ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

রবিউল হুসাইন

স্রষ্টা ও শিল্পী নিতুন কুণ্ডু স্মরণে

প্রকাশিত: ০৩:২৭, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

স্রষ্টা ও শিল্পী নিতুন কুণ্ডু স্মরণে

বাংলাদেশের শিল্পজগতে মুক্তিযোদ্ধা, স্রষ্টা ও শিল্প উদ্যোক্তা, বহু গুণে গুণাম্বিত এবং শিল্পী নিতুন কুন্ডু- একজন ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। এরকম কাজপাগল, শ্রমনিষ্ঠ, প্রতিভাবান শিল্পী দেখা যায় না সচরাচর। নিজের প্রবল একাগ্রতা, লক্ষ্যভেদী দূরদৃষ্টি ও অনুপম সৃষ্টিশীলতা নিয়ে তার কাক্সিক্ষত জায়গায় পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিলেন। বলা যায়, শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করে তিনি বিশাল মহীরুহে নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় করতে পেরেছিলেন। মূলত তিনি একজন প্রতিভাবান চিত্রশিল্পী ছিলেন। পাশাপাশি ভাস্কর্যে তার ঈর্ষণীয় ক্ষমতা কাজের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন। আজীবন জেদি, সংগ্রামী ও লড়াকু জীবন কাটিয়েছেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসান ও মরমী শিল্পী সফিউদ্দিন আহমেদের প্রিয় ছাত্র ছিলেন এবং ছিলেন সবসময় সর্বোচ্চ স্থানের অধিকারী। এদেশের শিল্পজগতে শিল্পী নিতুন কু-ুর সবচেয়ে বড় অবদান ছিল এমন যে, তিনি শিল্পকর্মকে শিল্পীর ক্যানভাস থেকে তুলে নিয়ে ফলিত বা ব্যবহারিক গুণে উদ্ভাসিত করতে পেরেছিলেন। ‘রঙতুলি, রেখা, বুনন শুধু চিত্রপটেই রইবে’- এই ধারণাকে শিল্পী টেনে নিয়ে চারদিকে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের অনুষঙ্গের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। ‘সৌন্দর্য বা নান্দনিক বোধ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োজন শুধু ক্যানভাসেই সীমাবদ্ধ হয়ে রইবে না’ - এই সৌন্দর্যানুভূতির চর্চা করার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রয়োগ এবং বাস্তবায়ন করেছেন খুব সফলভাবে। ‘সুন্দর করে বেঁচে থাকার অনাবিল আনন্দ উপভোগ করতে ঘরের সৌন্দর্য রক্ষা আর বৃদ্ধি করা দরকার’- এই মূল বিষয়টি প্রয়োজনীয় উপাদান কী এর উত্তরে ঘরের আসবাবপত্রকে প্রাধান্য দিয়েছেন। সেই লক্ষ্যে তিনি আসবাবপত্র, যেমন চেয়ার, টেবিল, সোফা, খাট, আলমারি- প্রতিটি জিনিসকে শিল্পমন্ডিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। সেগুলো নান্দনিক দিক থেকে যেমন সুন্দর হবে, সঙ্গে সঙ্গে হবে ব্যবহারোপযোগী এবং টেকসই। এসব নকশা ও তার বাস্তবায়ন করার জন্য তিনি ‘অটবি’ নামে বিশাল শিল্পসাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। তা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান শিল্পকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে এবং অটবির সামগ্রী এখন ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ ও মিয়ানমারে বিস্তৃত হয়েছে। বিষয়টি খুব গর্ব ও অহঙ্কারের। আমাদের দেশের শিল্পসামগ্রী নিজেদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় যে বিদেশে প্রচার এবং বিপণন হচ্ছে তা অবশ্যই শ্লাঘার বিষয়। একজন শিল্পীর পক্ষে বিষয়টি খুবই চমকপ্রদ ও ব্যতিক্রমী। শিল্পী নিতুন কুন্ডু চিত্রকর্ম যা আমরা দেখেছি তাতে প্রমাণিত হয়, তিনি যেমন উঁচু দরের বাস্তবধর্মী শিল্পী, তেমনি বিমূর্ত প্রকাশবাদীও। ছবির মধ্যে তার পেলব রং ব্যবহার, ¯িœগ্ধ, শীতল ও রোমান্টিক আবহ নির্মাণের শিল্পকুশলতা, জ্যামিতিক গঠনের প্রতি এক ধরনের কৌণিক ত্রিভুজাকৃতির শিল্পসুষমা দ্বারা দৃঢ়-কঠিন অথচ নরম অনুভূতির সারৎসার খুঁজে পাওয়া যেত। একজন শিল্পীর অন্তর্দৃষ্টি, অন্তর্মুখী খুঁটিনাটি দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিষয় সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা- এসবই তাঁকে যন্ত্রশিল্পের মধ্যে যে আপাতকাঠিন্য বিরাজ করে তার মধ্য থেকে সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছে। সার্ক ফোয়ারা, কদমফুল ফোয়ারা ইত্যদির মাঝে সেই নান্দনিকতা, যাকে বলা যায় যন্ত্রসৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায়। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তার দুটি পোস্টার একটি এক টগবগে যুবকের রাইফেল কাঁধে দৃঢ়-কঠিন মুখাবয়ব দেশের স্বাধীনতার জন্য, আর একটি একজন ¯ স্নেহশীলা অকুতোভয় মুক্তিকামী মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতি স্থায়ী হয়ে আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চিত্রকর্মে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাবাশ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য শিল্পের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্প নিদর্শন, যেখানে সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে অনুপম সৃষ্টি দেখা যায়। অস্থির গতিচাঞ্চল্য এবং সর্বোপরি দেশের প্রতি মুক্তিযোদ্ধার দৃঢ় অঙ্গীকার ও লক্ষ্য খুব বলিষ্ঠভাবে ফুটে উঠেছে। লাল বেলে পাথরের মতো ভাস্কর্যের রং, মুক্তিযোদ্ধা দামাল ছেলেদের গাত্রবর্ণ, সামনের দিকে দৃষ্টি, অকুতোভয় মনোবল সব প্রকাশ পেয়েছে এবং সেইসঙ্গে শত্রুর প্রতি জানবাজি রেখে সংগ্রামের ইস্পাত-কঠিন প্রত্যয়ও। এভাবে তিনি তার শৈল্পিক অনুপম সৃষ্টিশীলতা সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে, বিশেষ করে স্বাধীনতা-পূর্ব আমলের প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানে তার দ্বারা মঞ্চ, পোস্টার, রাস্তার মোড়ে ব্যানার বা শিল্পকর্ম ছাড়া সেগুলো কখনও পূর্ণতা পেত না। শিল্পী নিতুন কুণ্ডু তাঁর সৃষ্টিকর্ম দ্বারা বলা যায় আমাদের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোকে শিল্পসুষমায় পর্যবসিত করার জন্য বিরাট অবদান এবং এ বিষয়ে সত্যিকারের অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর এই চলে যাওয়া খুবই আকস্মিক। হৃদরোগী ছিলেন বহুদিন, সার্ক ফোয়ারা নির্মাণের সময় তাঁর প্রথম আক্রমণ হয়। অমানুষিকভাবে দিনের পর দিন পরিশ্রম করতে পারতেন। দিনাজপুর শহরের এক মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা একজন যুবক সারাটি জীবন সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে করে জীবনকে যেমন পরাস্ত করতে পেরেছিলেন জীবনযুদ্ধে, তেমনি তিনি শিল্পজগতের দুটো দিক- একটি বাণিজ্যশিল্প আর একটি চারু, কারু ও ভাস্কর্যশিল্পকে অসামান্য আপন প্রতিভাবলে শাসন করার দুর্লভ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে আমি তার একজন স্নেহধন্য পারিবারিক স্বজন হিসেবে খুব ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ ও সৌভাগ্য লাভ করেছিলাম। তার এই অসময়ের তিরোধান খুবই আকস্মিক ও অভাবনীয়। তার অনুপস্থিতিতে দেশ, সমাজ, বিশেষ করে সাংস্কৃতিক জগতে যে বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। তার সুন্দর ব্যবহার, প্রাণচাঞ্চল্যভরা হাসি, পরোপকারী হৃদয়বেত্তা, সর্বোপরি উদার প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা ও দেশপ্রেম সব সময় আমাদের অনুপ্রেরণা জোগাবে। তার পরম ভালবাসা ও যাবতীয় কর্মদ্যোগের অনুপ্রেরণা এবং উৎসাহের উৎস জীবন সাথী প্রিয়তমা ফালগুনী বৌদি, প্রিয়তম অনিমেষ বাবু আর বুকের ধন অমিতি মা-মণি এবং অটবির অসংখ্য উদ্যমী কর্মী-সহযোগীবৃন্দ তার অনুপস্থিতিতে যেন সামনের ভবিষ্যত যাত্রার পথ ধরে সুন্দর করে এগিয়ে যেতে পারেন সেই সার্থকতাই সবার প্রিয় নিতুনদাকে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখবে। আজ এই ১১তম মহাপ্রয়াণ বার্ষিকীর দিনে তাকে হৃদয় ও মনের ভেতরে নিয়ে পরম শ্রদ্ধা এবং সম্মান জানিয়ে সবার সঙ্গে নিবিড়ভাবে স্মরণ করি। লেখক : স্থপতি
×