ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসির সিয়াম

গল্প ॥ মুক্তি

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৪ নভেম্বর ২০১৭

গল্প ॥ মুক্তি

হঠাৎ করেই তিন দিনের ছুটি পেয়ে গেল পিয়াস। সেই বড় ঈদের পর ছুটি কাটিয়ে চট্টগ্রাম আসার পর আর বাড়িতে যাওয়া হয়নি তার। কাজেই ছুটির এই তিনটা দিন পাঁচবিবি থেকেই কাটিয়ে আসবে বলে ঠিক করল সে। ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে সন্ধ্যার বাসে রওনা হলো পিয়াস। অনেকদিন পর বাড়ি ফেরার এক অন্যরকম আনন্দ কাজ করছে তার ভেতর। সকাল আটটার দিকে পাঁচবিবি বাস স্ট্যান্ডে এসে থামল বাস। বাস থেকে নেমে একটা রিক্সা ভাড়া করে নিয়ে বাড়িতে গিয়ে পৌঁছাল পিয়াস। বাড়ির ভেতর ঢুকতেই সে দেখতে পেল নাভেন স্কুল ড্রেস পরে আর কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নাভেন তার বড় ভাইয়ের ছেলে। পিয়াসকে সে এক কথায় চোখে হারায়। আর পিয়াসও ওকে খুব ভালবাসে। এ বছর ক্লাস টু’তে উঠেছে নাভেন। দেখতে পেয়েই ছুটে এসে পিয়াসকে জড়িয়ে ধরল ও। সঙ্গে সঙ্গে পিয়াসও ওকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করে দিল। ছোট্ট নাভেন মিষ্টি স্বরে জানতে চাইল, চাচ্চু, তুমি আসবে সেটা তো আগে বলনি? ভাইপোর কথায় বাধ্য ছেলের মতো নরম গলায় উত্তর দিল পিয়াস, হঠাৎ করেই ছুটি পেয়ে গেলাম। তাই তোমাকে দেখতে চলে এসেছি। কেন তুমি খুশি হওনি, বাবান? -হ্যাঁ, অনেক বেশি খুশি হয়েছি। এখন চল আমরা ক্রিকেট খেলি। আজ আর আমি স্কুলে যাব না। -কিন্তু ভাল ছেলেরা তো স্কুল কামাই করে না. আমরা বরং তমি স্কুল থেকে ফেরার পর একসঙ্গে ক্রিকেট খেলব। হুট করেই পিয়াসকে বাড়িতে আসতে দেখে বেশ অবাকই হয়েছে সবাই। আসলে পড়ালেখার চাপে ঈদের ছুটি ছাড়া এখন আর তার বাড়িতে আসা হয় না। সবার সঙ্গে কথা বলে নাস্তা খেতে বসল সে। সারা রাত জার্নি করায় শরীরটা বেশ ক্লান্ত লাগছে তার। নাস্তা শেষ করে রেস্ট নেবার জন্য নিজের ঘরে চলে গেল পিয়াস। ক্লান্ত শরীর নিয়ে নিজের অজান্তেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল সে নিজেও জানে না। পিয়াসের ঘুম ভাঙল নাভেনের ডাকে। স্কুল থেকে ফিরেই সে তাকে ডাকতে ডাকতে ঘরে এসে ঢুকেছে। বিছানায় উঠে বসল পিয়াস। হাই তুলতে তুলতে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে, বাবান? -তুমি না বলেছিলে স্কুল থেকে ফেরার পর ক্রিকেট খেলবে! তাই তোমাকে অনেকক্ষণ ধরে ডাকছি। কিন্তু তুমি তো উঠলেই না, এখন আর খেলার সময় নেই। -তাহলে চল আমরা ছাদে গিয়ে গল্প করি। ছাদে গিয়ে পিয়াস লক্ষ্য করল, এক কোণায় একটা খাঁচার ভেতর শালিক পাখি রাখা। কিন্তু ওদের বাড়িতে তো কারোর খাঁচায় করে পাখি পোষার কথা না! নিরীহ পশু পাখিকে বন্দী করে রেখে কস্ট দেয়া বাবা একদমই পছন্দ করেন না। নাভেনের কাছে জানতে চাইলে ও বলল, ওটা নাকি ওরই পাখি। কয়েকদিন আগে স্কুল থেকে ফেরার পথে পাখিটাকে সে অসুস্থ অবস্থায় কুড়িয়ে পেয়ছে। এরপর পাখিটাকে বাড়িতে নিয়ে এসে সেবা যত্ন করে সুস্থ করেও তুলেছে সে নিজেই। পাখিটাকে সে অনেক ভালবাসে বলে এখন খাঁচায় করে পুষছে। ছোট্ট নাভেনকে সরাসরি কিছু বললে বুঝতে পারবে না, তাই পিয়াস আর কোন কথা বাড়াল না। সন্ধ্যার দিকে ভাবি তাকে জানালো, সবাই নাভেনকে অনেক বুঝিয়েছে। কিন্তু কোনভাবেই ও পাখিটাকে খাঁচা থেকে ছাড়তে চাচ্ছে না। কারণ, পাখিটার মালিক নাকি এখন ও। ছোট্ট মানুষ, তাই ওকে এ ব্যাপারে জোরও করা যাচ্ছে না। রাতে সবাই একসঙ্গে খাবার সময় নাভেনকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করল পিয়াস, আচ্ছা বাবান, ধর তুমি কাল স্কুলে একটা অঙ্ক ভুল করেছ বলে যদি বাসায় আসার পর তোমাকে তোমার মামনি বিকেল বেলা খেলতে যেতে না দিয়ে ঘরে আটকে রাখে, তখন তুমি কি করবে? নাভেনের মুখ কিছুটা শুকিয়ে গেল। সে কখনও ভাবতেই পারেনি যে সামান্য একটা অঙ্ক ভুল করার জন্য তাকে খেলতে যেতে না দিয়ে ঘরে আটকে রাখা হবে! উত্তর দিল, আমাকে কেন আটকে রাখবে! ঘরে একা থাকলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে জান না? তোমার মামনি তোমাকে জন্ম দিয়েছেন, তোমাকে আদর যতœ করে বড় করছেন তিনি, তোমাকে অনেক ভালও বাসেন, তাই না? তাহলে তো তোমাকে ঘরে বন্দী করে রাখতেই পারেন তিনি। কিন্তু চাচ্চু, আমার তো খুব ছটফট লাগবে তখন। আমি দম বন্ধ হয়ে মরেও যেতে পারি। তাই মামনি আমাকে কখনোই ঘরে আটকে রেখে কষ্ট দেবে না। কারণ, মামনি আমাকে অনেক ভালবাসে। তাহলে আমরা যাদের ভালবাসি, কাওকেই জোর করে বন্দী করে রাখা উচিত না? -না, বন্দী করে রাখলে সবার একই রকম কষ্ট হয়। কথাটা শেষ করেই নাভেন কি যেন ভাবতে শুরু করল। পিয়াসও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে চুপ করে গেল। নাভেন খুব বুদ্ধিমান ছেলে। এরই মধ্যে সে হয়ত বুঝতে পেরে গেছে, পাখিটাকে আটকে রাখা তার ঠিক হয়নি। খাঁচায় বন্দী থেকে পাখিটারও খুব কষ্ট হচ্ছে। খাওয়া শেষে সবাই যে যার ঘরে ঘুমাতে গেল। পিয়াস বাড়িতে আসলে নাভেন ওর সঙ্গেই ঘুমায়। আজও তারা এক সঙ্গে ঘুমাতে গেল। পিয়াস চোখ বন্ধ করে থাকায় নাভেন ভেবেছে, সে ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই সাবধানে বিছানা থেকে নেমে গেল ও। পিয়াস জানে ঠিক কোথায় যাচ্ছে নাভেন। সে অন্যায় একটা কাজ করেছে বুঝতে পেরেই, এখন খাঁচা থেকে পাখিটাকে মুক্ত করে দিতে যাচ্ছে। কাজেই পিয়াস চোখ বন্ধ করেই শুয়ে থাকল। কিছুক্ষণ পর নাভেন ঘরে ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল। পরেরদিন নাভেন স্কুলে চলে যাওয়ার পর ছাদে গেল পিয়াস। পাখির খাঁচার কাছে যেতেই সে বুঝতে পারল, গতকাল রাতে সে যা ভেবেছিল, ঠিক তাই হয়েছে। নাভেন সত্যিই বুঝতে পেরেছে, পাখিটাকে তার শুধুমাত্র ভাললাগে বলেই, খাঁচায় বন্দী করে রাখার কাজটা খারাপ হয়েছে। এজন্য সে মনে মনে লজ্জাও পেয়েছে কিছুটা, তাই সবার আড়ালে চুপিচুপি ছাদে এসে পাখিটাকে খাঁচা থেকে মুক্ত করে দিয়ে গেছে। ছোট্ট ভাইপোর জন্য এবার পিয়াসের বেশ গর্ব হচ্ছে। কারণ, বুদ্ধি করে সে ঠিকই বুঝে নিয়েছে নিজের ভুলটা। নিজের অন্যায়টা শুধরে নিয়ে পাখিটাকে খাঁচা থেকে মুক্ত করার সময় হয়ত তার খুব আনন্দও লাগছিল। আর এতদিন যাবত পরাধীন অবস্থায় থাকা স্ইে পাখিটাও হয়ত, মুক্তির আনন্দে আকাশের বুকে ডানা মেলে নাচছিল!
×