ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ৩০ মে ২০২৪, ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি

ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

প্রকাশিত: ২০:৫৯, ৮ মে ২০২৪

মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি

ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

কবিগুরু ১৮৯০ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত দশটি বছর পৈতৃক জমিদারি দেখভালের সুবাদে কুষ্টিয়ায় কাটিয়েছিলেন। কবির ওপর লালনের প্রভাব তার গানের সুরে খুঁজে পাওয়া যায় এরপর থেকেই। ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গের সময় কবি লিখলেনÑ ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’, যা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বানালেন বাঙালির বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। ‘আমার সোনার বাংলা’ কবির ওপর লালনের প্রভাবের সাক্ষ্যবহ, যা প্রভাবিত করেছিল জাতির পিতাকে এবং পুরো জাতিকেই।

সেই লালন সাঁইর বহুবার গাওয়া আর শোনা আর তার চেয়েও ঢের বেশি জনপ্রিয় দুটো লাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করে বিপত্তিতে পড়েছেন শরিয়তপুরের একজন অখ্যাত যুবক। লাইন দুটো যে লালনের তা না বুঝেই নাকি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ঐ যুবককে কারাগারের চার দেওয়ালের ভেতর চালান দিয়ে এখন বিখ্যাত হয়েছেন স্থানীয় থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসেছেন অনেকেই।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের লালন সঙ্গীতের আসরের আবেদন জাতীয় শহীদ মিনারের প্রাঙ্গণ ছাপিয়ে আন্দোলিত করেছে অনেক বাঙালির বিবেককেও। প্রত্যাশা করা যেতেই পারে যে, বিষয়টির সামনেই কোনো রকমের একটা সমাধান আসবে। মুক্তি পাবেন সনাতন ধর্মাবলম্বী ঐ অখ্যাত যুবক বা হয়তো এর মধ্যে মুক্তি তিনি পেয়েও গেছেন আর প্রশমিত হবে আপাত সঞ্চারিত আবেগ, উদ্বেগ আর উত্তেজনা।

তারপর বাঙালি যথানিয়মে বিষয়টি ভুলে যাবে, যেমন তারা ভুলে গেছে ২০০৮-এ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে লালন সাঁইয়ের ভাস্কর্য ভাঙার বিষয়টিও। মামলাটি সম্ভবত চলতেই থাকবে আর ঐ অখ্যাত যুবকটি সবার দৃষ্টি আর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুর পরিধির অনেক বাইরে থেকে মামলায় হাজিরা দিতে দিতে হয়রানিতে ভুগতেই থাকবে। নিকট এবং দূর অতীতের এমনি অনেক ঘটনার অভিজ্ঞতা থেকেই আমাদের এমন ধারণা। 
প্রশ্ন এটি নয়, প্রশ্ন হচ্ছে, ১৯৭১-এ সব নির্ধারিত হয়ে যাওয়ার তেপ্পান্ন বছর পর এমনটি যে হওয়ার কথা ছিল না, তা তো ঠিকই আছে। কিন্তু এমনটা হচ্ছে কেন? দায়িত্বটা কার, আপনার, আমার, না রাষ্ট্রের? আমরা যারা সুশীল, তারা প্রায়ই রাষ্ট্রের ঘাড়ে দায়টা চাপিয়ে স্বস্তিতে ঘুমাতে যাই। দায়টা যে কিছুটা হলেও রাষ্ট্রের, তাতে সন্দেহের কোনোই অবকাশ নেই। একটি সমাজে মানুষ কিভাবে ভাববে-চলবে রাষ্ট্রযন্ত্র তা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে।

ইতিহাস তা-ই সাক্ষী দেয়, যেমনটি সাক্ষী দেয় আমাদের এই অঞ্চলের ইতিহাসও। স¤্রাট অশোক যখন ভারত অধিপতি, তখনও আমরা এমন উদাহরণ দেখেছি। অশোকের আগে এ অঞ্চলে প্রায় ছ’শ’ বছর শাসন করেছেন পারস্যের শাসকরা, যারা শকাব্দের প্রবর্তন করেছিলেন। শকরা ছিলেন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা আর দারুণ চতুর শাসক। শকাব্দের পাশাপাশি এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে তারা পারস্য থেকেই আমদানি করা গাঁজার প্রবর্তন করেছিলেন, যাতে মানুষ গাঁজার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে আর তারা তাদের শাসন কাজটা নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে পারেন।

শকদের আগে এ অঞ্চলে গাঁজার গাছ পাওয়া যেত না। শাসক চাইলে যেমন জাতিকে নেশায় বুঁদ করতে পারেন, তেমনি এর উল্টোটাও যে শাসকের ইচ্ছাতেই সম্ভব, তার উদাহরণ স¤্রাট অশোকের শাসন। কৌলিঙ্গ যুদ্ধের নৃশংস ভয়াবহতায় লক্ষাধিক ভারতীয়র মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে প্রায় আশি সহ¯্রাধিক অনুশাসন জারি করে স¤্রাট অশোক পুরো ভারতে এক অভূতপূর্ব শান্তি আর সাম্যের বাতায়ন সৃষ্টি করেছিলেন।

আবার স¤্রাট অশোক পরবর্তী সময়, এ অঞ্চলে যখন কর্নাটকের সেন রাজবংশের শাসন, তখন আমরা আবার শাসকের ইচ্ছায় প্রগতিশীলতার চাকাকে উল্টোদিকে ঘুরতে দেখলাম। রাজা বল্লাল সেন এ অঞ্চলে প্রচলন করেন গৌড়িদানের, অর্থাৎ পিতা পাত্রের হাতে কন্যাদান করবেন। বল্লাল সেন এমন একটা সমাজে গৌড়িদানের প্রচলন করেছিলেন, যেখানে আগে প্রচলন ছিল স্বয়ংবর সভার, অর্থাৎ কনে নিজে তার বর বেছে নিতেন। শুধু তাই নয়, বল্লাল সেনের সময়ই ‘বর’ অর্থাৎ ¯্রষ্টার উপহার রূপান্তরিত হলো ‘স্বামী’ অর্থাৎ প্রভুতে। এভাবেই একটি প্রগতিশীল সমাজকে আবারও অন্ধকারের অন্ধকূপে ঠেলে দিয়েছিলেন শাসককুল। 
শক-অশোক-সেন পর্যন্ত যাওয়ার প্রয়োজন নেই। হাল জমানায় কদিন আগের বাংলাদেশেই আমরা এর উদাহরণ দেখেছি। কার্ল মার্কস বলেছিলেন, ধর্ম হচ্ছে আফিমের মতো। মার্কসের সঙ্গে সবিনয় দ্বিমত করেও স্বীকার করতেই হচ্ছে যে, শাসক চাইলে ধর্মের মতো মহান বিষয়কেও সমাজকে বিভ্রান্ত করায় ব্যবহার করতেই পারেন। যেমনটি করেছিলেন এদেশের পঁচাত্তর পরবর্তী জিয়া-খালেদা-এরশাদসহ একের পর এক শাসক।

এদের আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে বাংলা আর বাঙালি হারিয়েছিল বাঙালিয়ানা। ঢাকাই চলচ্চিত্র যেমন ‘ওরা এগারো জন’, ‘সুতরাং’ আর ‘আবার তোরা মানুষ হ’ থেকে পিছলে গিয়ে হয়েছিল ‘হুরে আরব’ আর ‘বানজারান’-এ, তেমনি যাত্রাপালায় ‘বিবেকের’ জায়গা দখলে নিয়েছিল প্রিন্সেস লাকি খান-মালা খানরা। অতঃপর গ্রামের শীতের রাতে যাত্রার বিসর্জনে সেখানে পাকাপোক্তভাবে আসীন হয়েছিল ধর্মীয় ওয়াজ মাহফিল।

ইতিহাসের শিক্ষা বলছে আজকের পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে হলে চাই অনুকূল শাসকের শাসন। আমরা তাহলে সেই প্রেক্ষাপটে এখন কোথায় আছি? মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের টানা শাসনের সুফল এখন আমাদের চোখের সামনে মেট্রোরেল আর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতেই প্রতিভাত। তবে কেন মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে লালনের পরাজয় ঘটবে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তো বাঙালির জাতির পিতা আর তাঁর পিতার আদর্শে উজ্জীবিত। দর্শনে দীক্ষিত। পিতার স্বপ্নের বাংলাদেশ বাস্তবায়নে অবিচলভাবে প্রতিশ্রুত। তারপরও তাল আর লয়ে কেন এই ছন্দপতন? এর উত্তরও আছে ইতিহাসের শিক্ষাতেই। 
ধর্মের তিনটি মুখ্য বিষয় আছে। প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণটি হলো ‘¯্রষ্টা’। একজন ধার্মিক মুসলমান হিসেবে আমার আনুগত্য এক আল্লাহর প্রতি। অন্যদিকে, সনাতন ধর্মাবলম্বীর বিশ্বাস ভগবানে। সমস্যা বাধে ধর্মের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিষয় দুটি নিয়ে। ধর্মের দ্বিতীয় সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে মানুষের কল্যাণ। এই একটি জায়গায় পৃথিবীর তাবৎ ধর্মই এক। কোনো ধর্মের সঙ্গেই এই একটি বিষয় সাংঘর্ষিক নয়। ধর্মের অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে ধর্ম পালনের আচারগুলো।

মুসলমান হিসেবে আমরা দিনে পাঁচবার নামাজ পড়ি আর রমজানে রাখি রোজা। অন্যদিকে সনাতন ধর্মাবলম্বীর মূল ধর্মাচার পূজা-অর্চনা। ধর্মের এই তৃতীয় বিষয়টি যে সমাজে দ্বিতীয় বিষয়টিকে ছাপিয়ে যায়, সেই সমাজে দেখা দেয় বিরোধ। আর চতুর শাসককুল সমাজকে বিভাজিত করে উল্টোপথে চালিত করায় যুগে যুগে এই কাজটাই করে এসেছেন। বাঙালি জাতিকে হিন্দু আর মুসলমানে বিভাজিত করে ব্রিটিশদের বঙ্গভঙ্গ, মুসলিম লীগের দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ আর জিয়া-খালেদা-এরশাদ চক্রের জয় বাংলাকে বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ কায়েম, এসবই একই সুতায় গাঁথা বিনি সুতার মালা। তবে এই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটানোটা রাষ্ট্রের একক দায়িত্ব নয়।
সংস্কৃতি হচ্ছে লক্ষ্য আর রাজনীতি হচ্ছে সেই লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যম। এই দুইয়ের সমন্বয় ছাড়া চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্থাৎ  জাতির সত্যিকারের মুক্তি অর্জন অসম্ভব। এ দুটো বিষয় রেললাইনের মতই একই সমান্তরালে চলমান। দুটোর একটিতেও যদি ব্যত্যয় ঘটে, তাতেই লক্ষ্যচ্যুতি ঘটতে বাধ্য। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আজ রাষ্ট্রক্ষমতায় আছেন বলেই তাল-লয় কেটে যাওয়ার পরও আমরা সম্ভবত আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যটা অর্জনের স্বপ্নের জালটা এখনও বুনতেই পারি। কিন্তু শুধু তার ওপর নির্ভর করে নির্ভার থাকলেই চলবে না।

উন্নয়নের মহাসড়কে ছুটতে গিয়ে আমরা যদি আত্মতুষ্টিতে আক্রান্ত হই, তবে এই গতিজড়তা সহসাই স্থিতিজড়তায় রূপ নিতে বেশি সময় নেবে না। আমাদের সৌভাগ্য যে, শক শাসন আমাদের জমানায় ছ’শ’ বছর মেয়াদী না হয়ে বরং মাত্র কটি দশক স্থায়ী হয়েছে। আর একজন অশোকতুল্য মহামতির জন্য আমাদের অপেক্ষাও শতকের পর শতকব্যাপী হয়নি। আমরা এখন আমাদের ভবিতব্য কিভাবে নির্ধারণ করব তা আমাদের, অর্থাৎ বাঙালি মধ্যবিত্ত আর বাঙালি সুশীল সমাজের হাতে।

আমরা যদি শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে পারি ক্রমাগত, আর অবিরত বাঙালিয়ানা আর বাঙালিপনা চর্চায়, তবে ভূত বলছে আমাদের ভবিষ্যৎ হতে পারে অন্যরকম। আর আমরা যদি আমাদের এই দায়িত্বটুকু পালনে ব্যর্থ হই, তবে আমরা সম্ভবত একটি ভূতুড়ে ভবিষ্যতের দিকেই ধাবিত হচ্ছি। আসুন, সবাই ‘মানুষ ভজি’, কারণ, তাতেই সোনার মানুষ হওয়া সম্ভব।

লেখক : অধ্যাপক, ডিভিশন প্রধান
ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও 
সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

×