্রায় ৪.২ ভাগ এবং সমগ্র বনভূমির প্রায় ৪৪ ভাগ। এর মোট আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গকিমি বা ৬,০১,৭০০ হেক্টর। এর মধ্যে স্থল ভাগের পরিমাণ ৪ হাজার ১৪৩ বর্গকিমি. এবং জলভাগের পরিমাণ ১ হাজার ৮৭৪ বর্গকিমি.। হিরণ পয়েন্ট একটি অভয়ারণ্য হওয়ায় এখানে অনেক বাঘ, হরিণ, বানর, পাখি এবং সরিসৃপের নিরাপদ আবাসস্থল। সুন্দরবন এলাকায় রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখার অন্যতম স্থান হলো এই হিরণ পয়েন্ট। হিরণ পয়েন্টে অবস্থানের রাতটি ছিল ভরা পূর্ণিমা। পূর্ণিমা চাঁদের আলোতে মিঠা পানির পুকুরের পাশে বারবিকিউর আয়োজন হলো। সেদিন জোৎনা রাত না হলে হয়তো রাতটা সাদামাঠাই কেটে যেত। রেস্ট হাউসের কর্মকর্তাদের সতর্কবাণী বেশি রাত পর্যন্ত রুমের বাইরে থাকবেন না, যে কোন সময় মামা চলে আসতে পারে। ওখানকার লোকেরা বাঘকে মামা বলে। অনেক রাত পর্যন্ত ছাদে অবস্থান করি, মামাকে শুভেচ্ছা জানাব। মামা (বাঘ) এল না, সম্ভবত অভিমান করেছিল এত ভাগ্নে একত্রে থাকাতে! বাঘ দেখতে না পাওয়ার হতাশা আমাদের কাটিয়ে দিয়েছিল জোৎনা রাতের আলো। সুন্দর বনের গভীরে মেঘ কিংবা কুয়াশা বিহীন পূর্ণিমা চাঁদ চোখের ফ্রেমে এঁটে থাকা এক অপরূপ ফটো হয়ে থাকবে দীর্ঘকাল। ভ্রমণকালীন দে-ছুটের সব বন্ধুরা পাঠ্য বইয়ের সেই দুটি লাইন ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’ পুরো সুন্দরবন ভ্রমণে এই বাক্যটি মনে রেখেছিলাম। হিরণ পয়েন্ট থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরেই কেওড়া সুঠি। এখানে না গেলে যেন ভ্রমণের অপূর্ণতাই থেকে যেত। আমাদের সঙ্গে দুই ফরেস্ট অফিসার। বনের ভেতর কাঠের পাটাতনের ব্রিজ এরপর অনেক দূর পর্যন্ত মাটির বাঁধানো রাস্তা। আরও রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। কেওড়া সুঠিতে দলে দলে হরিণের পাল ছুটাছুটি করে। আমরা আনন্দে আপ্লুুত হই। হিরণ পয়েন্ট অভয়ারণ্য হওয়ায় এখানে বাঘ, হরিণ, বানর, পাখি, এবং সরিসৃপসহ বহু জীব বৈচিত্রের নিরাপদ আবাসস্থল। সুন্দরবন এলাকার অন্যতম সৌন্দর্য রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখারও অন্যতম স্থান হলো এই হিরণ পয়েন্ট/নীল কমল। পাখিদের মধ্যে আছে ধবল বক, মাছরাঙা, হলুদ বুকের মাছরাঙা, কালো মাথা মাছরাঙা, লার্জ এগ্রেট, কাঁদা খোঁচা, ধ্যানী বকসহ আছে অসংখ্য পাখির আবাস। এছাড়া রয়েছে প্রচুর কাঁকড়ার বিচরণ। বনের খানিকটা ভেতরে ঘুরা ঘুরির সময় হঠাৎ দেখতে পাই বাঘের পায়ের চিহ্ন, কিঞ্চিৎ ভয় কিন্তু বাঘ মামাকে দেখার বাসনাই যেন বেশি। ফরেস্ট কর্মকর্তাগণ বললেন পায়ের চিহ্নে বুঝা যায় মামা (বাঘ) সম্ভবত ২/৩ ঘণ্টা পূর্বে এখানে এসেছিল। সুতরাং আপনারা আর বেশি দূর এগুবেন না এবং দল বেঁধে থাকবেন। কে শুনে কার বাণী, যে যার মত করে বাঘের সাক্ষাত পাওয়ায় ব্যস্ত। অবশেষে বাঘের পায়ের চিহ্নের স্মৃতি নিয়েই ফিরতে হলো সেখান থেকে। এবার যাচ্ছি দুবলার চড়ের আলোর কুল। বোট হতেই দেখতে পেলাম সিডরের ভয়াবহতা। সুন্দরবনের দেহে এখনও সিডরের আঘাতের দাগ মুছে নাই। আলোর কুল পৌঁছে দেখলাম বাহারি মাছের শুঁটকি। জেলেরা আমাদের টাটকা চিংড়ি উপহার দিলো। ওদের নিঃস্বার্থ উপহার আমাদের জন্য শিক্ষণীয় হয়ে রইল। আলোর কূল ঘুরে এখন চলছি দুবলার চড়ের একাংশ মেহের আলি চড়ে। মেহের আলি চড় পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান। পর্যাপ্ত হরিণ দেখে মনে হয় যেন গৃহপালিত। সেই সঙ্গে প্রচুর বানরের চেচামেচি। চড়ের একপাশে বঙ্গোপসাগর আর অন্যপাশে নোনা জলের পশুর নদী। সুন্দরী গাছের চেয়ে গোলপাতা, ম্যানগ্রোভ আর কেওড়া গাছের ছড়াছড়ি। ইচ্ছে করলে জেলেদের কাছে থেকে বিনামূল্যে সাগরের মাছ নিয়ে রেধে খেতে পারেন। এই চড়ে ঘুর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র আছে। দুর্ভাগ্য ঘটনাক্রমে আমাদের সেখানে রাতে আশ্রয় হলো না। অগত্যা পালা বদল করে জালি বোটেই ঘুমাতে হলো। শহরের ধনীর দুলালদের জালি বোটের পাটাতনে ঘুমানোর অভিজ্ঞতা হলো। সেও বা কম কিসের, ভ্রমণের অজ্ঞিতার ঝুলি একধাপ সমৃদ্ধ হলো। শেষ রাতে জোয়ারের সঙ্গে সঙ্গে জালি বোট স্টার্ট নিল। প্রচ- শব্দে ঘুম ভাঙ্গল সবার। আলো আঁধারির মাঝে উপভোগ করলাম এক অন্যরকম সকাল। বোট চলছে মংলার উদ্দেশে মাঝে তিন জায়গায় বিরতি নিয়ে কিছুটা সময় ঘুরা হলো। প্রথমে হারবারীয়া, এর ভেতরটা বন বিভাগ দ্বারা সাজানো গোছানো, ২য় বার জয়মনি ঘোল গ্রাম, খুবই সুন্দর। মনে হয় শিল্পীর তুলিতে আঁকা কোন ছবি। বোট হতেই দেখা হলো বদ্রা। এ জায়গাটায় কুমিরের বেশ উপদ্রব রয়েছে। সময় নিয়ে অবস্থান করলে নোনা জলের কুমিরের দেখা মিলে। তৃতীয় স্পট করম জল, সেখানে রয়েছে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। উপর থেকে সুন্দরী গাছ দিয়ে ভরপুর, সুন্দরবনের রূপ দেখা যায়। সুন্দরী গাছের আধিক্যের কারণেই হয়তো এই বনের নাম সুন্দরবন রাখা হয়েছে। ম্যানগ্রোভ এই বনকে নিয়ে আমরা বিশ্বের ভ্রমণ পিয়াসীদের কাছে গর্ব করতে পারি নিঃসন্দেহে। যোগাযোগ ঃ- ঢাকা হতে মংলা বিভিন্ন পরিবহনের বাস দিনে রাতে ছেড়ে যায় সায়েদাবাদ ও গাবতলী হতে। কতজন ও কত দিন ভ্রমণের উপর নির্ভর করে প্রয়োজনীয় খাবার, কাঁথা, বালিশ, টর্চলাইট, খাবার স্যালাইন, ওষুধ এবং পর্যান্ত পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি নিতে হবে। সর্বোপরি বন বিভাগের অনুমতি নিতে হবে। ট্রলার ভাড়া চারদিনের জন্য বার হাজার হতে পনেরো হাজার টাকা। বাবুর্চি হিসাবে নৌকার মাঝি-মালারাই যথেষ্ট। সতর্কীকরণ ঃ ‘দে-ছুট’ দলের মত যদি আপনাদের সুন্দরবনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন কর্মকর্তার সঙ্গে পূর্ব পরিচয় না থাকে তাহলে বিভিন্ন ট্যুর অপারেটর আছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ম্যানগ্রোভ বনসুন্দর বনের হিরণ পয়েন্ট [নীল কমল] যেতে পারেন।
×