ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুমাইয়া ইসলাম নিপা

বিষণ্ণ আবেগের প্রকাশ

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ৪ আগস্ট ২০১৭

বিষণ্ণ আবেগের প্রকাশ

ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গগ ছিলেন একনিষ্ঠ, বুদ্ধিমান, ¯পর্শকাতর, হৃদয়বান, সুপাঠক, বিদ্রোহী ও একরোখা। কয়েক দশকব্যাপী মিথের যে বেড়াজাল তাকে আড়াল করে রেখেছে প্রকৃতপক্ষে তার চেয়েও অনেক বেশি চমকপদ তাঁর জীবন। তাঁর জীবন কখনও খুবই করুণ, কখনও ছিলেন প্রেমাহত, সব সময় কোন না কোন ক্ষেত্রে পাগলের মতো নিবিষ্ট, কখনও একেবারে উন্মাদ। সাহিত্য ও শিল্পকলা ছিল তাঁর সার্বক্ষণিক সহযোগী। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে দামী চিত্রকর্মগুলোর মাঝে ভ্যান গগের কাজগুলোকে বিবেচনা করা হয়। রুক্ষ সৌন্দর্যের এবং আবেগময় সততার প্রকাশ, সপ্রতিভ রঙের ব্যবহারের কারণে তাঁর কাজ বিখ্যাত ছিল যা বিংশ শতাব্দীর শিল্পকলায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখেছিল। রঙের মাধ্যমেই তিনি তাঁর মনের ভাব প্রকাশ করতেন। মোটা করে রং লাগানো, আকার-আকৃতি নির্মাণ, ক্ষিপ্রতা ও গতিময়তা ছিল তাঁর ছবির প্রধান বৈশিষ্ট্য। কোন কোন সময় তুলির সাহায্যে রং ব্যবহার না করে ক্যানভাসের ওপর সরাসরি টিউব টিপে রং প্রয়োগ করেছেন। ফলে ছবির জমিন হয়েছে উঁচু নিচু, অনেকটা চাষ দেওয়া জমির মতো। ১৮৮৮ সালে আঁকা তাঁর দ্যা নাইট ক্যাফে ছবিতে বরাবরের মতো অস্থির ব্রাশ স্ট্রোক রেখে গেছেন। এই উল্লেখযোগ্য কাজটিতে তাঁর মতে শয়তানের পরিবেশ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। চিত্রে উপস্থাপিত তীর্যক সূক্ষ্ম ব্রাশ স্ট্রোকগুলো জাপানী উড ব্লকের প্রতি তাঁর দুর্বলতার প্রতীক বহন করে। এখানে রঙের ইচ্ছামতো ভাঙচুর লক্ষ্য করা যায়। ক্যানভাসে যেন রঙের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। মোটাভাবে রং চাপানোর উদ্দেশ্য হলো নিজেকে জোড়ের সঙ্গে প্রকাশ করা। এই পুরু রং লেপন এক চকচকে আভার অনুভূতি দেয়। চিত্রটিতে একটি বিষণœ প্রাদেশিক শহরের রেস্তোরাঁর অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জাসহ তার পরিবেশের নমুনা রচনা করা হয়েছে। মৌলিক রঙে রঞ্জিত চিত্রটি। লাল, সবুজ, হলুদ, নীল ও বেগুনী তীব্র রংগুলোর উপস্থিতিতে বন্য সংমিশ্রণের সমাবেশ ঘটেছে। চিত্রটিতে সবুজ ও লাল রং দিয়ে মানুষের দুর্দমনীয় আবেগকে রচনা করেছেন। সিলিং সবুজ ও দেয়াল রক্তিম লাল রঙে আবৃত। মেঝেতে গ্যাস লণ্ঠনগুলোর হলুদ ছোঁয়া কমলাটে মোহ সৃষ্টি করেছে। জাপানী সংস্কৃতিতে হলুদের প্রতীকী অর্থ বন্ধুত্ব। তাইতো হলুদের প্রতি শিল্পীর এত দুর্বলতা। লণ্ঠনগুলো থেকে কমলা হলদেটে সবুজ আলো ছড়িয়ে পড়ার অনুভূতিকে জাগ্রত করেছেন দক্ষতার সহিত তাঁর নিজস্ব যবুথবু স্ট্রোক দিয়ে। পাঁচজন মাতাল ব্যক্তির উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয় ক্যাফের অভ্যন্তরের দু’পাশের দেয়াল ঘেঁষে দেয়া চেয়ার টেবিলগুলোতে। মাতাল মোহে আবৃষ্ট ঘুমন্ত ব্যক্তিদের বেগুনী রঙে ছোট ছোট করে আঁকা হয়েছে। ক্যাফের ওয়েটারকে সাদা কোটে দেখা যায় মাঝ বরাবর সবুজ বিলিয়ার্ড টেবিলের পাশে। তার পোশাকে লাইটের আলোর হলদেটে আভা বিরাজমান। গভীর রাতের পরিবেশ প্রমাণ বহন করে দেয়ালে ঝুলানো ঘড়ির রাত বার টার কাঁটা। শিল্পী এই চিত্র স¤পর্কে বলেছেন- ক্যাফে এমন একটি জায়গা যেখানে লোক নিঃস্ব হয়, উন্মাদ হয় এবং অপরাধ ঘটায়। লোকে যেন নরকে যাবার আগে এই সালফারপূর্ণ ঘরে আসে। যেমন ছিল ঠিক তেমনই সেই নিচু শ্রেণীর মানুষদের অন্ধকার জগৎকে রঙের বৈপরীত্যে তুলে ধরতে চেয়েছি। শিল্পী চিত্র রচনায় পরিপ্রেক্ষিতের ব্যাপারে উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছেন, বিলিয়ার্ড টেবিলের পায়াগুলোর সঙ্গে সঙ্গে মেঝের রং লেপনের লাইনগুলোর দ্বারা। দূরে বসা দুজন ব্যক্তির উপস্থাপন এবং সার্বিক পরিবেশ, নিচুতা, হীনতা সমাজের নেতিবাচক পরিস্থিতি এবং ক্যাফেতে বারবণিতাদের আগমনের সাক্ষ্য দিয়ে যায়। চিত্রটিতে জাপানী প্রিন্টের উল্লাস ও টারটারিনের ভাল বৈশিষ্ট্যগুলো দিয়ে এক বিষণœ তন্দ্রালুতা ও অরুচিকর বিরক্ত পরিবেশের উপস্থাপন ঘটেছে। তেল রঙে আঁকা চিত্রটিতে সমাজের এক শ্রেণীর মানুষের ছেড়া, বিচ্ছিন্ন, উগ্র মানসিকতার বর্ণনা একটি ক্যাফে অভ্যন্তরীণ ফ্রেমে বন্দী করেছেন। সৌন্দর্য ও আবেগ মন্থিত সত্যের এবং দ্রোহের যোজনা করেছেন তাঁর এ চিত্রে রঙের ভাঁজে ভাঁজে। ছবিটি অস্বাভাবিক অস্থির সত্তার সঙ্গে আলো, রং ও মানসিকতার তীব্র উদ্দীপকের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার শৈল্পিক ফসল।
×