কবিতা আত্মা নিসৃত এক অনন্ত তৃষ্ণার নাম। যে তৃষ্ণা জীবন ও যাপনের, উদ্যাপন ও বিদগ্ধতার। এই কারণে শব্দের পর শব্দ বুনে, পঙ্ক্তির পর পঙ্ক্তি শেষে একটি কবিতা সৃষ্টি হলে আমরা বিপুল গৌরবে উচ্ছ্বসিত হই। তিল তিল ভাবনা মিলে কবিতা প্রসবের এই আনন্দ প্রখর নদীর চেয়েও প্রবহমান। কবিতা সবসময় সুখের নাও হতে পারে। কষ্টের ছাইদানিতে জমানো কবিতা একদিন কাতর আত্মার বিলাপ শোনায়। শব্দের রেণু বুকে ধারণ করে কবির পথ হাঁটা অন্তহীন এক অচেনা পথের পানে। যার ফলশ্রুতিতে ‘কবির রক্ত’ এক সময় কালিতে রূপ নেয়, আর পৃথিবীতে জন্ম নেয় বহুল আরাধ্য একটি কবিতা। অন্য সবার মতো আমার কবিতারাও সহজে ধরা দেয় না। অনেক চেষ্টা, সাধনার পরই এক-একটি কবিতার দেখা পাই আমি।
এই অপার চরাচরে কতÑশত বিষয়, পথ চলতি জীবনের নানা উপকরণ আমাকে আলোড়িত করে। বয়সের নীলদিন স্মৃতির সড়ক ধরে ফিরিয়ে নেয় অতীত বা তারও অতীতে যা আমাকে সুখ দেয় অথবা একটু কাঁদায়। মূলত এসবের প্রতিবেশী আমার এক একটি কবিতা। এখানে আর্তি আছে বেদনায় জর্জরিত হওয়ার তেমনি সুখের খ- ছুঁয়ে দেয় কাশবনের সাদা ফেলবতায়।
সর্বোপরি একটা ভাবনার খেলা সবুজ ক্ষেতের মতো খামেমোড়া শৈশবÑকৈশোর নিয়ে; যা অনুভূতির বিমূর্ত বোলচালে আমৃত্যু ভাষা খুঁজে বেড়ায়। এই মূর্ত-বিমূর্ত চিত্রগুলো, ভালো ও মন্দের আবর্তনগুলো আমার চিন্তার মধ্যে খেলা করে আর আমি কবিতায় সেই দৃশ্যগুলোই এঁকে যাই। কখনও কখনও রবীন্দ্রনাথের মতো আমারও মনে হয় আমি তো লিখছি না, কে যেন পরানের গহীন থেকে আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে! এমন বোধ নিয়ে আমি কবিতার মধ্যে এবং কবিতা আমার মধ্যে বসবাস করে।
আজ খুব বেশি মনে হয়, কবিতাই আমার প্রথম প্রেম। বিষাদে সুখের খোরাক। কবিতা সমুদয় রোগ-বিষণœতার ঔষধও। যখন সব দুয়ার বন্ধ হয়ে যায়, ‘সব পাখি ঘরে ফেরে’, যখন নাটোরের বনলতা সেনও প্রতীক্ষায় থাকেন নাÑ তখনও আমার কাছে চিরচঞ্চলা, চিরমৃন্ময় কবিতারা স¯েœহে বসে থাকে।
আমি যে গহীন স্মৃতির বনে রাতÑবিরাত মেঘের ধারায় ভিজতাম, চাঁদধোয়া পূর্ণিমার মতো সে সবই তো আমার কবিতা। সেদিন থেকেই আমার ভেতর কবিতাকে বুনে রেখেছি।
আমি আজও কষ্টের তীর থেকে রেহাই পেতে এই কবিতার মুখোমুখি দাঁড়াই। কথা বলি কবিতার ভাষায়, চেয়ে নেই আবার দুঃসময়ে তীব্র প্রতিবাদ জানাই। আসলে কবিতার প্রতিটি পঙক্তি জীবনকে দিগন্তব্যাপী ব্যাপৃত করে, অপরূপা নারীর মতো মুগ্ধ করে, ভালোবাসে। এই মুগ্ধতা ও ভালোবাসা যাতে অক্ষুণœ থাকে সেজন্যে আমি প্রতিনিয়ত শব্দ বুনে যাই, প্রতিনিয়ত সাদা পৃষ্ঠাকে করি ক্ষত-বিক্ষত...