ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

আশাফা সেলিম

মোনাজাতউদ্দিন ॥ শিকড়সন্ধানী এক সাংবাদিক

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৭

মোনাজাতউদ্দিন ॥ শিকড়সন্ধানী এক সাংবাদিক

জনগুরুত্বপূর্ণ কোন সংবাদ বা খবর চোখে পড়লে প্রথমেই মনে পড়ে মোনাজাত ভাইয়ের (চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন) কথা। কারণ, মোনাজাত ভাই ছিলেন খবরের পেছনের খবর তৈরির এক নিপুণ কারিগর। যে সংবাদ জনমনে আগ্রহের সৃষ্টি করে, পাঠকের মন সেই সংবাদটি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে উৎসুক হয়ে ওঠে। পাঠক জানতে চায় ঘটনার নেপথ্যের ঘটনা বা কারণ বা সেই সব তথ্য যার কারণে ঘটনাটির সূত্রপাত। আর এসব তথ্য বা সংবাদই নেপথ্য সংবাদ বা শিকড় সংবাদ। মোনাজাত ভাই এই ‘নেপথ্য সংবাদ’ আর ‘শিকড় সংবাদ’ শব্দ দুটিকে পাঠকের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও অনিবার্য করে তুলেছিলেন। এ বিষয়ে তিনি একটি বইও লিখেছেন যার নাম ‘সংবাদ নেপথ্য’। মোনাজাত ভাইকে নিয়ে এর আগে কখনই লেখা হয়নি। ১৯৯৫-এর ২৯ ডিসেম্বর মোনাজাত ভাইয়ের অকালমৃত্যুর পর থেকে আজ পর্যন্ত লিখলে, অন্তত ২২টি লেখা হতো। প্রতিবার তার মৃত্যুদিবস আসার কদিন আগে থেকেই মনে হতে থাকে, এবার কিছু একটা লিখব। বহুবার তার বিভিন্ন দিক নিয়ে বহু লেখার বিষয় ঠিক করে বা ভূমিকা লিখে আবার রেখে দিয়েছি, শেষ করিনি। লিখিনি কারণ- যখনই লিখতে গেছি, মনে হয়েছে, সংবাদপত্র জগতে মোনাজাতউদ্দিন এত বড় যে, মহীরুহের মতো এত উঁচু মাপের মানুষ সম্পর্কে আমার মতো কেউ লিখলে, তাঁকে আর বড় করা যায় না। বরং নিজে বড় হওয়া যায়। এবারই প্রথম তাকে নিয়ে লিখছি। প্রায় ৬ বছর (১৯৯০-৯৫) মোনাজাত ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল; যা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে স্বর্ণালি সময়। তার সান্নিধ্যে থাকার সুবাদে দেখেছি, সংবাদ সংগ্রহ ও প্রকাশের ব্যাপারে তিনি কত ভিন্ন মাত্রার তীক্ষè দৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন। তিনি ছিলেন সৃজনশীল এক ভীষণ সাবধানী মানুষ। কোন একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিংবা প্রকাশের পূর্বেই তথ্যটি পেলে মোনাজাত ভাই ব্যস্ত হয়ে উঠতেন ঘটনার নেপথ্যের কারণ অনুসন্ধানে। কী কারণে ঘটনাটি ঘটল? পেছনের কারণগুলো কী ছিল? খবরের শিকড় অনুসন্ধানটি ছিল তার রক্তে মেশা নেশার মতো। অনুসন্ধানকৃত তথ্য সংবলিত ফলোআপ রিপোর্টটি যখন ছাপা হয়, তখন তাকে অনুসন্ধানী রিপোর্টও বলা হয়। হয়ত ছাপা হলো ‘রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নার্সরা ১০ দফা দাবিতে ধর্মঘটে নেমেছেন।’ নিউজটির ভেতরে হয়ত সাধারণ কারণগুলো রয়েছে। আছে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াস্বরূপ রোগীদের দুর্ভোগের কথাও। কিন্তু এই সংবাদের পেছনের সুরঙ্গ দিয়ে ঢুকলে হয়ত ধীরে ধীরে উন্মোচিত হবে রহস্যের জাল। বেরিয়ে আসবে সংবাদ সৃষ্টির পেছনের অনেক অজানা তথ্য। যা থেকে মানুষ খুঁজে পাবে ঘটনার পেছনের ঘটনা। রাষ্ট্র খুঁজে পাবে সমস্যা সমাধানের পথ। মোনাজাতউদ্দিনের আগ্রহটা বেশি ছিল অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা অজানা তথ্যকে আলোয় নিয়ে আসার প্রতি। খবরের পেছনের সেই সব খবরকে যে নামেই ডাকা হোক, এই ক্ষেত্রে মোনাজাতউদ্দিন আধুনিক ধারার পথিকৃৎ। নিজের জীবন দিয়েই তিনি তা প্রমাণ করে গেছেন। ‘দৈনিক সংবাদ’ ছেড়ে, ‘দৈনিক জনকণ্ঠে’ যোগ দেয়ার বছরই তিনি যমুনা নদীর কালাসোনার চরে ট্যাঙ্কলরির তেল চুরির ওপর মাফিয়া চক্রের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী সিরিজ প্রতিবেদন করছিলেন। এ সময় কর্মরত অবস্থায় তিনি যেভাবে প্রাণ দিয়েছেন, আমার মতে তাকে শহীদ সংবাদিকের মর্যাদা দেয়া উচিত। সরেজমিন প্রতিবেদনের ক্ষেত্রেও উজ্জ্বল নাম ‘মোনাজাতউদ্দিন’। তার পেশাগত জীবনের শুরুতে তিনি টেবিল মেড রিপোর্ট, লোকমুখে বা সহকর্মীদের মুখ থেকে শুনে রিপোর্ট অর্থাৎ ‘চিলে কান নিয়ে গেল’ জাতীয় রিপোর্ট করতে গিয়ে বিপদে পড়েছিলেন। বিব্রত হয়েছিলেন। তিনি তার একটি বইয়ে ‘দাড়িতে মৌচাক’ আর্টিকেলে এ বিষয়ে লিখেছেন। লেখাটির সারাংশ : পরিচিত কারও কাছে শুনেছেন কোন এক গ্রামে একজনের দাড়িতে মৌচাক বসেছে। তাই দেখতে উৎসুক জনতা দলে দলে ছুটে যাচ্ছে সেখানে। তথ্যটি পেয়ে, মোনাজাত ভাই স্পটে না গিয়ে, তথ্যের সত্যতা যাচাই-বাছাই না করেই ‘এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট’ হিসেবে ‘দাড়িতে মৌচাক’ শিরোনামে তার পত্রিকায় পাঠান। রিপোর্টটি গুরুত্ব সহকারে বক্স করে ছাপা হয়। এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। এ রিপোর্ট না পাঠানোয়, অন্য পত্রিকার সাংবাদিকদের নিজ নিজ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ভীষণ বকাঝকা খেতে ও জবাবদিহি করতে হয়। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সেটি ছিল বানোয়াট। তথ্যদাতা তাকে বিব্রত করতেই বানানো তথ্যটি দিয়েছিলেন। এরপর থেকেই তিনি যে কোন রিপোর্টের ক্ষেত্রেই সরেজমিনের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। অর্থাৎ ঘটনাস্থল বা স্পটে না গিয়ে তিনি কোন তথ্যের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করতেন না বা সে বিষয়ে রিপোর্ট পাঠাতেন না। ঢাকার বাইরের কোন এক অবহেলিত জেলা (যাকে সে সময় ‘মফস্বল’ বলা হতো) রংপুর থেকে তিনি তার স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলেন। ধ্যান ও সাধনাক্রমে সে মাথা এতটাই উঁচু হয়েছিল যে, ‘মফস্বল সাংবাদিকতা’র সীমানা পেরিয়ে তা দেশের গ-িও ছাড়িয়েছিল। কর্ম এলাকা উত্তরাঞ্চল হলেও সংবাদ শিকারি হয়ে তিনি সারাদেশের মাঠে-ঘাটে-প্রান্তরেসহ জনপদে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আর তার পুরস্কার ও স্বীকৃতিস্বরূপ আখ্যায়িত হয়েছেন অনবদ্য এক সম্মানজনক অভিধায়- ‘চারণ সাংবাদিক’। এই উপাধি বাংলাদেশে একমাত্র তিনিই অর্জন করেছেন। মোনাজাত ভাই তার প্রায় চার দশকের সাংবাদিকতার জীবনে অনবদ্য নিরলস নিষ্ঠা ও নিরন্তর চেষ্টায় এ দেশের সংবাদপত্র জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে উঠেছিলেন। এতটাই উজ্জ্বল যে, তার সে আলোয় আজ ও আগামীকালের সংবাদকর্মীদের আলোকিত না হয়ে উপায় নেই। লেখক : সংস্কৃতিকর্মী ও উন্নয়নকর্মী
×