ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ খেলা বনাম দেশপ্রেম

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ৯ জুলাই ২০১৭

সিডনির মেলব্যাগ ॥ খেলা বনাম দেশপ্রেম

ভাবছি ক্রিকেট খেলাই আর দেখব না। দেখুন তো কি কা-। কোথায় বিলেতের মাঠে ফাইনাল খেলল ভারত পাকিস্তান আর সমস্ত উত্তেজনা এসে ভর করল পদ্মাপাড়ে। খেলার উত্তেজনা শরীরের জন্য ভাল। মনের জন্য উত্তম। কিন্তু এতো খেলার উত্তেজনা না। এর মূল কারণ রাজনীতি। না সত্য বলব আজ। রাজনীতিও না। এর কারণ সাম্প্রদায়িকতা। কবে আমরা কখন পাল্টে গেছি নিজেরাও জানি না। আজকের বাংলাদেশে ভারত পাকিস্তান এমন দুই দেশ এমন দুই শক্তি যাদের বাদ দিয়ে আমাদের আনন্দ বেদনা খাওয়া বা ধর্ম কিছুই জায়েজ হয় না। বলব এ রোগ পুরনো। কারণ আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র আমাদের বন্ধুদের দেখেছি ট্রানজিস্টারে কান লাগিয়ে শুনছে ক্রিকেটের ধারাভাষ্য। দৌড়ে গিয়ে প্রশ্ন করেছি, কি খবর? স্কোর কি এখন? আমাদের স্তব্ধ করে দিয়ে উত্তর এসেছে, তোর জন্য ভাল আমাদের জন্য খারাপ। মানে? মানে গাভাসকার সেঞ্চুরি করেছে। পাকিস্তানের জন্য ভাল না খবর। তখন থেকেই ধরে নেয়া হয়েছে আমার নাম ও সম্প্রদায়গত পরিচয়ের কারণে আমি ভারতের সমর্থক। নিজের কথা বলে নেই। আমি ক্রিকেটের পোকা ছিলাম। ক্রিকেটের সোনালী অতীতে রেডিওতে অসাধারণ ধারাভাষ্য শোনা মানুষ আমরা। পুষ্পেন বাবুর কবিতা মাখানো ক্রিকেট কমেন্টারির ভক্ত। ক্রমে সেদিন গেল, এলো টিভির যুগ। ঘরে বাইরে অফিসে ক্রিকেট কেন জানি জনপ্রিয় হয়ে উঠল সবকিছু ছাপিয়ে। সারজায় ভারত বনাম পাকিস্তানের খেলা। অফিসে আমি বা আমার মতো গোটা দুই মুসলমান বন্ধু একদিকে, বাকিরা আরেকদিকে। আমি জানতে চেয়েও উত্তর পাইনি। যারা বলেন রাজনীতি, আমি তাদের সঙ্গে একমত হতে পারি না। রাজনীতি যদি হবে, তো আওয়ামী লীগের মেয়র কি করে পাকিস্তানের জন্য পাগলামী করেন? কিভাবে আওয়ামী লীগের লোকজন দলবেঁধে পাকিস্তানের ফেভারে মিছিল করে? যারা বলেন ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভূমিকা ভারত বিদ্বেষের জন্য দায়ী, তাদের কাছে প্রশ্ন রাখি, আপনাদের কথামতো ভারতের সেবাদাস ও তাদের আনুকূল্যে সরকারে থাকা দলের লোকজন তবে কেন ভারত বিরোধী? আসলে আমরা কেউই সমস্যার মূলে যেতে চাই না। ভারতের প্রতি আক্রোশের কারণ যদি বঞ্চনা হতো দলে দলে লোক বিনোদন আর শপিংয়ের জন্য সেদেশে দৌড়াত না। মূলত ধর্মের নামে অন্ধ বিশ্বাস আর জাতি বা সম্প্রদায়গত ঐক্যের এক ভিন্ন মাজেজায় বাংলাদেশের তারুণ্যকে কৌশলে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী করে ফেলা হয়েছে। তারাই আজ এইসব বিদ্বেষমূলক মনোভাবের বড় শিকার। আমি একবার ও বলছি না ভারত আমাদের প্রতি ন্যায় করছে। উপমহাদেশের বড় দেশ ভারত ও তার প্রতিবেশী দেশগুলোর ভেতর সম্পর্ক কখনই সুখকর না। বরং প্রতিবেশী দেশগুলোর মানুষদের ভারত নানাভাবে রাগিয়ে তোলে। এসব দেশের মানুষের মনে আছে প্রচ্ছন্ন ভারত বিরোধিতা। সম্পূর্ণ হিন্দু অধ্যুষিত দেশ হবার পর ও নেপালের লোকজন ভারতীয়দের পছন্দ করে না। পাকিস্তানে আছে উগ্র অন্ধ বিরোধিতা। শ্রীলঙ্কায় আছে অবিশ্বাস। কিন্তু আমাদের বেলায় ভয়ের কারণ একটাই. যেসব কারণে আমরা পাকিস্তানকে টা টা বাই বাই জানিয়ে লাখো মানুষের রক্ত ও ত্যাগে দেশ স্বাধীন করেছিলাম, আজ আসলে সে কারণ ভুলে আমরা পাকিস্তানের প্রেমে জেগে উঠছি। ভারত বিরোধিতা হতে পারে। হোক, কিন্তু খেয়াল করবেন তার ফায়দা নিচ্ছে আসলে কারা? কৌশলে এই বিরোধিতার সুযোগ নিচ্ছে পাকি প্রেমীরা। তারা ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে ভারত পাকিস্তানের লড়াইয়ে পাকিদের সমর্থন দেয়াটা নাজায়েজ নয়। কেন জায়েজ? সম্প্রতি জেনেছি এখন নাকি মনে করা হয় বর্তমান প্রজন্মের দাদুদের দুশমন ছিল ব্রিটিশ পিতার দুশমন পাকিস্তান আর এখনকার শত্রু একটাই ভারত। এই যে নতুন আইডিয়া এটি একদিনে তৈরি হয়নি। ফেলানীর করুণ মৃত্যুকে অপকৌশলে মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের চাইতে বড় করে তোলা হয়েছে। গরু ছাগল মানুষ কাঁটাতার সব মিলিয়ে এক যুদ্বংদেহী মনোভাব। ভাবছেন এগুলো ভারতের আগ্রাসনের ফলাফল? ভুল। পঁচাত্তরে ঢাকার ফুটবল ম্যাচে অতিথি হয়ে এসেছিল অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন আর ইরানের সফেদ রুদ ক্লাব। ফাইন্যালের সন্ধ্যায় অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশনের হয়ে কথা বলতে গিয়ে প্রয়াত ভাষ্যকার তৌফিক আজিজ খান বার বার দুঃখ প্রকাশ করছিলেন তাদের প্রতি মানুষের বিদ্বেষমূলক আচরণের জন্য। তিনি প্রশ্ন করছিলেন কেন এই আচরণ? তৌফিক আজিজদের প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেছিলেন। তাঁরা জানতেন তখন কার কি ভূমিকা। আমরা বালক বয়সে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি বলে এখনও অনেক কিছু মানি না। ভুলতে পারি না। যে প্রজন্ম এগুলো দেখেনি যারা গল্প আর প্রচারের বলি তারা আসলে ভবিষ্যতে কোন ভূমিকা নেবে কিংবা কি আচরণ করবে বলা মুশকিল। আমি যে এই লেখাটা লিখছি আমাকে ও সম্প্রদায়গত পরিচয়ের কারনে গালাগাল শুনতে হবে। কিন্তু আমি ভাবছি ক্রিকেট খেলাই আর দেখব না। কারণ আমরা একবার ও ভাবছি না সামান্য খেলার কারণে দেশ ও সম্প্রদায়গত কি মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়ছে। যেদিন খেলা, যেদিন ভারত পাকিস্তান লড়ে সেদিন আমাদের দেশে যে টানটান উত্তেজনা আর স্নায়ুর চাপ থাকে তা দেখলে দিল্লী করাচীর মানুষও লজ্জা পাবে। যে দেশের মুক্তির জন্য লাখো মানুষ প্রাণ দিয়েছিল যে মাটিতে দাঁড়িয়ে আজকের প্রজন্ম স্বাধীন নিঃশ্বাস নিচ্ছে তার জীবনে গোলামী বলে কিছু নেই সে রক্তমাখা মাটিতে পাকিস্তান জিন্দাবাদ সেøাগান? আশ্চর্যই বটে! এবং দেখবেন কতভাবে এই জঘন্য অনাচারকে জায়েজ করা হচ্ছে। কারও মতে এটি ভারতের অবদান। কারও মতে বিরাট কোহলির জিভ। কারও মতে বদলে যাওয়া সময়ে এটাই জায়েজ। অথচ আমাদের ক্রিকেটের উন্নতি অগ্রগতি বা ভালর জন্য কি দরকার কাদের দরকার কিংবা কার কি ভূমিকা তা মনে রাখার সময় নেই আমাদের। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের সমাজ এমনিতেই দীর্ণ। আমাদের জীবনে সমস্যার অন্ত নেই। পাহাড়ে এতবড় ঘটনার পর ও জাতীয় শোক দিবস পালিত হয়নি। এখনও রাঙ্গামাটি দেশের সাথে সড়কপথে যোগাযোগহীন। আমাদের রাজনীতি পারলেই মারমুখো হয়ে ওঠে। আমাদের জাতীয় জীবনে না আছে ঐক্য আছে না, কোন সমঝোতা। এই বাংলাদেশ উন্নতির নামে কোথায় যাচ্ছে কেউ জানে না। এর সামনে অন্ধকার না আলো তাও বুঝি না আমরা। এই বিভেদপ্রবণ জাতিকে যে ক্রিকেট পাক প্রেমী ভারত প্রেমী করে তোলে আমি তা থেকে দূরে দাঁড়ালাম। এই জাতির প্রহরী যে নবীন সমাজ যে তরুণ প্রজন্ম তাদের এখনই এই মরণমুখিতা থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। খেলার আগে দেশপ্রেম। এর কোন বিকল্প নেই এখন। [email protected]
×