ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মেজবাহ উদ্দিন তুহিন

অভিমত ॥ বাংলার লোকজ শিল্প ও শিকড়ের সন্ধানে

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ১৬ এপ্রিল ২০১৭

অভিমত ॥ বাংলার লোকজ শিল্প ও শিকড়ের সন্ধানে

এক সময়ের ঘন জঙ্গল ও শৈল শিরার এই অঞ্চলে আর্য-অনার্যসহ নানা জাতি গোষ্ঠীর আগমনে শিল্প শৌকর্যে সমৃদ্ধ হয়েছে আমাদের এই জনপদ। প্রত্যেক জনগোষ্ঠীই লালন করেছে নিজ নিজ সংস্কৃতি ও শিল্প। কালের প্রয়োজন ও সামাজিক প্রক্রিয়ায় প্রাচীন লোক শিল্পের অনেক কিছুই আজ বিবর্তিত, বিলুপ্ত ও পরিমার্জিত হয়েছে। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে প্রাত্যহিক জীবনের ব্যবহার্য জিনিসপত্র নিয়ে তৈরি হয়েছে আমাদের লোক শিল্প। বর্তমানে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য কুটির শিল্প গড়ে উঠেছে যা আমাদের আদিম লোক শিল্পেরই ধারাবাহিকতা। আমাদের বাঙালী লোক শিল্পের খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। ঢাকাই-মসলিন শিল্প এই উপমহাদেশের লোক শিল্পের গর্ব ছিল। এখনও নানা শিল্প সামগ্রী পৃথিবীর নানা স্থানে পেঁৗঁছে গিয়ে সুনাম অক্ষুণœ রেখেছে। আধুনিক সময়ের সকল আবিষ্কারকে আমাদের বিজ্ঞানের কল্যাণকর দিক বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। বিজ্ঞান আমাদের নিত্য নতুনের সন্ধান দেয় ঠিকই কিন্তু একসময় যখন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির আবিষ্কার বা গবেষণা ছিল না ঠিক সে সময়েও আমাদের পূর্ব পুরুষ প্রাচীন মানবেরা আবিষ্কার করে গেছেন নানা জিনিসপত্র। বর্তমান সময়ে সেসব উপকরণ ও জিনিসপত্র লোক শিল্প হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। আমাদের দাদি-নানিরা সংসারের কাজ সেরে অলস দুপুরে বসতেন কাঁথা সেলাই করতে। বর্ষাকালে যখন চারদিকে পানি থৈ থৈ করতো অথবা সন্ধ্যার পর সাংসারিক কাজ সেরে হারিকেনের আলোয় বসতেন নানা শিল্প নৈপুণ্যের কাজ নিয়ে। হারিকেনের মৃদু আলোতেই তারা ভাল দেখতেন তাদের চোখ ছিল অসাধারণ জ্যোর্তিময়। সে সময়ের কাঁথা সেলাই আজ নকশী কাথা শিল্পে পরিণত হয়েছে। হাতের নিপুণতায় বা সুতার কাজে ফুটে উঠত শিল্প নৈপুণ্য। পাট থেকে তৈরি হতো শিকা, বেণি, বসার আসন, ঝুলন্ত খাট, খেলনা প্রভৃতি। শোলা দিয়ে তৈরি হতো টোপর, ফুল ও খেলনা। শোলা গাছ শুকিয়ে কা- থেকে সাদা অংশ বের করে তৈরি করা হয় নানা শৌখিন সামগ্রী। বর্তমানে এসবে জরি ও চুমকির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। বিয়ের টোপর তৈরিতে শোলা শিল্পের ব্যবহার আমাদের মানবীয় অনুভূতিতে স্পর্শ করে। আমাদের সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে মৃৎসামগ্রীর অঞ্চলভিত্তিক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। হাঁড়ি, পাতিল, দইয়ের ভাড়, পিঠার ছাঁচ, সানকি, কলকি, ঠিলা, ফুলদানি, ফুলের টব, ইট, পুতুল, মটকা, ঝাঁঝর প্রভৃতির ব্যবহার হতো প্রতিটি গ্রামে। মৃৎশিল্পকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল কুমোর সম্প্রদায়। কুমার চাকার মাধ্যমে মাটি ঘুরিয়ে শৈল্পিক হাতে তৈরি করেন নানা শিল্প সামগ্রী। কুমারদের তৈরি পট চিত্র, কার্টুন ও ভাস্কর্য শিল্প বিশেষ উৎকর্ষতা লাভ করেছে। আমাদের দেশের প্রতœস্থলসমূহ থেকে প্রাপ্ত নকশা খঁচিত ইট ও মাটির তৈরি নানা শিল্পসামগ্রী থেকে প্রমাণিত এই শিল্প এবং পেশা প্রাচীন ও পুরনো। কাঠ শিল্পের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে ছুতার সম্প্রদায়। খাট-পালঙ্ক, খুঁটি, দরজা জানালা, বেড়াসহ কাঠের তৈরি প্রায় প্রতিটি জিনিসে একসময় নকশাখচিত থাকত। এ ছাড়াও দেখা যায় কাঠের ফুল-ফলসহ নানা উপকরণ। কাঠের ঢেঁকি আমাদের গ্রাম-বাংলার প্রতিটি ঘরের প্রয়োজনীয় উপাদান ছিল। বাঁশ-বেত দিয়ে তৈরি হতো চালনী, কুলা, ডালা, ডুলি, ঝাটা, চাটাইসহ নানা প্রয়োজনীয় সামগ্রী। উপকূলীয় অঞ্চলে নারিকেল গাছের প্রাধান্য থাকায় সেখানকার নারিকেলের ছোবড়া দিয়ে তৈরি হতো এক ধরনের বিশেষ রশি। নারিকেলের খোল দিয়ে বানানো হতো হুক্কা। এভাবে যুগে যুগে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের তৈরি জিনিসপত্র লোক শিল্পে পরিণত হয়েছে। যা আমাদের গৌরব ও অহংকার। আমাদের গ্রাম বাংলার ও লোকায়ত শিল্পধারা সময়ের ঘাত প্রতিঘাতে বিলুপ্ত হতে চলেছে। সাম্প্রতিক ও আধুনিক শিল্পধারার কাছে যুগে যুগে প্রবহমান সাধারণ মানুষের জীবন ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত শিল্প ও সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের হাসি-কান্না, দুঃখ-বেদনা, আচার বিচার, জীবন সংগ্রাম ও নানা সামাজিক আবহে আবৃত আমাদের লোকায়িত শিল্প। যা আমাদের সন্ধান দেয় শিকড়ের, সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া যায় নাড়ির সম্পর্কের। বর্তমান সময়ের শিল্পধারায় লক্ষ্য করা যায় প্রাচ্যের আদল। যা কৃত্রিম এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়ে অগ্রসরমান, আধুনিক জগতের নানা ইঙ্গিত মননশীল চিন্তায় ভরপুর। তবে আধুনিক শিল্পধারা যতই উন্নত হোক না কেন সেটি প্রাচীন লোকায়ত শিল্পধারার ওপর নির্ভরশীল। তাই আবহমান বাংলার লোকজ শিল্প গভীর জীবনবাদী আমাদের প্রতিটি শিল্পের মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া যায় দেশজ উপাদানের প্রভূত ব্যবহার। যাতে রয়েছে মাটি মানুষ ও দেশের পরিচয়। বাংলাদেশের সাহিত্য, কবিতা, চিত্রশিল্প, ভাস্কর্য, সঙ্গীত, নাচ-গান, চলচিত্র, স্থাপত্য, লোক ও কারুশিল্প নিজ ভৌগোলিক সীমারেখায় একটি স্বতন্ত্র পরিচয়ের শিল্প। যা আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থারও ইঙ্গিতবহ। আমাদের ভূখ-ে নানা পালাবদলের ফলে আমরা হারাতে বসেছি আমাদের নিজ সংস্কৃতি ও স্বকীয়তা। যার প্রথম সূচনা ঘটে ইংরেজ উপনিবেশ আমলে। কালে কালে নানা গোষ্ঠী আমাদের বহমান ঐতিহ্যময় শিল্পধারাকে থামিয়ে নিজেদের মতবাদ চাপিয়ে দিয়েছে ঠিকই কিন্তু কোন সভ্যতা গড়তে পারেনি। শুধু দখলীকৃত দেশ থেকে সম্পদ আহরণ করে নিজেদের দেশের উন্নতি সাধন করেছে। তবে আমাদের দুর্ভাগ্য কালচক্রে পশ্চিমা ঔপনেবেশিক ক্ষমতাভোগকারী দেশগুলো থেকে জন্মলাভ করেছে ইউরোপীয় বা পশ্চিমা সভ্যতা। যার যাঁতাকলে আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি। দুঃখজনক যে, যে সব দেশ কখনও উল্লেখযোগ্য সভ্যতার ধারক বাহক ছিল না তাদের সম্মিলিত সভ্যতা এখন প্রভাবশালী। তবে জাতিসত্তা, নিজস্ব সংস্কৃতি ও শিকড়ের স্বরূপকে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে আমাদের মনে রাখা উচিত বাংলার লোকজ শিল্প যুগে যুগে সব সময়ে শিল্পের অফুরন্ত আধার হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। যা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে টিকিয়ে রাখতে হবে। আমাদের লোকশিল্প অনেক পুরনো ও বিস্তৃত। নকঁশীকাঁথা, লোকচিত্র, পাখা, পাটি, শিকা, খেলনা পুতুল, মাটির ফলক, কারুশিল্প, বাঁশ ও বেতের বেড়া, কলকি, হুক্কা, লোক অলঙ্কার, লোক বাদ্যযন্ত্র, নকশীপিঠা, নকশী সাঁচ, মাছ ধরার উপকরণ, দেয়ালচিত্র, ঘুড়ি, মুখোশ, পিঁড়িসহ নানা কিছু নিয়ে লোক শিল্পের বিস্তৃত জগৎ। অপূর্ব এসব রচনা শৈলী যুগ-যুগান্তরের উদ্ভাবনী শক্তি ও অভিজ্ঞতার ফসল। একসময় এই শিল্প নিজস্ব চাহিদার প্রেক্ষিতে তৈরি হলেও কালক্রমে বাণিজ্যিকীকরণ শুরু হয়। এভাবেই শিল্পের নিজস্ব ধারার পরিবর্তন ও বিলুপ্তি ঘটতে থাকে। অন্যদের অভিরুচির কারণে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও অবয়বের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গুণগতমানের পরিবর্তন হয়। চলে যায় গ-ির বাইরে। শৌখিন লোকদের রস পিপাসা মিটাতে গিয়ে লোক শিল্প স্বকীয়তা হারায়। কারুবিপণির দৌরাত্ম্যের ফলে এই শিল্পে নাভিশ্বাস নেমে আসে, শিল্পের ঐতিহ্য নষ্ট হওয়ায় শিল্পীরাও হারিয়ে ফেলে দরদ ও অনুভূতি। যন্ত্রচালিত শিল্পের প্রসার, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে আমাদের শিল্পকে চড়াদামে কিনে পাশ্চাত্যে পাচার করে দেয়া হচ্ছে। নষ্ট করে দেয়া হয়েছে আমাদের অতীত। এ সবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমাদের এই ঐতিহ্য আর কতদিন টিকে থাকবে তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। লেখক : গবেষক ও উপ-আঞ্চলিক পরিচালক বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
×