ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

মূল : মাইকেল গোল্ডকার্ব;###;রূপান্তর : এনামুল হক

বিশ্বায়নের এই যুগে জাতির পরিচয় কী

প্রকাশিত: ০৩:০৩, ৬ নভেম্বর ২০১৭

বিশ্বায়নের এই যুগে জাতির পরিচয় কী

সম্প্রতি ইরাকী কুর্দিস্তান ও কাতালোনিয়ায় স্বাধীনতা প্রশ্নে গণভোট হয়েছে। এই গণভোট নিয়ে যেমনটি আগে ধারণা করা হয়েছিল তাই হয়েছে। বাগদাদ ও মাদ্রিদের কেন্দ্রীয় সরকারগুলো কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এ থেকে একবিংশ শতাব্দীর জাতিত্বের অর্থ বা সংজ্ঞা নিয়ে বহু প্রশ্নের উদয় হয়েছে যেগুলোর কোন জবাব নেই। জাতি কাকে বলে? জাতি রাষ্ট্র কি? সেটা কি একটা দেশের মতো একই জিনিস? একটা জনগোষ্ঠী বা ট্রাইব কি জাতির মতো একই সত্তা? বিশ্বায়িত অর্থনীতিতে জাতীয় সার্বভৌমত্ব কথাটির দ্বারা সত্যিকার অর্থে কি বোঝায়? আমার ধারণা বেশিরভাগ আমেরিকান এসব প্রশ্ন নিয়ে ভাবে না। তারা একটি অবিভাজ্য জাতির মধ্যে বাস করে যদিও তাদের দেশটি ইদানীং সেভাবে অনুভবও করে না। কিন্তু জাতি কাকে বলে? এটা এমন এক প্রশ্ন যা স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর থেকে প্রায় তিন দশক ধরে বিশ্বের বহু দেশের জরুরী ভিত্তিতে জিজ্ঞাসিত হয়েছে। শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ১৫টি নতুন পুরনো জাতির আবির্ভাব ঘটেছে। ইউরোপের বৃহৎ রাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোও নিজেদের নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। বার্লিন প্রাচীরের পতনের পাঁচ বছরের মধ্যে পূর্ব জার্মানি পশ্চিম জার্মানদের দ্বারা কার্যকরভাবে ক্রীত হতে সম্মত হয়। চেকোসেøাভাকিয়া আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সৃষ্ট দুটি জাতিতে পরিণত হয়। যুগোসøাভিয়া শেষ পর্যন্ত রক্তপাতের মধ্য দিয়ে এই বিশ্বের বুকে সৃষ্ট ৭টি দেশ হয়ে দাঁড়ায়। সব জনগোষ্ঠীই যে তাদের নিজস্ব জাতিরাষ্ট্র লাভের জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে সফল হতে পেরেছে তা নয়। আবার ভয়াবহ দমন-নিপীড়ন সত্ত্বেও কুর্দীরা তাদের নিজস্ব জাতি গঠনের চেষ্টায় কখনও ক্ষান্ত থাকেনি। মানচিত্র নতুন করে নির্ধারণের এই যে প্রবল তাড়না বা আকাক্সক্ষা এটা অনুধাবন করতে গেলে আধুনিক সাম্রাজ্যের ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে পরাজিত অটোমান সাম্রাজ্য ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য থেকে ছিঁড়ে খুঁড়ে নিয়ে কুর্দিস্তান ও যুগোসøাভিয়ার সীমান্ত নির্ধারণ করা হয়েছিল। জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষার সঙ্গে এই সীমান্ত রেখাগুলোর তেমন কোনই সম্পর্ক ছিল না এবং সবকিছুই করা হয়েছিল বিজয়ী সাম্রাজ্য ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সুবিধার্থে। এই সীমান্তগুলো বজায় রেখেছিল সাম্রাজ্যিক শক্তিগুলো যেগুলোর স্থলাভিষিক্ত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ ও ফরাসীরা, যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। রাষ্ট্রসত্তার বর্তমান ধারণার প্রতি চ্যালেঞ্জ শুরু হয় কমিউনিজমের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পর পশ্চিমা দেশগুলোতে ফাটল দেখা দিতে শুরু করলে এই চ্যালেঞ্জ আরও প্রসারিত হয়। ওই সঙ্কট বা বিপর্যয়ের পর নিজেদের জাতি কি এবং কি হওয়া উচিত তা নিয়ে ব্রিটেনদের অভ্যন্তরীণ বাদানুবাদ থেকে উদ্ভূত হয় ব্রেক্সিট। অর্থনৈতিক ধসের কারণে স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির পক্ষে সমর্থন বেড়ে যায়। দলটি ২০১১ সালে স্কটিশ পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ২০১৪ সালে এক গণভোটে স্কটিশ ভোটারদের জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘স্কটল্যান্ডের কি স্বাধীন দেশ হওয়া উচিতÑ হ্যাঁ বা না?’ গণভোটের রায় হয়েছিল ‘না’। কিন্তু সেখানেই কাহিনীর শেষ ছিল না কারণ ইংরেজদের জাতীয়তাবাদ জাগ্রত হয়ে গিয়েছিল। স্কটিশ গণভোটে জয়লাভ করার পর ২০১৬ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ইউরোপীয় ইউনিয়নে ব্রিটেনের সদস্য পদ অব্যাহত রাখার প্রশ্নে গণভোটের আয়োজন করে আবার তার ভাগ্য পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেন। ভোটের বিষয়টি ছিল : ‘যুক্তরাজ্যের কি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য থাকা উচিত না ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়া উচিত? জাতীয় সার্বভৌত্বের বিচারে ইউরোপীয় ইউনিয়নে সদস্য পদ অব্যাহত রাখার বিরুদ্ধে যুক্তি উত্থাপিত হয়। এই যুক্তি নতুন কিছু ছিল না। ১৯৮০-এর দশকের শেষদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ফেডারেল ভবিষ্যতের দিকে ধীরগতিতে যাত্রা শুরু করলে ব্রিটেন সেই প্রক্রিয়ায় যোগ দিতে গড়িমসি করে। মার্গারেট থ্যাচারের দৃষ্টিতে ফেডারেল ইউরোপে যোগ দেয়ার অর্থ হচ্ছে ব্রিটেনের জাতীয় স্বাধীনতার অবসান হওয়া। ইউরোপীয় ইউনিয়নে তার আকার আয়তন ও গুরুত্বের কারণে ব্রিটেন এই ফেডারেল ইউরোপের ভিত্তিমূলক ব্যবস্থার বাইরে থাকার পক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়। সেই ব্যবস্থাটি হলো এক শেনঝেন চুক্তি যার বদৌলতে ইউরোপের জাতীয় সীমান্তগুলো দিয়ে লোকজনের অবাধ চলাচলের সুযোগ দেয়া হয় এবং দ্বিতীয়টি হলো অভিন্ন একক মুদ্রা ইউরো। ভীতি বেশিরভাগ মানুষের মনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে ভীতি সাধারণভাবে বাস্তববাদী ইংরেজদের মনেও তাই করেছে। ওটা তাদের যুক্তিহীন করে তুলেছে। স্কটল্যান্ডের গণভোটের সময় ইউরোপীয় ইউনিয়ন স্কটদের পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দেয় যে তারা স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দিলে তারা যে দ্রুত ইউনিয়নের ভেতর চলে আসবে তা নয় এবং ইউরোকে তার মুদ্রা হিসেবেও ব্যবহার করতে পারবে না। ব্রিটিশ সার্বভৌমত্বের প্রতি এর চেয়ে বড় সমর্থন কল্পনা করা যেতে পারে না। তাতে কিছু যায় আসেনি। ভোট যখন গণনা করা হলো দেখা গেল ৫৩ শতাংশ ইংরেজ ভোটার যুক্তরাজ্য থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে এবং ৬২ শতাংশ স্কট থেকে যাওয়ার পক্ষে রায় দিয়েছে। জাতীয় ইচ্ছার দুই অতি স্বতন্ত্র অভিপ্রকাশ। তবে একটা ইচ্ছাই কেবল কার্যকর হয়েছে। স্কটিশদের এই ভোট কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্তকে কতখানি প্রভাবিত করেছে? কাতালান পার্লামেন্টের নেতা চার্লস পুগডিমন্ট কি স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা প্রশ্নে ব্রিটেনের শান্তিপূর্ণ ভোটাভুটির নজির দেখে এমনটা ধরে নিয়ে ভুল করেছিলেন যে কাতালানরাও একই রকম সম্মানজনক পরিবেশে ভোট দিতে পারবে? তিনি কি জানতেন না যে, স্পেন সরকার যখন এই স্বাধীনতা ঠেকানোর জন্য গুয়ার্ডিয়া সিভিল (সামরিক বাহিনী) পাঠিয়েছিল তখন সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সার্ভভৌমত্বের প্রতি মর্যাদা প্রদর্শনের অঙ্গীকারের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন হস্তক্ষেপ করবে না? কাতালান সঙ্কট জাতিত্ব বা জাতিসত্তা সম্পর্কে চূড়ান্ত প্রশ্নটি নিয়ে এসেছে : পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো কি তাদের জাতিত্বের বিষয়টিকে বৃহত্তর কোন কিছুতে টেনে না এনে এই বিশ্বায়িত অর্থনীতিতে নিজেদের সম্পদ ও জীবনযাত্রার উচ্চমান বজায় রাখতে পাওয়ার আশা করতে পারে? এই সমকালীন প্রশ্নটির জবাব শুরু করতে গেলে অতীত থেকে করতে হবে। প্রায় ৫শ’ বছর আগে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের আরেকটি অধ্যায়ে এক পোলিশ অভিজাতকে, যার নাম ইতিহাসে হারিয়ে গেছে, তার জাতীয় পরিচয় জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি জবাব দিয়েছিলেন; ‘আমি পোলিশ জাতির অন্তর্গত, আমার নাগরিকত্ব লিথুয়ানীয়, আর্মি রুথেনীয় জনগোষ্ঠীভুক্ত এবং আমার উৎস হলো ইহুদী সম্প্রদায়।’ কাতালোনিয়ার স্বাধীনতাবিরোধী মধ্য ডানপন্থী একটি দলের নেতা এলকার্ট রিভেবার বক্তব্যের মধ্যে এই জবাবটার অনুরণন রয়েছে : ‘কাতালোনিয়া আমার আবাসভূমি, স্পেন আমার দেশ এবং ইউরোপ আমার ভবিষ্যত।’ ইউরোপ কি একটা জাতি হতে পারে? একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় প্রশ্নগুলোর এটি হলো অন্যতম। সূত্র : নিউইয়র্ক টাইমস
×