ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি

কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ কিন্তু ভূমিতে প্রবেশাধিকার অনিশ্চিত

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ৩১ মার্চ ২০১৭

কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ কিন্তু ভূমিতে প্রবেশাধিকার অনিশ্চিত

(পূর্ব প্রকাশের পর) যেখানে ২২৩টি নারী প্রধান পরিবারও রয়েছে। এসব ভূমিহীন কৃষকরা কিভাবে এ শর্তে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবে। কৃষি কার্ড পেলেও আমরা সরকারী কোন সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছি না। আমরা সরকারী সহযোগিতা থেকে বঞ্ছিত হচ্ছি। এ ছাড়া আমরা নারী কৃষকরা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পাইনি। আমাদের মজুরিতেও রয়েছে বৈষম্য।’ নারী খাদ্য উৎপাদনে, প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে, পরিবারের আয়বর্ধনে, খাদ্য ও পুষ্টি সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও আমরা সার্বিক পর্যবেক্ষণে দেখতে পাই নারীর না রয়েছে কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি না আছে ভূমির মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণ। সরকারের খাস জমি বন্দোবস্ত নীতিমালানুযায়ী ভূমিহীন নারী যৌথ নামে স্বামীর সঙ্গে খাস জমির জন্য আবেদন করতে পারবে। বিধবা নারীর ক্ষেত্রে সক্ষম পুত্র সন্তানসহ আবেদন করার নিয়ম রয়েছে। বাংলাদেশে বৈবাহিক সম্পত্তির সহ-মালিকানার কোন আইনি ধারণা নেই। পারিবারিক সম্পত্তিতে যদি নারীর নাম দলিলে লিখিত না থাকে, তাহলে তার কোন মালিকানা থাকে না। কারণ সামাজিকভাবে নারীর অর্থনৈতিক সাবলম্বিতা না থাকায়, আবার যাদের আছে অর্থাৎ যারা আয় করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারাও নিজেদের নামে এককভাবে কোন সম্পত্তি ক্রয় করে না। ইন্টারন্যাশনাল ল্যান্ড কোয়ালিশন (আইএলসি)-এর উদ্যোগে উত্তরাধিকার আইন নিয়ে এশিয়ার ৪টি দেশে (যেমন-ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া এবং বাংলাদেশ) গবেষণা পরিচালনা করা হয়। ‘বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীদের ওপর উত্তরাধিকার আইনের প্রভাব মূল্যায়ন’ শিরোনামে একটি গবেষণা সম্পাদিত হয়। বাংলাদেশের ৭টি বিভাগের ১২টি জেলার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে এই জরিপ পরিচালিত হয়। ড. আবুল বারকাতের নেতৃত্বে সম্পাদিত এই গবেষণায় বলা হয়েছে, মাত্র ৪ শতাংশ ভূমির উপর নারীর প্রকৃত মালিকানা রয়েছে। মুসলিম নারীরা উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তির আইনগত মালিকানা লাভ করলেও জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে মুসলিম নারীদের প্রকৃত মালিকানা ৫%-এর অধিক ভূমির ওপর না। গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে, প্রায় এক-তৃতীয়াংশের অধিক (৩৬.৫%) মুসলিম নারীদের তাদের ভাইরা প্রায় অর্ধেক দামে তাদের সম্পত্তি হস্তগত করে নেয়। মুসলিম নারীরা তাদের ন্যয্য সম্পত্তির মাত্র ৪৩.২% পেয়ে থাকে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে জমির বাজারমূল্য কম সেটাই তাদের দেয়া হয়ে থাকে। এত বাধা বিপত্তির পরও পাবনার চাটমোহরে অর্থাৎ সোনাভানুর গ্রামে ইতোমধ্যেই ছোটখাটো একটি বিপ্লব ঘটেছে। যার ইতিবাচক পরিবর্তন প্রতিফলিত হয়েছে সমাজে। তাদের গ্রামের অনেক ভূমিহীন পরিবার খাস জমিতে মালিকানা পেয়ে নারী পরিবারের সার্বিক উন্নয়নে তথা তার নিজের নেতৃত্ব উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। সম্প্রতি, এএলআরডির ‘নারীর সঙ্গে জমির সম্পৃক্ততা এবং কৃষিতে তাদের অবদান’ শিরোনামের একটি গবেষণায় বিলকুড়ালিয়ার আন্দোলনের সফলতার গল্পটি স্থান পেয়েছে। দীর্ঘ ২৪ বছর আন্দোলনের পর অবশেষে পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের বিলকুড়ালিয়া মাঠের ৪৭৩.২৩ একর খাস জমিতে ভূমিহীনদের অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে। চলনবিল অঞ্চলের পাশেই বিল কুড়ালিয়ার অবস্থান। এএলঅঅরডির সহযোগী সংস্থা ‘ভূমিহীন উন্নয়ন সংস্থা (এলডিও)’ ১৯৯২ সাল থেকে এই খাস জমি উদ্ধার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। সুদীর্ঘ আন্দোলনের ফসল হিসেবে বিলকুড়ালিয়ার সরকারী খাস জমির স্থায়ী বন্দোবস্ত প্রদানের কার্যক্রম শুরু হয়েছে ২০১৪ সালে। ২০১৫ সালের শেষ দিকে সরকার বিলের খাস জমি ভূমিহীনদের ইজারা দিতে শুরু করে। এ পর্যন্ত ১১৯৬টি আবেদনপত্র অনুমোদন করে জেলা খাস জমি ইজারা কমিটির কাছে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে জেলা কমিটি ৫৪৭টি দরখাস্ত অনুমোদন করে প্রয়োজনীয় দলিলপত্র সম্পাদন করেছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০টি এবং তৃতীয় পর্যায়ে আরও ১৯৬টি দলিল উপজেলা কমিটির কাছে সম্পাদনের অপেক্ষায় আছে। চতুর্থ পর্যায়ে ৩৫২টি ইজারা অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। প্রতিটি ভূমিহীন পরিবার ৩০ শতাংশ কৃষি জমি দালিলিকভাবে বরাদ্দ পেয়েছে। আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তারা বর্তমানে বিলের ৪৭৩.২৩ একর জমিতে চাষাবাদ করে নিজেদের আর্থিক উন্নতি সাধনে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে মাথাপিছু প্রায় ১৪০০ ভূমিহীন এই বিলে জমি পেয়েছে এবং তারা চাষাবাদ করছে। সেখানে বছরে দু’বার ফসল ফলে। যার মাধ্যমে এখন সেখানকার কৃষকরা স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করছে। অধিকার আদায়ের লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিলকুড়ালিয়ার ভূমিহীন নারীদের নেতৃত্বে লক্ষণীয় উন্নয়ন ঘটেছে। ভূমিতে অধিকার আদায়ের প্রতিটি পদক্ষেপে নারীদের সংঘবদ্ধ অগ্রগামী ভূমিকা ও বিচক্ষণতা তাদের জয়লাভের পথকে সুগম করেছে। সেই সঙ্গে সমাজে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে, বর্তমানে সমাজে নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নারী নেতৃত্বের মতামত প্রাধান্য পাচ্ছে। ফলে নারীরা বিভিন্ন বিচার সালিশে, ফোরামে কথা বলতে পারছেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা বৃদ্ধি পেয়েছে, নারী নির্যাতন, বহুবিবাহ এই এলাকায় এখন আর দেখা যায় না। এ ছাড়াও পুরুষের পাশাপাশি এখানকার নারীরাও তাদের নামে সমানভাবে বিলের জমির ডিসিআর পেয়েছে। ভূমিহীন দরিদ্র পরিবারের সন্তানেরা এখন বিদ্যালয়ের গ-ি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছে। অনেকে কলেজও পড়াশোনা করছে। বাংলাদেশের মানচিত্রে সোনাভানুর মতো অনেক কৃষক নারীর আবাসস্থল ছোট একটি গ্রাম বিলকুড়ালিয়ায়। যেখানে এক ইতিহাস তৈরি হয়েছে, যার অবদান সোনাভানুদের মতো নারী কৃষকদের। সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয়টি হচ্ছে, বিলকুড়ালিয়া গ্রামে নারী-পুরুষ সবাই সমান। নারী-পুরুষ সবাই সমান এমন একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ হতে আর বেশি দেরি নেই।কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ এবং অবদান উল্লেখযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও ভূমিহীনতা নারীকে প্রান্তিক অবস্থায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে। ভূমিতে নারীর প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাসমূহ যেমন নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ, সামাজিক উন্নয়ন ইত্যাদি কোনো লক্ষ্যমাত্রাই অর্জন সম্ভব নয়। তাই নারীর ভূমি অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারকে অনতিবিলম্বে স্বল্প, মধ্যম, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দেশের সব মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা এবং খাদ্য সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে অদৃশ্যে থাকা নারীদের দৃশ্যমান করতে হলে নারীর ভূমি ও কৃষি অধিকারকে সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে। (শেষ)
×