ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

মাহমুদুল বাসার

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ৩১ অক্টোবর ২০১৭

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী

১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী দুজন শিখ দেহরক্ষীর হাতে নিহত হলেন, তখন আমি চাঁদপুর জেলার একটি মফস্বল কলেজে বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করি। এলাকাটি বিএনপি-জামায়াত অধ্যুষিত। তাই লক্ষ্য করেছিলাম বাংলাদেশের ধাত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর আকস্মিক মৃত্যুতে তাদের আনন্দ-উল্লাস। আরও একবার তাদের উল্লাস দেখেছিলাম যখন সত্তরের দশকে নির্বাচনে মোরারজী দেশাইদের কাছে শ্রীমতী গান্ধী পরাজিত হয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে সৈয়দ নাজিমুদ্দীন মানিক সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘মুক্তিবাণী’ পত্রিকায় বঙ্গবিবেক আবুল ফজল লিখেছিলেন ‘শেখ মুজিব তাঁকে যেমন দেখেছি’ নামের হৃদয়গ্রাহী ধারাবাহিক কলামটি। সেখানে আবুল ফজল ইন্দিরা গান্ধী সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতার জন্য আমরা বাংলাদেশের বাইরের কারও কাছে যদি এককভাবে ঋণী হয়ে থাকি তাহলে তিনি হচ্ছেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। এ দুঃসাহসী ও দূরদর্শিনী মহিলার সার্বিক সহযোগিতা এবং হস্তক্ষেপ না হলে আমাদের স্বাধীনতা যে শুধু বিলম্ব হতো তা নয়, বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ-দুর্গতিরও সীমা থাকত না। মাত্র ৯ মাসে আমরা স্বাধীন হতে পেরেছি তার প্রধান কারণ ভারতের সহায়তা ও সশস্ত্র হস্তক্ষেপ। সে হস্তক্ষেপ মানে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। এ যুগের বিশ^ ইতিহাসের এক অসামান্যা নারী।’ এই সত্য উচ্চারণের জন্য আবুল ফজলকে গালমন্দ শুনতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি লন্ডনে প্রধানমন্ত্রী এ্যাডওয়ার্ড হিথকে আত্মবিশ্বসের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘যখনই বলব তখনই শ্রীমতী গান্ধী বাংলাদেশ থেকে তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেবেন।’ এরপর ১০ জানুয়ারি ঐতিহাসিক ভাষণের এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আমি চিনি। তাকে আমি জানাই আমার শ্রদ্ধা। তিনি পণ্ডিত জওহর লাল নেহরুর কন্যা, প-িত মতিলাল নেহরুর নাতনি। তার রক্তে মিশে রয়েছে রাজনীতি। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিশে^র সকল রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে আমার মুক্তির জন্য আবেদন করেছেন। আমার সঙ্গে দিল্লীতে শ্রীমতী গান্ধীর আলাপ হয়েছে। আমি যখনই বলব, ভারতীয় সেনাবাহিনী তখনই দেশে ফেরত যাবে। এখনই আস্তে আস্তে অনেককে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।’ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা এখানে উল্লেখ করা দরকার, প্রয়াত লন্ডন প্রবাসী লেখক আবদুল মতিন তার একটি বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে, বঙ্গবন্ধু ১৯৬২ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন এই পরিকল্পনা থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী প-িত জওহর লাল নেহরুর কাছে অস্ত্র সহযোগিতা চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন তখনকার বাঙালী-ভারতীয় হাইকমিশনার শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জির মাধ্যমে। এর উত্তরে প-িতজী বলেছিলেন, ‘ব্যক্তি বিশেষের অনুরোধে এত বড় দায়িত্ব তারা গ্রহণ করতে পারে না। ভারতের সমর্থন পেতে হলে গণআন্দোলনের মাধ্যমে শেখ সাহেবকে প্রমাণ করতে হবে, দেশের জনসাধারণ পশ্চিম পাকিস্তানের কবল থেকে মুক্তি পেতে চায়, তারা স্বাধীনতা চায়।’ (বিজয় দিবসের পর বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ-পৃষ্ঠা ৯০)। বঙ্গবন্ধু সেই পথেই অগ্রসর হয়েছিলেন। প্রমাণ করেছিলেন বাঙালীরা স্বাধীনতা চায়। যে সাহায্য চেয়ে নেহরুজীর কাছ থেকে পাননি সেই সহযোগিতা পেয়েছিলেন তারই কন্যা শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে। যেন ঐতিহাসিক যোগাযোগ। শেখ হাসিনা মনে হয় ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শটি সারা জীবনের জন্য মনে রেখেছিলেন, ‘তোমাকে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না।’ যেমন বঙ্গবন্ধু মনে রেখেছিলেন পণ্ডিত জওহর লাল নেহেরুর পরামর্শটি, ‘গণআন্দোলনের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে যে, বাঙালীরা স্বাধীনতা চায়।’ বাংলাদেশের সংকীর্ণ মনের অনেকেই মনে করে থাকে যে, ইন্দিরা পাকিস্তানকে দু’টুকরো করে দুর্বল করতেই আগ্রহী ছিলেন। অথচ বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তার এক লেখায় বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপতি গিরির আমন্ত্রণে আমার স্ত্রী ও আমি ১৯৭২ সালের শেষ দিকে ভারত সফরে গিয়েছিলাম। ভারতীয় পার্লামেন্টে বক্তৃতাদানকালে আমি বলেছিলাম, আমার দৃষ্টিতে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও বড়; তিনি নেহরুর কন্যা এবং নেহরুর পৌত্রী। আমি বলতে চেয়েছিলাম, তিনি শুধু দুনিয়ার সবচেয়ে বৃহদাকার গণতান্ত্রিক দেশের পার্লামেন্ট পদ্ধতির সরকার প্রধান ছিলেন না, মতিলাল নেহরু ও জওহর লাল নেহরুর মতো মহান দুজন নেতার গুণাবলীর উত্তরাধিকারিণীও ছিলেন। আমি যখন বললাম, আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখার পক্ষপাতী, তখন পার্লামেন্ট সদস্যরা হাততালি দিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আনন্দ প্রকাশ করেন। মিসেস গান্ধীও তাই করেন। এ ব্যাপারে রাজধানীতে আমি প্রকৃত উদ্দীপনা লক্ষ্য করেছিলাম। পরবর্তীকালে তিনি পাকিস্তানের ৯০ হাজার আত্মসমর্পণকারী সৈনিক ও অফিসারের বিচার না করে ফেরত পাঠাবার ব্যাপারে বাংলাদেশকে উৎসাহ দেন।’ (স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি ও অন্যান্যÑবাংলাদেশের জন্ম ও ইন্দিরা গান্ধীর কথা-পৃষ্ঠা ২১৪)। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকাকে দেখতে হবে বিচারপতি চৌধুরীর মূল্যায়নের দর্পণে। অন্তরের অমৃত বাণী দিয়ে বিচারপতি চৌধুরী ইন্দিরাকে মূল্যায়ন করেছেন। ইন্দিরার মতো মহীয়সী নারীকে যারা অবমূল্যায়ন করতে বিচলিত হন না তারা ভাবেন না যে, মওলানা ভাসানী ও জিয়াউর রহমানও নয় মাস ভারতে খুব আরামে ছিলেন ইন্দিরার ছায়াতলে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা অর্জনের সঙ্গে এর গৌরবের সঙ্গে ভারত ও তার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনন্য অবদান জড়িত। উল্লেখ্য, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়তাদানকালে ভারতের সেনাবাহিনীর ৩৬৩০ জন নিহত এবং ৯৮৫৬ জন আহত ও ২৩০ জন নিখোঁজ হয়েছিল। এই ত্যাগ ইন্দিরা গান্ধীর। তার মতো মহীয়সী নারীর বিচক্ষণ পদক্ষেপ ও অবদান ব্যতীত আমরা স্বাধীনতা সহজে লাভ করতে পারতাম না। তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি। লেখক : কলাম লেখক
×