ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

বিজেপি কি ভারতকে পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ৮ নভেম্বর ২০১৭

বিজেপি কি ভারতকে পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে

ভারতের ১৩০ কোটি লোকের ১৪ শতাংশই মুসলমান। এদের আবার উল্লেখযোগ্য অংশ ভোটার। ভারতের মুসলমানরা ইতিহাসগতভাবে দেশের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু ২০১৪ সালে হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধ্বজাধারী মোদি ও তার দল বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে মুসলমানরা নিজেদের কোণঠাসা বলে মনে করছে। ইতোমধ্যে অনেক স্থানে গো-হত্যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অনেক কসাইখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মুসলমান মাংস ব্যবসায়ীরা মার খেয়েছে। শুধু গো-মাংস বন্ধ করা নয়। ২০১৫ সাল থেকে হিন্দু-পুরুষদের গ্যাং হামলায় দেড় শ’রও বেশি মুসলমান নিহত হয়েছে। অভিযোগ, এরা গরুর ক্ষতি করেছে বা গো-মাংস খেয়েছে। সবচেয়ে গুরুতর ঘটনাগুলোর একটি ঘটে গত ২২ জুন। ঐদিন জুনাইদ খান নামে ১৬ বছরের এক মুসলিম কিশোরকে ট্রেনে হত্যা করা হয়। জুনাইদ নয়াদিল্লীতে কেনাকাটা শেষে ট্রেনে করে বাড়ি ফিরছিল। সঙ্গে ওর দুই ভাইও ছিল। ট্রেনে হিন্দুরা দুই ভাইকে উত্ত্যক্ত করতে শুরু করে। তাদের পাকিস্তানী ও গো-মাংসখোকা বলে গালি দিতে থাকে। এর প্রতিবাদ করলে হিন্দু জনতা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তারা ছুরি বের করে তিন ছেলেকে আঘাত করতে শুরু করে। জুনাইদ ওই আঘাতেই মৃত্যুবরণ করে। তিনটি নিরীহ কিশোরকে হত্যার মতো এই নিষ্ঠুরতা, কা-জ্ঞানহীনতা ও অমানবিকতা গোটা ভারতকে নাড়া দেয়। হিন্দুস্তান টাইমস জাতিগত ঘৃণা থেকে পরিচালিত এই ধরনের হামলার ওপর জরিপ চালিয়ে দেখায় যেÑ ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মুসলমানদের ওপর এবং কিছুটা কম মাত্রায় অন্যান্য সংখ্যালঘুর ওপর এ জাতীয় হামলা হয়েছে ১৪৯টি এবং তার মধ্যে ৪০টি হামলায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। সমালোচকরা উগ্রবাদী হিন্দুদের মদদ দেয়ার জন্য বিজেপিকে দায়ী করে থাকে। প্রামাণ্য চিত্র নির্মাতা এবং সংখ্যালঘু নির্যাতনবিরোধী আন্দোলন ‘নট মাই নেম’ এর প্রতিষ্ঠাতা সেবা দেওয়ান বলেন, ‘বিজেপির গোটা মতাদর্শই হলো হিন্দু জাতীয়তাবাদ। হিন্দু জাতীয়তাবাদ মানে ভারতীয় হতে হলে হিন্দু হতে হবে। অতএব ভারতের মধ্যে মুসলমানদের কোন জায়গা নেই। সে কারণেই মুসলমানদের মধ্যে আতঙ্কবোধ বিরাজ করে।’ অথচ সমকালীন ভারতের এমন হওয়ার কথা ছিল না। মোদি ক্ষমতায় আসার সময় এক আধুনিক, প্রযক্তিনির্ভর, বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন জাতির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। কিন্তু গত এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে এসেছে। আর বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত ভারতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনুদারতা ভর করেছে। ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতের সংবিধানে বিধৃত রয়েছে। অথচ লেখক, সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদরা বিজেপির সামালোচনা করলে কিংবা ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে কিছু বললে দলটির তরফ থেকে বিরোধিতা ও গালিগালাজের শিকার হন। ২০১৫ সালে ভারতের ৪০ জনেরও বেশি শীর্ষস্থানীয় লেখক সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থানের প্রতিবাদে সম্মানজনক রাষ্ট্রীয় পদক ফিরিয়ে দিতে শুরু করেন। একই বছর ২শ’রও বেশি শিক্ষাবিদ এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন যে, উচ্চতর শিক্ষা কেন্দ্র ও প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার দায়িত্ববার তাদের হাতেই তুলে দেয়া হচ্ছে যাদের একমাত্র যোগ্যতা হচ্ছে শাসক দলের এজেন্ডার প্রতি আনুগত্য। সাংবাদিকরা বিজেপির নেতাদের কাছ থেকে ‘প্রেসস্টিটিউট’ নামে আখ্যায়িত হয়েছেন। দলীয় সমর্থকদের তরফ থেকে তারা হত্যা ও ধর্ষণের হুমকিও পেয়ে থাকেন। গত এপ্রিলে ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস’ সংস্থাটির বিশ্ব সংবাদপত্র স্বাধীনতার বার্ষিক সূচকে ভারতের স্থান তিন ধাপ নিচে এসে ১৩৬-এ ঠাঁই পেয়েছে। গত ৫ সেপ্টেম্বর ব্যাঙ্গালুরুভিত্তিক সাংবাদিক ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের ঘোর সমালোচক গৌরী লাঙ্কেশ নিজ বাড়িতে প্রবেশ করার সময় তিন অস্ত্রধারীর হাতে নিহত হন। নিউইয়র্কভিত্তিক সংগঠক ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’-এর দক্ষিণ এশিয়ার ডিরেক্টর মিনাক্ষী গাঙ্গুলী সম্প্রতি লিখেছেন : ‘আইনের শাসনের প্রতি অনুগত এক নিরাপদ সমাজ হিসেবে দাবি করে যে ভারত বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে, বিজেপির অঙ্গ সংগঠনগুলো ও সমর্থকদের প্রকাশ্যে সতর্ক প্রহরা ঘোষণা সেই দেশটির জন্য এক দুঃখজনক ও ভয়াবহ পরিণতির ইঙ্গিত বহন করছে।’ পরিস্থিতি দৃষ্টে এখন মনে হওয়ার কারণ ঘটেছে যে, ভারত সামনে এগিয়ে চলার বদলে সাম্প্রদায়িক ও সাংস্কৃতিক ঘৃণার পুরনো অধ্যায়ে ফিরে যাচ্ছে। এই ঘৃণার সবচেয়ে ভয়াবহ অভিপ্রকাশ ঘটেছিল ১৯৪৭ সালে এই উপমহাদেশে বিভক্ত হয়ে দুই আলাদা রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার সময়। সে সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামায় ২০ লাখ লোক প্রাণ হারিয়েছিল। সেই বিভাজন এখনও চলছে। সাম্প্রদায়িক ঘৃণার গভীর অনুভূতি এখনও প্রথিত হয়ে আছে।’ প্রখ্যাত কাহিনী কথক ফৌজিয়া দাস্তাঙ্গো বলেন যে, তিনি হিজাব পরেন না কিংবা এমন কিছু ধারণ করেন না যাতে তাকে মুসলমান বলে চিহ্নিত হতে হয়। তার পরও প্রতিদিন তাকে ঘৃণা ও দ্বেষের অসংখ্য দৃষ্টান্তের সম্মুখীন হতে হয়। এমনকি তার শিক্ষিত ও কসমোপলিটান বন্ধুদের আচরণ থেকেও তার মনে হয় ভারতে তিনি অনাহূত। এক বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি একবার ভাষণ দিয়েছিলেন। তার পর হিন্দু সহকর্মীরা তার রান্না করা সবজি খেতে রাজি হয়নি এই যুক্তিতে যে তিনি নিশ্চয়ই এমন পাতিলে রান্না করেছেন যেখানে মাংস রাধা হয়! ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট খেলা দেখার সময় তার বন্ধুরা তাকে বলে তিনি যেহেতু মুসলমান তাই নিশ্চয়ই পাকিস্তানের সমর্থক। এক হিন্দু বান্ধবীর সঙ্গে একত্রে যাওয়ার জন্য তিনি ক্যাব ডেকেছেন। কিন্তু যখন বান্ধবীটি জানল ক্যাবের ড্রাইভার মুসলমান সঙ্গে সঙ্গে ফৌজিয়াকে ওই ক্যাবটি বাদ দিতে বলল। ফৌজিয়া জানালেন গত তিন চার বছর ধরে তাদের এমন অনুভূতি হচ্ছে এবং পরিস্থিতি দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে। ফৌজিয়া বলেন, ‘আমাদের জানিয়ে দেয়া হচ্ছে এ দেশ আমাদের নয়। আগে কেউ এ কথা প্রকাশ্যে বলত না, এখন বলছে। এখন ফৌজিয়া বা আরমান নামের কাউকে মারধর করা কারোর যেন অধিকারে পরিণত হয়েছে।’ মোদি গত মে মাসে মুসলিম নেতাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে বলেছিলেন তাদের প্রতি যে সব সহিংসতা হয়েছে তার পেছনে বিজেপি নেই। তিনি বলেন, ‘সকল সম্প্রদায়ের প্রতি আমাদের সমান আচরণ। আমরা জাত-ধর্মের ভিত্তিতে পক্ষপাতিত্বে বিশ্বাসী নই।’ কিশোর জুনাইদের হত্যার ঘটনার পর মোদি প্রকাশ্যে বলেছিলেন : গোরক্ষার নামে লোক হত্যা সমর্থনযোগ্য নয়। সহিংসতা কোন সমস্যার কখনই কোন সমাধান দিতে পারে না।’ কিন্তু তিনি লাঙ্কেশ হত্যার সম্পর্কে কোন মন্তব্য করেননি এবং সমালোচকদের ভাষায় তিনি ঘৃণা-বিদ্বেষ দূর করার জন্য যতটুকু যা করার তার কিছুই করছেন না। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, উত্তর প্রদেশের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য তিনি আদিত্যনাথকে নিয়োগ করেছেন। এই সেই আদিত্যনাথ যার মুসলিম বিদ্বেষ সুবিদিত। ২০১৪ সালে এক জনসভায় ভাষণে আদিত্যনাথ বলেছিলেন : ‘অপর পক্ষ যদি শান্তিতে না থাকে আমরা শিখিয়ে দেব কিভাবে শান্তিতে থাকতে হয়। আমরা সেই ভাষায় তাদের শেখাব, যে ভাষা তারা বুঝতে পারে! এক বছর পর আরেক সমাবেশে তিনি বলেছিলেন, ‘সুযোগ পেলে আমরা প্রতিটি মসজিদে গৌরী, গণেশ ও নদীর মূর্তি স্থাপন করব।’ সেটা অবশ্য করা হয়নি। তবে মুসলমানদের প্রতি হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন থামেনি। সূত্র : টাইম
×