ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চাণৈক্য বাড়ৈ

কালো রেখার আলো

প্রকাশিত: ০৭:২৬, ১ ডিসেম্বর ২০১৭

কালো রেখার আলো

সফিউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশের চিত্রকলার জগতে প্রাতঃস্মরণীয় একটি নাম। যে কয়েকজন বিশিষ্ট শিল্পীর আবাহনে আমাদের চিত্রকলায় আধুনিকতার দেবী সমাসীন হয়েছিলেন, সফিউদ্দিন আহমেদ তাঁদের মধ্যে অন্যতম পুরোহিত। চিত্রচর্চার শুরুতেই তিনি তেলরঙে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। পাশাপাশি ছাপচিত্রের বিভিন্ন মাধ্যম বিশেষ করে উড এনগ্রেভিং, এচিং, ড্রাইপয়েন্ট প্রভৃতিও আত্মস্থ করেছিলেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। জীবনের প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৪৫ সালে তেলরঙে অসাধারণ একটি ছবি এঁকে; আর প্রায় সমসময়েই ছাপাই ছবিতে অসামান্য ঐন্দ্রজালিক নৈপুণ্যে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন উপমহাদেশীয় কলারসিকদের। সেই থেকে নিরন্তর চর্চা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, আত্ম-অতিক্রমণের বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে সফিউদ্দিন আহমেদ এখন পরিণত হয়েছেন বাংলাদেশের ছাপচিত্রের প্রবাদপুরুষে। এই আলোচনায় সফিউদ্দিন আহমেদের বিশাল চিত্রসম্ভার নিয়ে সামগ্রিক আলোচনায় না গিয়ে বরং তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য ছাপাই ছবিতে বিশেষ করে কালো রং ও রেখার ব্যবহার, বিন্যাস, গতিময়তা প্রভৃতি বিষয়ে আলোকপাতের চেষ্টা করা হয়েছে। ত্রিশের দশকের শেষ দিকে, কলকাতা গবর্নমেন্ট আর্ট স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে সফিউদ্দিন আহমেদ যেসব ছবি এঁকেছেন তার সবই বাস্তবানুগ। ছবির প্রতিটি অনুষঙ্গ আলাদাভাবে নিরীক্ষার ফল এই সময়কার কাজগুলো। অত্যন্ত ডিটেল, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আলোছায়ার কারুকাজ তাঁর প্রত্যেকটি ছবিতে রহস্যসঞ্চারী। প্রকৃতি ও মানুষের সাধারণ জীবনযাপন তাঁর তারুণ্যময়, স্বপ্নবাজ বর্ণিল চোখে বিচিত্রভাবে ধরা দিয়েছিল। আর ছন্দিত রেখায়, সাঙ্গীতিক রঙে সেগুলো শিল্পিত হয়ে উঠেছিল তাঁর ছাপাই ছবিগুলোতে। কালো রংই তিনি বেছে নিয়েছিলেন ছবির জন্য। তাঁর ছবিতে কালো আর সাদার কন্ট্রাস্ট হয়ে উঠেছিল মোহময়। কালোকে যেন তাল আর সাদাকে লয় হিসেবে বিবেচনায় এনে স্বরলিপির সরগম মেলাতে চেয়েছিলেন তিনি; চিত্রপটে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন সঙ্গীতের আবহ। পাশাপাশি গতিশীল, সর্পিল রেখাগুলো সেই সঙ্গীতেই ছন্দিত হয়ে কলারসিকের মানস সরোবরে তুলেছিল আপ্লুতির ঢেউ। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ছাপচিত্রের ওপর উচ্চশিক্ষা নিতে লন্ডনে যাবার আগ পর্যন্ত যেসব ছবি তিনি এঁকেছিলেন তাঁর প্রায় সবই সাদা আর কালোর কনট্রাস্টে। এ সময়ের ছবিতে অন্য কোনো রঙের ব্যবাহর কদাচিৎই চোখে পড়ে। তিনি বুঝি সাদা আর কালোর প্রেমকেই চিরন্তন ধরে নিয়েছিলেন তখন! রাধিকা আর কৃষ্ণের প্রেম যে অমরতা পেয়েছে তার মূলেও কি তাহলে এই সাদা আর কালো? সফিউদ্দিনের উড এনগ্রেভিং, ড্রাইপয়েন্ট আর মেটাল এনগ্রেভিংয়ের কাজগুলো দেখে মনের ভিতরে এই প্রশ্নটিই উঁকি দিয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালে দি অল ইন্ডিয়া ফাইন আর্ট এ্যান্ড ক্রাফ্টস সোসাইটির উদ্যোগে নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল কটেমপোরারী আর্ট এক্সিবিশন-এ প্রথম পুরস্কারের যে পালকটি তাঁর উষ্ণীষে শোভিত হয়েছিল, তাও এই ‘সাদা-কালো’ বিভাগে প্রথম হওয়ার সুবাদেই। যে কারণেই হোক, এই পুরস্কার তাঁকে উপমহাদেশব্যাপী পরিচিতি এনে দিয়েছিল, তাঁর প্রতি কলারসিকদের আগ্রহ বাড়িয়ে তুলেছিল বহুগুণ। সম্ভত, দীর্ঘদিন তাঁর ‘কালো’র আলোয় মুগ্ধ থাকার পেছনে এটিও একটি বড় রকমের প্রণোদনা হিসেবে কাজ করেছিল। প্রকৃপক্ষে ছাপাই ছবি এক ধরনের প্রতিলিপি। শিল্পীর মূল ছবিটি হলো খসড়া বা লে-আউট। কাঠ, লিনো, ধাতু, পাথর প্রভৃতি মাধ্যমের সাহায্য নিয়ে শিল্পী এই একটি খসড়া তথা লে-আউটের একাধিক প্রতিলিপি তৈরি করেন। এবং এই একাধিক প্রতিলিপিই হল মূল চিত্রকর্ম। এ জন্য ছাপাই ছবির রেখাগুলো শিল্পীর সরাসরি হাতের টান নয়। কর্কশ কাঠ, কঠিন ধাতু আর নীরস পাথরের সঙ্গে শিল্পীর হাতের একপ্রকার দোস্তি না হলে ছাপাই ছবির রেখাগুলোতে তাই প্রাণের সঞ্চার হয় না। যিনি প্রকৃত শিল্পী, কেবলমাত্র তিনিই পারেন কাঠ, ধাতু আর পাথরে সাথে দোস্তি পাতাতেÑ নরুন বশে আনতে; তবেই না রেখা ছাপাই চিত্রপটে সপ্রাণ হয়ে ওঠে, দ্যোদুল লতার মতো লতিয়ে ওঠে দর্শকের স্বপ্নলোকে। সফিউদ্দিন আহমেদের ছবিতে রেখাগুলো তাই এমনই সঞ্চারণশীল ছবির স্পেস জুড়ে। চল্লিশের দশকের শুরুতে তরুণ সফিউদ্দিন বেশ কয়েকটি স্কেচ করলেন সাঁওতাল পরগনার দুমকায়। মন চাইলেই ছুটে যেতেন সেখানে ছবি আঁকার জন্যে। দুমকার প্রকৃতি, সাঁওতাল জীবন, মোষের গাড়ি, আকাশচুম্বি শালের বিরান প্রান্তর দুর্নিবার হাতছানি হেনেছিল তাঁর তরুণ শিল্পীমনে। রোমাঞ্চ তখন তাঁর চোখেমুখে জাজ্বল্যমান। রোমান্টিক চোখেই তিনি দেখেছেন ময়ূরাক্ষীর বাঁক, সাঁওতাল রমণীর জল তোলা, দিন শেষে মহিষের পালসহ মৈষালের বাড়ি ফেরা, মেলায় যাত্রা, সুদীর্ঘ আঁকাশ ছোঁয়া উলম্ব শালের বন। এ সময়কার ছবিগুলো তাই খুব সহজেই মুগ্ধ করে দর্শককে। উনিশ শ পঁয়তাল্লিশে তিনি ড্রাইপয়েন্টে আঁকলেন ‘দুমকা’র শালবীথি। পথের বাঁক আঁকড়ে মহিষের দল নেমে যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী মাঠে। সুবিশাল আকাশে গলাগলি করে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি শালগাছ। মেঘহীন আকাশের কাছে তৃষ্ণার্ত জিরাফের মতো গাছগুলো বৃষ্টিকেই যেন প্রার্থনা করছে। ফসলহীন ধুধু মাঠেও তার আর্তি। চলিষ্ণু অল্পকিছু রেখায় তিনি রচনা করেছেন শালগাছের আলোকিত অংশ। আর শাল বনের ভিতর দিয়ে পথটি যে তার বাঁক ঘুরে চলে গেছে বহুদূর, দুটি মাত্র রেখায় তা বলে দিয়েছেন তিনি। একই বছরে আঁকা ‘ঘরে ফেরা’। এই ছবিতে রেখার সূক্ষ্ম বুননে শেষ বিকেলের আকাশে মেঘের মেদুর পর্দা উড়িয়ে দিয়েছেন শিল্পী। একপেয়ে তালগাছের নিচ দিয়ে ধান কাটা মাঠ পাড়ি দিয়ে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এক পাল মহিষ। অস্তগামী সূর্যের মুমূর্ষু আলোর বিপরীতে মহিষ আর রাখালের অবয়ব কালো ছায়ায় মোহময় হয়ে উঠেছে। ছেচল্লিশে আঁকা ‘সাঁওতাল রমণী’ সাদা আর কালোর এক অদ্ভুত সমীকরণ। নরুনের অদ্ভুত কারুকাজ ছোট্ট এই ছবিটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। কাঠের খুব অল্প অংশ তুলে দিয়ে উসকে দিয়েছেন দূর আকাশের আলো। সেই সুযোগে আকাশও বুঝি উঁকি দিয়ে দেখে নিল সাঁওতাল রমণীর জল তোলা। প্রচ্ছদপটের কালো রং ছাপিয়ে কাগজের সাদায় জলের স্বচ্ছ উপরিতল আর রমণীর চিক চিক খোলা পিঠের এমন ছলকে ওঠা দর্শককে অভিভূতই করে। তাঁর বিখ্যাত, বহুল পরিচিত ‘মেলার পথে’ ছবিটি পরবর্তী বছরেই তিনি উড এনগ্রেভিং পদ্ধতিতে করেন। সাদা আর কালোয় উদ্ভাসিত এমন নিখুঁত, রিয়েলিস্টি কাজ উপমহাদেশের চিত্রসম্ভারে হাতে গোনা। এ পর্যন্ত আলোচনায় যে ছবিগুলোর নাম উল্লেখ করা হয়েছে তার প্রায় সবগুলোতেই সাদার বিপরীতে নিরেট কালোর মিথস্ক্রিয়া ঘটেছে। ময়ূরাক্ষী ছবিটি সেদিক থেকে অনেকখানি ভিন্ন। এ্যাকুয়াটিন্টে এ কাজটি তিনি করেছিলেন ছেচল্লিশ সালের কোন এক সময়ে। তৎকালীন সময়ের উপমহাদেশ জুড়ে যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা, মন্বন্তর; পুরো ভারতবর্ষে যখন আন্দোলনের ঢেউ তুঙ্গে, তখন সফিউদ্দিন নিভৃতি খুঁজতে নিস্তরঙ্গ ‘ময়ূরাক্ষী’র ঝাঁ চিক চিক বালিয়াড়ি-বাঁক আঁকলেন নতুন করণকৌশলে। প্রথমে যেমন বলা হয়েছে; এই ছবিতে সাদার বিপরীতে নিরেট কালো নয়, তিন অথবা ততোধিক গ্রেড (স্তর) ব্যবহার করেছেন তিনি। দূরে কাগজ-সাদা বাঁকাজলে হাঁটু ডুবিয়ে মধ্যম গ্রেডের কালো রঙের জনা তিনেক লোক হয়তো মাছ ধরায় মগ্ন। মাঝনদীর দিকে মেঘের ছায়া গাঢ় কালো রঙে উদ্ভাসিত। বালুময় নদীতীর প্রাথমিক গ্রেডে এমনভাবে রচনা করেছেন, ভেজা বালুর ইফেক্ট যথার্থভাবেই ফুটে উঠেছে ক্যানভাসে। নদীর বাঁক ছুয়ে উঠে যাওয়া পাহাড়ের ঢাল সম্পন্ন করেছেন দুটি কালো রঙের গ্রেডে। ছবিটিকে সমান তিনটি অংশে বিভক্ত করা সম্ভব, পাহাড়ের ঢাল, তীর ও নদী। এখানে লক্ষণীয় হলো, সমান তিন অংশে কালো ও সাদার অনুপাত অনেক কাছাকাছি। করণকৌশলগত কারণেই এই ছবিতে তিনি রেখার ব্যবহার করেননি। ময়ূরাক্ষী সফিউদ্দিন আহমেদের সাদা-কালো পর্বের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য কাজ। পঞ্চাশের দশকের শুরুতেও সফিউদ্দিন আহমেদের কালো রঙের মন্ত্রমুগ্ধতা আর রোমান্টিকতার সমাচ্ছন্নতা কাটেনি। উনিশশো ছাপ্পান্নতে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে লন্ডন যাওয়ার ফলে তাঁর চিত্রভাবনায় নতুন মাত্রা যুক্ত হলো। ক্যানভাস ছাপিয়ে গেল বিচিত্র রঙে। বিষয়বস্তুর পুঙ্খানুপুঙ্খ উপস্থাপনে তিনি আর সন্তুষ্ট থাকলেন না। মৌচাক নয়, যেন অন্তর্লীন মধুই তিনি আরাধ্য করে নিলেন। ষাটের দশকের প্রাক্কালে তাঁর ছবিতে ঠাঁই করে নিল আধা-বিমূর্ততা। তাঁর এই সময়ে আঁকা নেমে ‘যাওয়া বান’, ‘বিক্ষুব্ধ মাছ’, ‘নীল জল’, ‘ভাসমান জাল’, ‘মাছ ধরার সময়’, ‘হলুদ জাল’ প্রভৃতি ছবিতে নিরীক্ষালব্ধ চৈতন্যমগ্নতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে অত্যন্ত সার্থকভাবে। উল্লিখিত সব ছবিতেই বর্ণিল ক্যানভাসে কালো রঙের প্রাধান্য লক্ষ্য করার মতো। নেমে যাওয়া বান ছবিটি এ পর্বের একটি উল্লেখযোগ্য কাজ। এই ছবিতে ইতস্তত তিনটি নৌকার ছবি দেখে যে কারও মন হু হু করে ওঠে। নৌকা তিনটিকে তিনি সমাশক্তি আরোপ করেছেন; যেন, বন্যা নেমে যাওয়ার পরও তাতে একরাশ হতাশা আর রিক্ততা ভর করে আছে। সফটগ্রাউন্ড মাধ্যমে করা ছবিটিতে হালকা কমলা রঙের বিপরীতে লেপ্টে থাকা নীল বেদনার নীলচে কালো যেকোনো দর্শকের মনেই অভিঘাত সৃষ্টি করবে। বিক্ষুব্ধ মাছ সফিউদ্দিন আহমেদের গীতল বর্ণবিন্যাসের অনন্য দৃষ্টান্ত। তিনি মাছের কাঠামো এঁকেছেন কালো রঙের চওড়া রেখায়। ভেতরে কমলার প্রমিত প্রলেপের ওপরে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন মাছের অন্তর্গঠন। এখানেও তিনি সাহায্য নিয়েছেন কালো রঙের। মাছের ভঙ্গিমা, চোখের তারায় বিক্ষোভ প্রতিষ্ঠা করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। পাশাপাশি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সরল রেখায় চারিয়ে দিয়েছেন কাঁটার বিদ্রোহ। নীল জল ছবিটি অনেক বেশি মগ্নতা দাবি করে। এটিও সফটগ্রাউন্ড মাধ্যমে আঁকা, ১৯৬৪ সালে। এখানে ক্যানভাসে মরালগ্রীবার মতো উঁকি দিতে দেখা যাচ্ছে একাধিক কালো রঙের নৌকার গলুই। কমলা রঙের বিপরীতে উদ্ভাসিত কালোর অন্তরালে স্বচ্ছ নীল রঙের নিস্তরঙ্গ জল। ছবিতে নৌকার গলুই যেন ফর্ম নয়, রেখার সঞ্চালনে মূর্ত হয়ে উঠেছে। তাঁর এই পর্বের অধিকাংশ ছবিতে এ ধরনের চওড়া রেখার বিশেষ ব্যবহার চোখে পড়ে। মাছ ধরার সময় এবং ভাসমান জাল ছবিতে এ ধরনের রেখাগুলো জ্যামিতিক বিন্যাসে গ্রাফিক বৈশিষ্ট্য পেয়েছে। এ ছবি দুটিতে শিল্পী কমলা, হলুদ ও নীল রঙের সঙ্গে কালো রঙের সুগভীর সম্বন্ধ পাতিয়ে দিয়েছেন; এ কারণে দর্শকের চোখে তা এক অদ্ভুত দ্যোতনায় উদ্ভাসিত হয়। ১৯৫৭ সালে আঁকা হলুদ জাল ছবিটিতে তিনি রঙের চেয়েও রেখাকেই গুরুত্ব দিলেন বেশি। এনগ্রেভিংয়ের মাধ্যমে তিনি ফুটিয়ে তুললেন জালের ফাঁস, দড়িদড়া, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুষঙ্গ। নিখুঁত করে তুললেন জালের টেক্সচার। জালে আটকে থাকা মাছ আঁকলেন প্রতীকী করে; যেন মাছ নয়, ধীবরের বহু প্রতীক্ষিত চোখ জড়িয়ে আছে তাতে। এ ছবিটিও বেশ অভিনিবেশ দাবি করে। এর পরের বছরেই তিনি আঁকলেন গুন টানার দৃশ্য। ক্যানভাস জুড়ে শুধু রেখার ছড়াছড়ি; তাতে ফুটে উঠেছে মাল্লার শ্রমক্লান্ত শারীরিক বিভঙ্গ, হাওয়ায় স্ফীত পালের মোটিফ, আঁকাবাঁকা নদী, স্রোতÑ এইসব। গুনটানাকে বিষয় করে এর বছর চারেক আগে জয়নুল আবেদিনও গোয়াশে ছবি এঁকেছিলেন। কিন্তু ছবিটি দেখে কারও কারও মনে এই প্রশ্ন জাগতে পারে, নৌকাটি নিয়ে দাড়ি আদৌ ঘাটে পৌঁছোবে কি না। শিল্পাচার্যের মাল্লারা এত বেশি ক্লান্ত। সফিউদ্দিনের ছবিতে আশার আলো ছলকে ওঠে। পিছনের হালাকা হলুদ রং আশার আলো তথা প্রত্যয়ের প্রতীকÑ এ নৌকা গন্তব্যে পৌঁছোবেই। শিল্পী এখানে একটি বিন্দু নিয়ে খেলা করেছেন। যেন এই একটি বিন্দুকে দ্রুত সঞ্চালনে ঘুরিয়ে এনেছেন ক্যানভাসের বিস্তীর্ণ জমিনে। পুরো ছবিটিকে তাই একটি রেখায় রচিত বলেই মনে হবে। আগেই বলেছি, ছাপাই ছবির রেখা সরাসরি শিল্পীর হাতের টান নয়Ñ সফিউদ্দিন আহমেদের এই ছবিটিতে রেখার লতিয়ে ওঠা দেখে এ কথায় অবিশ্বাস জন্মে। সত্তর-আশির দশকের শিল্পীর ক্যানভাস তীক্ষèধীসম্পন্ন তীক্ষè রেখায় আরও বেশি রক্তক্ষরা, স্মৃতিবিধূর। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে ‘একাত্তরের স্মরণে’, ‘ভাষা আন্দোলন’, ‘কান্না’ প্রভৃতি ছবির নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। ভাষা আন্দোলন ছবিটি সফিউদ্দিন আহমেদ আশির দশকের শেষ দিকে এঁকেছেন। ধূসর ক্যানভাসে কালো রঙের দুটিমাত্র গ্রেডে ছবিটি সম্পন্ন হয়েছে। তারপরও ছবিটি রেখা প্রধান। গতিময় রেখায় অসংখ্য চোখ এবং সব মিলিয়ে একটি ব্যথিত মুখের ফর্ম ফুটে উঠেছে। ছবির মাঝ বরাবর আবছা রেখায় কতগুলো প্লাকার্ড শিল্পী ভাস্বর করে তুলেছেন, যা দর্শকের চোখ ইতিহাসের পাতায় নিবদ্ধ করে দেয়, ফিরিয়ে নেয় ১৯৫২ তে। একাত্তরের স্মরণে ছবিটিতে ক্ষিপ্র রেখায় অংকিত হয়েছে প্রতিবাদী, ক্রুদ্ধ, অশ্রু“সিক্ত, ভয়ার্ত, বিস্ফারিত কতগুলো চোখের ফর্ম। খয়েরি চিত্রপট, কিন্তু কালো রেখায় কালো রাতের কথাই যেন স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন শিল্পী। রেখাধর্মী এ ছবির রেখাগুলো অত্যন্ত গতিময়। চিত্রপট জুড়ে রয়েছে গুলি, অশ্রু“বিন্দুর মোটিফ, রয়েছে উঁচিয়ে ধরা বন্দুকের নল। কান্না ছবিটিও একই আঙ্গিকে রচিত। ক্ষীপ্র রেখায় বেশ কয়েকটি চোখের ফর্ম মূর্ত হয়ে উঠেছে। রেখাগুলো ঘন সন্নিবেশিত নয় বলে ছবিতে অনেক অবকাশ রয়েছে; বহুক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় এর দিকে। ছবিটিতে মোটা, সরু এবং কৌশিক রেখার ব্যবহারও অত্যন্ত নান্দনিক। ১৯৮৫ সালে আঁকা জলের নিনাদ ছবিটি একেবারেই ভিন্নতা দাবি করে। কলারসিকের কাছে সফিউদ্দিন আহমেদও পরিলক্ষিত হলেন ভিন্নভাবে। শুধু রঙের প্রসঙ্গে বক্তব্য সীমাদ্ধ রাখতে গেলে বলতে হবে, এই ছবিতে তিনি কালো রংকেই ব্যাবহার করেছেন নানাভাবে, নানান মাত্রা ও অনুপাতে। খেয়াল করলেই বোঝা যায়, এটি তাঁর কালো রঙের নিরীক্ষাধর্মী কাজ। অথচ প্রথম দর্শনেই দর্শক বিভ্রান্ত হবেন। জলের নিনাদ ছবিতে সফিউদ্দিন আহমেদ এই প্রহেলিকাই সৃষ্টি করেছেন পরিপূর্ণ দক্ষতায়। সফিউদ্দিন আহমেদ নিত্যসৃষ্টিশীল, নিরীক্ষাপ্রবণ শিল্পী। কখনও তিনি পরীক্ষায় মেতে ওঠেন কাঠ ও ধাতুর বৈশিষ্ট্য নিয়ে; কখনো রং, রেখা; কখনওবা করণকৌশল ও বিষয়বস্তুর বিন্যাস নিয়ে। তাঁর ছবিতে চওড়া চুলের ফিতার মতো কালো রেখার ব্যবাহার যেমন দেখা যায়, তেমনি সরু, কৌশিক রেখাও চোখে পড়ে। তাঁর রেখা কখনও কর্কশ, কখনও তীক্ষè, কখনও লাউয়ের জালির মতো কোমল। আর কালোর প্রতি তাঁর প্রকাশ্য পক্ষপাত। কালো রংকে আজীবন তিনি ‘রঙের রানি’ বলে এসেছেন; বিচিত্র চিত্রসম্ভারেই তার প্রমাণ রেখেছেন তিনি।
×