ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সঞ্জয় সরকার

দীন শরৎ বলে

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

দীন শরৎ বলে

গুরু উপায় বলো না/জনমদুঃখী কপাল পোড়া/আমি একজনা—- এরকম অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্র্রষ্টা বাউল সাধক দীন শরৎ। বিশ শতকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এই বাউল-কবির গান হাজারও শ্র্রোতাকে মুগ্ধ করেছে। বিশেষ করে দেশের বৃহৎ ভাটি-বাংলার মানুষ তার গান শুনে অভিভূত, রোমাঞ্চিত ও আপ্লুত হয়েছেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে দীন শরৎ এক বিস্মৃতপ্রায় নাম। কালের প্রবাহে ও লোকচক্ষুর অন্তরালে হারিয়ে যাওয়া এই বাউল কবিকে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে এক প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছেন তরুণ লেখক পার্থ তালুকদার। দীন শরৎ-এর জীবন ও গানের ভা-ারকে একত্রে সন্নিবেশিত করে তিনি লিখেছেন ‘দীন শরৎ বলে’ নামে একটি বই। গত (২০১৭) বইমেলায় রোদেলা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে ছয় ফর্মার বইটি। পেশায় ব্যাংকার হলেও লেখায় বেশ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন তরুণ গবেষক পার্থ। ‘দীন শরৎ বলে’ বই পাঠে আমরা জানতে পারি, হৃদয়ে পাহাড়সম দুঃখ নিয়ে তিনি গান রচনা করেছেন। দারিদ্র্যর কালোমেঘে প্রায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল তার মেধাজ্ঞান। কিন্তু আপন মহিমায় দারিদ্র্যর কূল-কিনারাহীন সাগর পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। গানের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছিলেন জীবনের পরম সত্যকে। জানা যায়, সীমাহীন কষ্টের ভার ভুলতেই বাল্যকাল থেকে তিনি মুখে মুখে গান রচনা করতেন। রচনার পর তাতে সুর দিয়ে লোকজনকে গেয়ে শোনাতেন। আর এ বাড়ি-ও বাড়ি ঘুরে বেঁচে থাকার অবলম্বন সংস্থান করতেন। এভাবে গান গাইতে গাইতে এক সময় তার বেশকিছু সঙ্গী-সাথী জুটে যায়। সেই সঙ্গীদের দিয়েই তিনি গানগুলো কাগজে টুকে রাখতেন। এভাবে দিনে দিনে সমৃদ্ধ হয় তার বিশাল গানের ভা-ারটি। জানা যায়, একটু বড় হওয়ার পর হবিগঞ্জের বিতঙ্গল (বিথলং) আখড়ার প্রতিষ্ঠাতা রামকৃষ্ণ গোস্বামীর সাক্ষাত পান তিনি। রামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে তার মনে ভক্তিবাদের উদয় হয়। এ জন্য তার বহু গানে বৈষ্ণব ভাবধারার সন্ধান পাওয়া যায়। রাধাকৃষ্ণের রাগ-অনুরাগ, মিলন-বিরহ, মান-অভিমান বিশেষভাবে প্রাধান্য পেয়েছে তার গানে। যেমনÑ আমার সাধের শ্যাম সুখ পাখিটা উড়ে গেল কই/ সখি বলগো তোরা ত্বরা করে/ শ্যামের শোক কেমনে সই’। লালনপন্থী বাউলদের মাঝে যেমন সাধনসঙ্গী ও ভেক খিলাফত গ্রহণের রেওয়াজ প্রচলিত ছিল তেমনি নেত্রকোনা অঞ্চলের গৃহী বাউলদের মধ্যে প্রচলন ছিল পীর-ফকির ও সাধু-গুরুর দীক্ষা গ্রহণের। বাউল দীনশরৎও ছিলেন একজন গৃহী বাউল। রামকৃষ্ণের সান্নিধ্য গ্রহণ ছাড়াও তিনি ভারত গোস্বামীর কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। একটা সময়ে এসে শিষ্য-প্রশিষ্যদের মাধ্যমে দীন শরৎ-এর গান সমগ্র ভাটি মুল্লুকে ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ বিস্ময়ে তাকায় এই অন্ধ সাধকের দিকে। গানই হয়ে দাঁড়ায় তার জীবন-জীবিকার অবলম্বন। এরই মাঝে তার ছন্নছাড়া জীবনে কিছুটা সুখের হাওয়াও লাগতে শুরু করে। দীন শরৎ-এর গান শুনে একদিন মুগ্ধ হন নিজ গ্রামের বাসিন্দা অবিভক্ত বাংলার অর্থমন্ত্রী নলিনীরঞ্জন সরকার। তিনি তাকে তার বাড়িতে আশ্রয় দেন। শুধু তাই না, তাকে কলকাতায় নিয়ে যাবারও ব্যবস্থা করেন। মূলত নলিনীরঞ্জন সরকারের সান্নিধ্যে আসার পরই তার বাউল-প্রতিভা বৃহৎ পরিসরে বিস্তৃত করার সুযোগ আসে। নলিনীরঞ্জনের ভাই পবিত্ররঞ্জন সরকারের সহযোগিতায় কলকাতা থেকে ‘দীন শরতের বাউল গান’ নামে প্রথম গানের সঙ্কলন প্রকাশিত হয়। বইটির অধিকাংশ গান দেহতত্ত্ব, পঞ্চতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব ও পরমার্থতত্ত্ব বিষয়ক। এছাড়া রয়েছে বৈষ্ণব সাধন পদ্ধতি, গৌরনিতাই ও রাধাকৃষ্ণতত্ত্ব বিষয়ক গান। এসব গানে প্রচুর সংস্কৃত শ্লোক ও এসবের ব্যাখ্যা রয়েছে। ‘দীন শরতের বাউল গান’ বইয়ের ভূমিকায় কলকাতার শ্রী কামিনী কুমার কর রায় লিখেছেন ‘‘কোন প্রাচীন পুঁথিতে সংস্কৃত শ্লোক পাইলেই আমরা সেই পুঁথির রচককে অসাধারণ সংস্কৃতজ্ঞ প-িত বলিয়া মনে করি। কিন্তু ‘দীন শরতের বাউল গান’ আমাদিগকে এইরূপ ধারণার ব্যাপারে সাবধান করিয়া দিতেছে। সংস্কৃত না জানিয়াও যে সংস্কৃত শ্লোকাদি লিখা ও ব্যাখ্যাা করা যায়, তাহা আমরা ‘দীন শরৎ’ হইতেই বুঝিতেছি।’’ প্রথম বই প্রকাশের কিছুকাল পরে ‘দীন শরতের এসলাম সঙ্গীত’ ও ‘গৌরগীতিকা’ নামে আরও দু’টি গানের সঙ্কলন প্রকাশিত হয়। ‘এসলাম সঙ্গীত’ দীন শরৎ-এর বিস্ময়কর সৃষ্টি। এ বইয়ের গানগুলোতে সৃষ্টিকর্তার মহিমাগীতি, অজুদনামা বা দেহতত্ত্ব, নূরভাগ, আদমতত্ত্ব, মৌতনামা, নামাজনামা, আখেরতত্ত্বসহ ইসলাম ধর্মের খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে গান রচনা করে সমাজে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বীজ বপন করতে চেয়েছেন এই সাধক। ভাটি অঞ্চলের অন্যতম লোকসঙ্গীত (কারও কারও মতে লোকনৃত্য) ধামাইল গান। প্রচুর ধামাইল গানও রচনা করেছেন এই লোককবি। বলাবহুল্য, দীন শরৎ বর্তমানকালে এক বিস্মৃতপ্রায় নাম। আজকালকার বাউল বা শিল্পীদের কণ্ঠে খুব কমই তার গান শোনা যায়। এছাড়া তার গান সংগ্রহ বা প্রচারেরও উদ্যোগ নেয়নি কেউ। যতদূর জানা যায় সত্তর আশির দশকে চিত্র পরিচালক কামাল আহমেদ তার ‘পুত্রবধূ’ চলচিত্রে ‘গুরু উপায় বলো না’ গানটি ব্যবহার করেন। শিল্পী মলয় কুমার গাঙ্গুলির গাওয়া এ গানটি আজও জনপ্রিয়। অনুমান করি, দীন শরৎ এমন আরও অনেক গান আছে- যা শ্রোতাদের হৃদয় আকৃষ্ট করবে। কিন্তু দায়িত্বটি গ্রহণ করবেন কে? তরুণ লেখক পার্থ তালুকদারকে ধন্যবাদÑ বিস্মৃৃতপ্রায় এই লোককবিকে কিছুটা সামনে আনার জন্য। প্রসঙ্গত, বইটির কভার, বাঁধাই এবং মুদ্রণ বেশ পরিপাটি। বাউলের হাতে একতারা সম্বলিত দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ এঁকে বইটির শ্রীবৃদ্ধি করেছেন কাব্য করিম। ৯৬ পৃষ্ঠার বইটির দাম ধরা হয়েছে মাত্র ১শ’ ৬৫ টাকা। বিশ্বাস করি তথ্যসমৃদ্ধ বইটি পাঠের পর পাঠকমাত্রই পার্থ তালুকদারের প্রশংসা করবেন।
×