(পূর্ব প্রকাশের পর)
খায়া-এ-গুলমান
হেকিম আলাউদ্দীন মির্জা বাদশাহ শাহজাহানের শারীরিক উন্নতির সংবাদে পুরোপুরি খুশী হতে পারলেন না। কৃতিত্বটা তিনি তাঁর হেকেমি দাওয়াই-এর কারণে দাবী করবেন নাকি নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরবার হতে মানত করা রঙ্গিন সুতার দোহাই দেবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। ওদিকে আবার কানাঘুষায় জানতে পেরেছেন দারা-জাহান আরা’র বুদ্ধিতে কোন এক হিন্দুস্তানী কবিরাজ গোপনে বাদশাহকে চিকিৎসা করে গেছেন। সবই কেমন ওলটপালট লাগছে শাহী হেকিমের কাছে। তাঁকে এড়িয়ে দেশী হিন্দুস্তানী বৈদ্যের হাতে বাদশাহের চিকিৎসা?
মনের দুঃখে নিজেকে খোজা বানিয়ে দিতে ইচ্ছে করছিলো হেকিম সাহেবের। লম্বা দাড়ি বৃদ্ধ হেকিম আলাউদ্দীনের কোমর ছাপিয়ে গেছে। খোদা তাঁকে মেয়ে হিসেবে পাঠালেও তাঁর চুল নিশ্চয় হাঁটু পার হয়ে যেত। পুরানো হেকিমি দস্তাবেজ ঘেঁটে তিনি জেনেছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের কল্যাণে ছেলে মেয়েতে আর মেয়ে ছেলেতে রূপান্তরিত হতে পারে। সেটা সম্ভব হলে তা হতো এক তাজ্জব ব্যাপার। আরো অনেকের মতো হেকিম আলাউদ্দীন মনে মনে হেরেমের নারীদের হিংসা করেন। এতো জ্ঞান অর্জন করেও মূর্খ মেয়েগুলো শুধু রূপ আর অবিদ্যা দেখিয়েই সব আদায় করে নিচ্ছে। আর তিনি সারাদিন গাছগাছড়া আর ওষুধের তেজ নিয়ে চিন্তাভাবনা করেও বাদশাহের খেদমতের যোগ্য হলেন না। অথচ তিনি মহান সম্রাট আকবরের পেটের পীড়া, এক তুর্কী হেকিমের সহায়তায় জাহাঙ্গীরের মাদকাসক্তি, এমনকি বাদশাহ শাহজাহানের পূর্ববর্তী সকল অসুস্থতার নিরাময়ে খোদাপাকের সহযোগিতা পেয়েছিলেন। অথচ খোদ শাহজাদা দারা আর শাহেনশা কন্যা জাহান আরা তাঁকে পুরোপুরি বিশ্বাস করেন না। করলে নিশ্চয় বাদশাহের এতো বড় সুখবরটা তাঁরা পুরস্কার পাঠিয়ে তাঁকে জানাতেন। কিন্তু না। এই খবরটা হেকিম আলাউদ্দীনকে জানতে হলো দাসী মারফত।
হেকিম নিজেও সম্রাটের এই দুই পুত্র-কন্যাকে অপছন্দ করেন। তাঁর সূক্ষ্ম ধারণা দারা হয়তো গোপনে বাদশাহকে অল্প অল্প করে বিষ খাইয়ে কাহিল করে দিচ্ছেন। কেবলমাত্র জাহান আরা’র কারণেই হয়তো তা সম্ভব হচ্ছে না। এক সঙ্গে দুই ভাই-বোন মিলেমিশে চলাফেরার ভাব দেখালেও দুজনের কি ইচ্ছে তা উপর আল্লাহই জানেন। মনস্থির করলেন হেকিম। এই বিষয়ে গোপনে আওরঙ্গজেব’কে সব জানাতে হবে। খোদাভক্ত আওরঙ্গজেবই তাঁকে উপযুক্ত সম্মান দিতে পারেন।
তলব পেয়ে অসন্তুষ্ট মনে হেকিম মীর্জা লাল কেল্লায় প্রবেশ করলেন।
- আসুন হেকিম সাহেব। স্বাগতম। বাদশাহের খানিকটা ভালো বোধ হচ্ছে। খাস মহলে জাহান আরা অভ্যর্থনা জানালেন হেকিম আলাউদ্দীনকে।
- খোদার কাছে হাজারো মেহেরবানী। আশা করি আমার দেয়া লবঙ্গ-দারচিনিওয়ালা পারদ চূর্ণ দাওয়াই বাদশাহ’কে আবার আমাদের মাঝে ফিরিয়ে এনেছেন। আমি কি ... মাঝপথে তাঁকে থামিয়ে দিলেন জাহান আরা।
- তা হতেও পারে। শুকরিয়া। আমি কিন্তু আপনাকে সে কারণে ডাকিনি।
- তবে? আবার কি মহান সম্রাটের তবিয়ত খারাপের দিকে?
- না ...। হাসি মুখে জানালেন জাহান আরা। ... আব্বা হুজুর সকাল হতেই ভালো-মন্দ খেতে বায়না করেছেন। আপনি তাঁর খাদ্য তালিকাটি একটু যাচাই করে দিন। জাফরানী পোলাও খাবার পর হতেই যে সম্রাট অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তা সঠিকভাবে আপনি সবার আগে ধরতে পেরেছিলেন। আপনি সম্রাটের পরবর্তী খাদ্যাভ্যাসটা একটু বাতলে দেবেন।
কপালের কুঞ্চিত বলিরেখায় আশ্বস্তের ছাপ পড়লো শাহী হেকিমের।
ইশারায় শাহী বাবুর্চিকে ডাকলেন জাহান আরা। গড়গড় করে খাস বাবুর্চি বলতে থাকলো বাদশাহ শাহজাহানের দুপুরের খাবারের আয়োজন -
‘আলু-গোস্ত, ডাল-মাখনি, রুমালি রুটি, গুর্দা-কলিজি, নার্গিস কোফতা, লক্ষেèৗ কাকোড়ি, গালোতি, শিক কাবাব, নারগিডি কাবাব, শাম্মি কাবাব, চাপাতি, খাসীর বিরিয়ানি, মোরগ মুসল্লাম, খাসী জাহাংগিরি, তান্দুরি, দুম্বার রেজালা, মগজ ভাজী, আফগানী খায়া-এ-গুলমান ...’, এইটুকু বলতেই ইশারায় বাবুর্চিকে থামালেন হেকিম আলাউদ্দীন।
- খায়া-এ-গুলমান কি মহামান্য সম্রাটের পবিত্র পেটে হজম হবে? এমনিতেই তো অসুস্থ শরীরে বেশী তেল-ঘি সহ্য হবার কথা নয়। হেকিম সংশয় প্রকাশ করলেন।
পুরুষ প্রাণীর অণ্ডকোষ দিয়ে বানানো এই বিশেষ সুস্বাদু খাবার খায়া-এ-গুলমান মোগল রসুইখানায় খুবই জনপ্রিয়। অন্দর মহলে এই খাবার নিয়ে বিশেষ আগ্রহ। মুঘল পুরুষ ব্যতীত নারীদের জন্য এই খাবার নিষিদ্ধ। তবে রাজ-মহীয়সীরা যে এর স্বাদ নেন না তা হলফ করে বলা যাবে না। হারানো যৌবন ফিরে পেতেও কোন কোন হেকিম এই পদ খেতে বলেন। যদিও হেকিম নিজে কোনদিন তা স্পর্শ করেন নি। আল্লাহর কালামে এই খাবারের উল্লেখ নেই। ভাবলেন, ভাগ্য ভালো সম্রাট তাঁর পিতামহদের মতো বুনো শূকর অথবা বাঘের মাংস খেতে ইচ্ছে প্রকাশ করেন নি!
- তবে কি তা বাদ দিয়ে দেবো জনাব? বাবুর্চি আগ্রহভরে জিজ্ঞাসা করলো।
- না, থাক। সম্রাট ইচ্ছে করেছেন যখন, তবে যেন পরিমিত আহার করেন। তার দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেবেন মহানুভব শাহজাদী। জাহান আরাকে উদ্দেশ করে বললেন হেকিম।
- তা আপনি চিন্তা করবেন না হেকিম সাহেব। স্মিত হেসে বললেন জাহান আরা।
- খাবার শেষে মিষ্টান্ন জাতীয় খাবারের তালিকাটি কি পেশ করবো মহামান্য? জাহান আরাকে জিজ্ঞাসা করলো মুঘল বাবুর্চি।
মিষ্টির প্রসংগ আসতেই পাতলা ঠোঁটের কোণে হাসির ঝিলিক খেলে গেল জাহান আরার। বাদশাহের আরোগ্য লাভের কারণে তিনি নিজেও আজ সামান্য চপলতায় ভুগছেন। ঈষৎ শরাব পানও করেছেন অবেলায়। আব্বাহুজুরের মিষ্টি সংক্রান্ত এক বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে গেল শাহজাদীর।
বাদশাহ আলমপনা বেগম মমতাজের মৃত্যুর আগেও ছিলেন প্রচ- কাম-বিলাসী। প্রিয় স্ত্রীর মৃত্যু তাঁকে অনেক বদলে দিলেও শরাব পান আর পছন্দের দাসীদের খেদমত নিতে তিনি দ্বিধা করেন না। একবার মমতাজ বেগম বেঁচে থাকা অবস্থায় বাদশাহকে সাবধান করে অভিযোগ করেছিলেন, কেন তিনি যে কোন জাতের নারীতে আসক্ত? বাদশাহের রুচি বলে তো কথা।
বাদশাহ রহস্য করে কবিতায় উত্তর দিয়েছিলেন,
“মিষ্টি!
তা যে দোকানেরই হোক
সে তো আর তেতো নয়,
মিষ্টি শুধু মিষ্টিই হয়।”
- সম্রাট কাজু কাঠি, মাইসুপা, বাদাম হালুয়া, বরফী ক্ষীর, আমের শরবত, ফালুদা বিশেষ পছন্দ করেন। ওগুলো যেন থাকে। আর তোমার কোন খাস খানা-খাজানা থাকলে দিও। ওড়নায় মুখ ঢেকে হাসি চেপে বললেন জাহান আরা।
বাবুর্চি আর হেকিম বুঝে উঠতে পারলেন না এতে হাসির কি আছে?
কুর্নিশ করে বাবুর্চি চলে গেলে হেকিমকেও বিদায় দিলেন জাহান আরা।
এখন তাঁর অনেক কাজ। সম্রাটকে পোশাক পরিয়ে প্রস্তুত করে কেল্লায় সবার সামনে তাঁর চেহারা- মোবারক পেশ করাতে হবে।
জাহান আরা যখন হেকিম আর বাবুর্চির সঙ্গে দুপুরের আহার-পর্বের আলাপ করছিলেন তখন শাহজাহানের মুখোমুখি বসেছিলেন শাহজাদা দারা। পুত্রের চিন্তিত মুখ দেখে কিছু একটা আঁচ করতে পারলেন সম্রাট। জ্বরে বেহুঁশ থাকলেও কিছু কথাবার্তা যে তাঁর কানে একদম যায় নি তা কিন্তু নয়।
- কে? আওরঙ্গজেব?
- না আব্বাজান।
- তবে কি সুজা ...? দ্বিগুণ বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলেন শাহজাহান।
- জী। শাহ সুজা বাংলায় বসে নিজেকে দিল্লির বাদশাহ ঘোষণা করেছেন।
খানিকক্ষণ নিশ্চুপ থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সম্রাট।
- আফসোস করি না। এটাই মনে হয় রক্তের রীতি। তৈমুরের বংশের ধারা।
- আপনার কি আদেশ আব্বাজান?
- বেশী অপেক্ষা করো না। দাদাজান মহান আকবর আর আব্বাহুজুর একইভাবে অপেক্ষার খেলা করেছিলেন।
প্রসঙ্গ পালটে আনমনে জিজ্ঞাসা করলেন,
- ফার্সী ভাষায় তোমার উপনিষদ অনুবাদ কি শেষ হয়েছে?
- জী আব্বাজান। তামাম পশ্চিমে পারস্য হতে ইতালী পর্যন্ত তা ছড়িয়ে পড়েছে। অটোমান দরবারেও আমাদের দেশীয় সাধুদের এখন অনেক কদর। মুখ উজ্জ্বল করে বললেন দারা।
- মোবারকবাদ বেটা। তুমি বিলকুল তোমার দাদাজানের মতো হয়েছো। হিন্দুস্তান তোমাকে এই কারণেই দীর্ঘজীবী করবে। মসনদ স্থায়ী নয় মনে রেখো।
শরাবের পাত্র তুলে নিলেন অসুস্থ সম্রাট। পুত্রকেও এগিয়ে দিলেন একটা।
- যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমার বড় ছেলে সুলায়মান’কে প্রস্তুত থাকতে বলো পূবের বাংলার বিদ্রোহ ঠেকাতে। শিখুক কিভাবে পরিস্থিতি সামলাতে হয়। যদ্দিও আমি চাই না নাতীর হাতে আমার ছেলের রক্ত ঝরুক। বাকীরাও বসে থাকবে না মনে হয়। এইদিকে আওরঙ্গজেব অথবা মুরাদ কেউ না কেউ আসবেই।
সম্রাট উঠে দাঁড়ালেন কাঁপতে কাঁপতে। আবার জ্বর এসেছে তাঁর। ফেলে দিলেন শরাবের পাত্র। কাছে এগিয়ে এসে দারার কাঁধে ভর দিলেন।
ফিসফিস করে পুত্রের কানে মুখ রেখে বললেন,
“হাতীকে কব্জা করতে,
মাহুতের সঙ্গে বন্ধুত্ব না পাতিয়ে
ঐ হাতীর জন্য এক মজবুত ঘর বানাও।”
দারা শিকো পিতার হেঁয়ালী কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলেন না।
(চলবে)