জাতীয় পর্যায়ে শিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি শিশু অধিকার ফোরামের পর্যবেক্ষণে চলতি বছরে শিশু পরিস্থিতির যে চিত্র উঠে এসেছে তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ফোরামটির তথ্য মতে, চলতি বছর ১১ মাসে (জানুয়ারি থেকে নবেম্বর) নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৩ হাজার ২৮৬ জন শিশু। হত্যা করা হয়েছে ২৮৮ শিশুকে। ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৫৮৯ জন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়। হত্যার শিকার হয় ২৬৫ শিশু। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য সংগৃহীত হয়েছে। এ থেকে আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, দেশে শিশু নির্যাতন ও হত্যা পরিস্থিতির বিশেষ উন্নতি ঘটেনি। শিশুদের অধিকার রক্ষায় যারা কাজ করছেন তারা মনে করেন শিশুদের ওপর নৃশংসতা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচারের সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে বলে শিশুরা নির্যাতনের শিকার হয়। অনেক ক্ষেত্রেই বিচারহীনতা এবং বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা অব্যাহত থাকায় এই নির্যাতন বাড়ছে। এছাড়া দরিদ্র শিশুদের জন্য কার্যকরভাবে সামাজিক সুরক্ষা বলয় সৃষ্টি করতে না পারায় এই ঘটনাগুলো বেড়ে চলেছে।
শিশু হত্যার কারণগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাবা-মা বা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বিরোধ এবং শত্রুতার বলি হচ্ছে শিশুরা। এছাড়া দরিদ্র শ্রমজীবী শিশুদের তুচ্ছ কারণে বা চুরির অপবাদ দিয়ে পিটিয়ে নির্যাতন করে মেরে ফেলার ঘটনা অব্যাহতভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাবা-মায়ের হাতে শিশু হত্যার ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বাবা-মায়ের মধ্যে পারিবারিক কলহ বা বিরোধ এবং পরকীয়ার সূত্র ধরে অবুঝ শিশুকে খুন করা হচ্ছে। আবার মানসিকভাবে অসুস্থ মা-বাবার হাতেও শিশু খুনের ঘটনা ঘটছে।
এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, আর্থ-সামজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে অন্যায়-অবিচার আর নির্যাতনের ধরন পাল্টাচ্ছে। ফলে আগের চেয়ে অনেক বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র শ্রেণীর শিশুরা। শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পেছনে প্রধান কারণ হলো শিশুরা দুর্বল এবং দরিদ্র শিশুদের জন্য কার্যকরভাবে সামাজিক সুরক্ষা বলয় সৃষ্টি করতে না পারা।
দেশব্যাপী শিশুদের সুরক্ষায় সরকার চালু করেছে হেল্পলাইন সেবা। বলাবাহুল্য, শুধু হেল্পলাইন চালু করাই যথেষ্ট নয়। যারা সহায়তা চেয়ে ফোন করে তারা যেন সহায়তা পায় এবং পরবর্তীতে সেবা নিতে আগ্রহী হয় সেই বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। পরিতাপের বিষয় হলো, নির্যাতন করার পরও আইনের আওতায় আসছে না অপরাধীরা। ফলে একের পর এক শিশু ধর্ষণের পৈশাচিক ঘটনা ঘটছে। আইন থাকলেও তা অনেক সময়ই উপেক্ষিত। মামলা হলেও যে চার্জশিট দেয়া হয় তাতে আইনের ফাঁকফোকর থাকে। নির্যাতিত শিশু দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত আর অপরাধীরা ক্ষমতাবান, প্রভাবশালী হওয়ায় মামলা গতি হারায়। শিশুর পক্ষে সাক্ষী-সাবুদ পাওয়া যায় না। ফলে সমাজে শিশু ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলছে। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যেমন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরী, তেমনি আইনের কঠোর প্রয়োগও কাম্য। সব পক্ষের আন্তরিক ও সক্রিয় উদ্যোগেই শিশু নিপীড়নের মতো সামাজিক ক্ষত নিরাময় করা সম্ভব।
শীর্ষ সংবাদ: