ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

জিরো থেকে হিরো

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ১০ জুন ২০১৭

জিরো থেকে হিরো

যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, বিশ্বাস হৃদয়ে- এর বাস্তবতার প্রমাণ দিয়েছে বাবার বখাটে ছেলে ফেরদৌস। সদর উপজেলার মস্তফাপুর ইউনিয়নের জয়ার গ্রামের আবদুল খালেক হাওলাদারের বড় ছেলে ফেরদৌস হাওলাদার। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সে দ্বিতীয় এবং ভাইদের মধ্যে প্রথম। ছোটবেলায় বাড়ি পালানো, মারপিট, বখাটেপনা, স্কুল পালানো থেকে শুরু করে হেন কাজ নেই যা সে করেনি। যে কারণে তার লেখাপড়ার পাঠ চুকে যায় মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ২০০০ সালে এসএসসি পাস করে। ফেরদৌসকে নিয়ে মা সালেহা বেগম দুশ্চিন্তায় থাকতেন। সবার কাছে বলতেন এই ছেলে কোনদিন মানুষ হবে না। কিন্তু না ফেরদৌস প্রমাণ করে দিয়েছে বেকার বখাটেরাও মানুষ হয়। শুধু মানুষই নয় সে এখন মানুষের মতো মানুষ হয়ে এলাকায় স্বনির্ভরতার মডেল। মাছ-মুরগি আর গাভী পালন করে আত্মবিশ্বাসী ফেরদৌস জিরো থেকে আজ হিরো। স্বাবলম্বী হওয়ার স্বীকৃতিস্বরূপ চারবার পেয়েছে জেলার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। ২০০০ সালে এসএসসি পাস করার পর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাবার বকাঝকা খেয়ে মস্তফাপুরে ইলেক্ট্রোনিক মেকানিকের কাজ শুরু করে। সেখানেও মন বসেনি তার। সিদ্ধান্ত নেয় ব্যবসা-বাণিজ্য করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে। কিন্তু কি ব্যবসা করবে, এসব চিন্তা করতে করতে কেটে যায় কিছুদিন। যুবক ছেলে বাবার ঘাড়ে বসে খাবে, এই বোধ তার ভেতরটাকে নাড়া দেয়। এক সময় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় সে মুরগি পালন ও মাছ চাষ করবে। কিন্তু তার জন্য তো টাকা ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন? এই চিন্তায় কেটে যায় আরও ছয় মাস। ফেরদৌস স্বপ্ন দেখতে থাকে একদিন সে সফলতা অর্জন করবে। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম বলেছিলেন ‘ঘুমিয়ে যে স্বপ্ন দেখ তা স্বপ্ন নয়, যে স্বপ্ন তোমাকে ঘুমাতে দেয় না-সেটাই স্বপ্ন।’ ফেরদৌসের বেলায় তাই হলো। নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন ফেরদৌসকে ঘুমাতে দিচ্ছিল না। তাই বুকের ভেতরে লালিত স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে সে ২০০১ সালে ভর্তি হয় মাদারীপুর যুব উন্নয়ন অধিদফতরে। হাঁস-মুরগি পালন, গবাদি পশু মোটাতাজাকরণ ও মৎস্য চাষ বিষয়ক তিন মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে নেমে পড়ে স্বপ্ন বাস্তবায়নে। ২০০১ সালে মাদারীপুর যুব উন্নয়ন অধিদফতর থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে বাড়ির পাশে গড়ে তোলে ছোট্ট পোল্ট্রি ফার্ম ও পাশের ছোট চারটি পুকুর লিজ নিয়ে শুরু করে মাছ চাষ। ছোট্ট পোল্ট্রি ফার্ম আর লিজের চারটি পুকুর নিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার অদম্য ইচ্ছা শক্তির ওপর নির্ভর করে যাত্রা শুরু ফেরদৌসের। শুরু হয় সংগ্রামী জীবনের পথ চলা। তার প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হতে থাকে প্রকল্পের পরিধি। এরই মধ্যে ফেরদৌস বিয়ে করে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা স্বপ্নাকে। স্বপ্নাও স্বামীর স্বপ্ন বাস্তবায়নে সহযোগী হয়ে দাঁড়ায়। প্রতি মাসের বেতন পেয়ে পুরো টাকা তুলে দেয় স্বামী ফেরদৌসের হাতে। স্ত্রী স্বপ্নাও সকাল বিকেল প্রকল্প দেখাশোনা করে। প্রথম ৪/৫ বছরে তার প্রকল্পে যুক্ত হয় ১৪টি পুকুর ও ২টি পোল্ট্রি ফার্ম। পাঁচ বছরে অর্থনৈতিকভাবে সে স্বনির্ভরতা অর্জন করে প্রকল্পের পরিধি আরও বৃদ্ধি করে। এভাবে দিন দিন উন্নতি হওয়ায় ফেরদৌস এলাকায় ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। জীবনের লক্ষ্য, কর্ম, চেষ্টা, পরিশ্রম ও আত্মবিশ্বাসের কারণে ফেরদৌস আজ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। বর্তমানে তার প্রকল্পে সম্পদের পরিমাণ ১৭টি মাছ চাষের পুকুর, ২টি পোল্ট্রি ফার্ম, মস্তফাপুর বাজার রোডে ১টি আধুনিক রাইস মিল, একটি গাভীর খামার, রেন্টে কার। ফেরদৌস হাওলাদার নিয়মিত ফরিদপুর ভিক্টর হ্যাচারি থেকে একদিনের কক মুরগির বাচ্চা এবং যশোর জেলার বিভিন্ন হ্যাচারি থেকে এক দিনের ব্রয়লার বাচ্চা কিনে আনে তার ফার্মের জন্য। এগুলো প্রতিপালন করে প্রতিমাসে বিক্রি করে থাকে। তার ফার্মের মুরগি স্থানীয় বাজারের চাহিদা পূরণ করেও এক সময় ঢাকার কাপ্তান বাজারে রফতানি করা হয়েছে। পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে রফতানি বন্ধ রয়েছে। তবে অচিরেই নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থায় আবার ঢাকায় সরবরাহ শুরু করবে বলে ফেরদৌসের প্রত্যাশা। ময়মনসিংহ ও মুক্তাগাছা থেকে মাছের পোনা সংগ্রহ করে মাছ চাষের জন্য। তার ১৭টি পুকুরে রুই, কাতল, মৃগেল, কৈ, শিং, পুঁটি, থাইপুঁটি, পাঙ্গাশ, ব্লাককার্ব, গ্লাসকার্ব, সিলভার কার্ব, তেলাপিয়া, মিনার কার্ব, পাবদা, চিতলসহ বিভিন্ন জাতের মাছ চাষ হচ্ছে। তার পুকুরের মাছ মাদারীপুর, টেকেরহাট, ভাঙ্গা ও ফরিদপুরের বিভিন্ন আড়তে বিক্রি হয়। কিছুদিন শিং ও কৈ মাছ ঢাকার কাওরান বাজারে বিক্রি করা হয়েছে। কিন্তু পরিবহন ব্যয় বেশি হওয়ায় এখন কাওরান বাজারে সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। বর্তমানে কৈ ও পাবদা ফরিদপুর ও ভাঙ্গার আড়তে বেশি সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রকল্পের এ সকল খামার থেকে তার মাসিক আয় দেড় লাখ টাকা। ফেরদৌসের প্রকল্পে ৬ বেকার যুবকসহ নিয়মিত ১০ কর্মী রয়েছে। তাদের মাসিক বেতন ৭০ হাজার টাকা। ফেরদৌস হাওলাদার তদারকির পাশপাশি নিজে হাতে প্রকল্পের কাজ করে। খামারের কোন কাজে তার অবহেলা নেই। তার উদ্যোম ও কর্মস্পৃহা দিন দিন তাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে। ২০০১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সতের বছরে লাভের টাকা দিয়ে ফেরদৌস এসব সম্পদ করেছে। পাশাপাশি তার প্রকল্পের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে ঢাকার মিরপুরে ৩৬ লাখ টাকা দিয়ে ফ্লাট বাড়ি কিনেছে। প্রকল্পের লাভের টাকা দিয়ে ফেরদৌস তার মেজো ভাইকে সৌদী আরব পাঠিয়েছে। এখন তার পেছনে ফিরে তাকানোর সময় নেই। এক সময়ের বেকার বখাটে ফেরদৌস এখন পরিবারের গর্ব। -সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর থেকে
×