ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

হাবিবুর রহমান স্বপন

মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকান্ড ॥ এক ব্রিটিশ কর্মকর্তার পর্যবেক্ষণ

প্রকাশিত: ০৩:৩৫, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭

মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকান্ড ॥ এক ব্রিটিশ কর্মকর্তার পর্যবেক্ষণ

(গত বুধবারের পর) কয়েক মিনিট পরে ভিপি মেননের কাছ থেকে আমি জানতে পারলাম যে, হত্যাকারী হলো জনৈক মারাঠা হিন্দু। গান্ধী যখন তাঁর প্রার্থনা সভার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তখনই খুব নিকট স্থান থেকে হত্যাকারী তাঁর ওপর তিনবার গুলি নিক্ষেপ করেছে। ডাক্তার ভদ্রলোকের সঙ্গেও আমি আলাপ করলাম। গান্ধীর অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত এই ডাক্তার গান্ধীকে ওষুধ দিয়ে রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। ডাক্তার অভিযোগ করলেন বিড়লা ভবনে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র কিছুই ছিল না। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর মাত্র কয়েক মুহূর্ত গান্ধী বেঁচে ছিলেন। সামান্য একটু জল পান করতে পেরেছিলেন গান্ধী এবং তার পরেই চেতনা হারিয়ে ফেললেন। সে চেতনা আর ফিরে এলো না। গান্ধীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্বন্ধে ব্যবস্থার কথা নিয়ে অনেক কথা উঠল এবং আলোচনা হলো। প্যারেলাল বললেন- গান্ধীর মরদেহ কোন রকম রাসায়নিক ব্যবস্থার দ্বারা দর্শনীয় বস্তুর মতো রক্ষা করা উচিত হবে না কারণ স্বয়ং গান্ধীই এ কাজ করতে ¯পষ্টভাবে নিষেধ করে গেছেন। গান্ধী পূর্বেই তাঁর এ ইচ্ছা ঘোষণা করে দিয়েছিলেন যে, মৃত্যুর পর তাঁর দেহ যেন বিশুদ্ধ হিন্দু প্রথা অনুযায়ী দাহ করা হয়। মহাত্মাকে শেষবারের মতো দেখার জন্য বিড়লা ভবনের ওপর এই সন্ধ্যাতেই জনতার অভিযান প্রবল হয়ে উঠতে দেখে আমি চিন্তিত হয়ে পড়লাম। জানালাগুলো জনতার চাপ সহ্য করতে না পেরে ভেঙ্গে পড়বে বলেই মনে হচ্ছে, নেহরুকে এই আশঙ্কার কথাও বললাম। নেহরুর সে বিষণ্ন ও বেদনাপীড়িত মূর্তির করুণতা বর্ণনা করা যায় না। অবসন্ন ও ক্লান্ত স্বরে তিনি আমার সঙ্গে কথা বললেন। কিন্তু বিস্মিত হয়ে দেখলাম এই অবস্থার মধ্যেও তিনি কিভাবে নিজেকে সংযত করে রেখেছেন। একটি উদ্বেগের ভার আমাদের চিন্তা থেকে নেমে গিয়েছে কারণ হত্যাকারীর নাম ও পরিচয় জানতে পেরেছি। হত্যাকা-ের পর অল্পক্ষণের মধ্যেই এই তথ্য অতি দ্রুত ঘোষণা করে দেয়া হয়েছে যে, হত্যাকারী হলো হিন্দু মহাসভার জনৈক মারাঠা সদস্য, নাম নাথুরাম গড্সে। আজ আবার বিড়লা ভবনের সম্মুখে আমরা উপস্থিত হলাম। গত রাতের জনতার তুলনায় অনেক বড় এক জনতার চাপে আমাদের পথ পাওয়া দুরূহ হয়ে উঠল। দেখলাম, মহাত্মার শবাধার ফুল ও কংগ্রেস পতাকায় আবৃত করা হয়েছে। একটি গাড়ির ওপর শবাধার রাখা হয়েছে। একদল ভারতীয় নৌ-সেনা গাড়ি ঠেলে নিয়ে চলল। গবর্নর জেনারেলের বডিগার্ড দল চলল আগে আগে। সঙ্গে সঙ্গে শাবানুগামী জনতা যার মধ্যে মন্ত্রী ও সেনাপতির দল ভারতের দীনতম সাধারণ মানুষের সঙ্গে ঠেলাঠেলি করে জায়গা নেয়ার চেষ্টা করছেন যাতে মহাত্মার মুখ আর একবার ভাল করে দেখে নেয়া যায়। ভারতীয় মহাত্মার শবাধারের সঙ্গে, সম্মুখে ও পেছনে চলেছে সৈনিকের দল। তা ছাড়া গান্ধীরই বহু সংগ্রামে যে সৈন্যদল তাঁর সঙ্গে চিরকাল কাজ করেছে, সেই ‘চার-আনা’ কংগ্রেসীও হাজারে হাজারে চলেছেন। গান্ধীর নিরাপত্তার জন্য প্যাটেলই সরকারীভাবে দায়ী। এটা অবশ্য সত্য যে, দশ দিন আগে প্রার্থনা সভায় বোমা বিস্ফোরিত হওয়ার পরেও গান্ধী নিজেই বিশেষভাবে এবং সুস্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, তাঁকে রক্ষা করার জন্য কোন পুলিশ নিযুক্ত করতে হবে না। কিন্তু এটাও স্পষ্ট করেই বোঝা যাচ্ছে যে, দশদিন আগের বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা লক্ষ্য করেও পুলিশ এই দশ দিনের মধ্যে অপরাধীদের সন্ধান করে ধরে ফেলতে পারেনি। নেতাদের মধ্যে প্যাটেলের সঙ্গেই গান্ধীর শেষ দেখা ও আলাপ হয়েছে। সেদিন অপরাহ্ণে প্যাটেলেরই সঙ্গে কথা বলতে বলতে কয়েক মিনিট দেরি হয়ে গিয়েছিল গান্ধীর। প্যাটেলকে বিদায় দিয়ে তাড়াতাড়ি প্রার্থনা সভার কাছে যেই মাত্র এগিয়ে এলেন গান্ধী, তখনই হত্যাকারী তাঁর পথরোধ করে দাঁড়াল। সুতরাং এটা খুবই স্বাভাবিক যে, এ ঘটনায় প্যাটেলেরই মন সব চেয়ে বেশি যন্ত্রণায় পরে যাচ্ছে। গান্ধীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য নানা রকম উদ্যোগে, ব্যবস্থায় ও আয়োজনে মাউন্টব্যাটেন এবং নেহরু তবুও ঘুরে ফিরে কাজ করতে পারছেন; কিন্তু প্যাটেল যেন একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেছেন! বিড়লা ভবন থেকে রাজঘাট পর্যন্ত দীর্ঘ ছয় মাইল পথ শবাধারের সঙ্গে সঙ্গে চললেন প্যাটেল। প্যাটেলের বয়সও বাহাত্তর বছর পার হতে চলেছে এবং সেই বয়সের এক বৃদ্ধও আজ এতটা শারীরিক ক্লেশ ও কষ্ট গ্রহণ করতে চাইছেন! এগারোটা বেজে গেছে, ধীরে ধীরে গান্ধীর শবাধার এগিয়ে চলেছে। জনতার শেষ নেই। গবর্নমেন্ট হাউসের কাছে এসে আমরা এ দৃশ্য ভাল করে দেখার জন্য দরবার হলের গম্বুজের ওপর উঠে দাঁড়ালাম। দেখলাম এখান থেকে প্রায় দু’মাইল দূরে গান্ধীর শবাধার জনসমুদ্রের তরঙ্গে ধীরে ধীরে ভেসে চলেছে। আমাদের সম্মুখের এই সুদীর্ঘ ও সুপ্রশস্ত সড়কের নাম কিংসওয়ে। এই ‘রাজার সড়ক’ ধরে চলে যাচ্ছেন সেই গান্ধী, যিনি সত্যিই রাজা ছিলেন না। যাচ্ছেন সেই গান্ধী, যিনি এই পথ থেকে ব্রিটিশরাজকে সরিয়ে দিয়েছেন। ব্রিটিশরাজকে অপসারিত করে স্বরাজ প্রতিষ্ঠার জন্য যিনি সব চেয়ে বেশি চেষ্টা করেছেন, সেই মানুষটাই এই রাজার সড়কে শেষ দর্শন দিয়ে চলে যাচ্ছেন। সেই মানুষটিই আজ তাঁর মুত্যুতে যে বিরাট শ্রদ্ধার ঐশ্বর্য তাঁর সঙ্গে নিয়ে চলেছেন সে শ্রদ্ধা এই রাজার সড়কে ভ্রমণকারী কোন ভাইসরয়ের স্বপ্নেরও অগোচর ছিল। যমুনার ঘাটে পৌঁছলাম। গবর্নর-জেনারেলের সঙ্গে সব সমেত আমরা বিশজন এগিয়ে চললাম। আমাদের পেছনে পাঁচ লাখ লোকের ভিড়। একটি ক্ষুদ্র ইটনির্মিত বেদিকার ওপর কাষ্ঠখ-ে সজ্জিত চিতার কাছাকাছি গিয়ে আমরা দাঁড়ালাম। পেছন থেকে পাঁচ লাখ লোকের ভিড় আমাদের ওপর প্রপাতের মতো এসে পড়ছে। চিতামঞ্চে অগ্নিশিখা দেখা দিল। সঙ্গে সঙ্গে বাতাস কাঁপিয়ে লাখ-কন্ঠে একটি বিরাট ও গম্ভীর বাণী ধ্বনিত হলো-‘গান্ধী অমর’। মাউন্টব্যাটেনের নির্দেশে আমরা সেখানেই ধুলোর উপর বসে পড়লাম। মাউন্টব্যাটেনও বসে পড়লেন। পিছনের বিরাট জনতাকে থামিয়ে রাখার অথবা বসিয়ে দেয়ার জন্যই মাউন্টব্যাটেন এই কাজটি করলেন। আর একটা কারণও ছিল। যদি মাউন্টব্যাটেন এবং আমরা বসে না পড়তাম তবে পেছনের জনতার সম্মুখে এগিয়ে আসার প্রবল উৎসাহের একটি ধাক্কায় আমরা জ্বলন্ত চিতার অগ্নিশিখার মধ্যে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হতাম। নয়াদিল্লী, সোমবার, ২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ : আজ বিকেলে বব স্টিমসন আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। সেদিনের প্রার্থনা সভায় বব উপস্থিত ছিলেন। হত্যাকা-ের মাত্র পঁচিশ মিনিট পরে স্টিমসন বিবিসির এক ঘটিকার প্রোগ্রামে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ প্রথম প্রচার করে সমস্ত পৃথিবীতে সাংবাদিক দ্রুততার রেকর্ড অতিক্রম করেছেন। বব বললেন যে, গান্ধীর হত্যাকারীকে যে ব্যক্তি প্রথম গিয়ে আঁকড়ে ধরেছিল তার নাম কেউ করছে না। প্রার্থনা সভায় উপস্থিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত অফিসের জনৈক কর্মচারীই হলেন এই ‘অখ্যাত হিরো’। সবচেয়ে আগে তিনিই বুঝতে পেরেছিলেন কি ভয়ানক ব্যাপার হয়ে গেল। তিনিই সবার আগে এক লাফে ওঠে এবং এগিয়ে গিয়ে হত্যাকারীকে চেপে ধরেছিলেন। বব বললেন, ঘটনার সময় কোন ব্যক্তিই সভা ছেড়ে পালিয়ে যায়নি এবং প্রতিরোধ গ্রহণের জন্য উন্মত্ত হয়েও ওঠেনি। সকলেই বৃদ্ধ মহাত্মাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। (সমাপ্ত) লেখক : সাংবাদিক
×