ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দাউদ হায়দার

রুরু ॥ ঈশ্বরিত মানুষ

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ১৭ মার্চ ২০১৭

রুরু ॥ ঈশ্বরিত মানুষ

ওই দ্যাখ, আসছেন রুরু এইবার নাচ হোক শুরু। রুরুবাবু নাচছেন ঘুরে ঘুরে নাচছেন সুরে সুরে নাচছেন তালে তালে নাচছেন তাক তাক ধিন ধিন ধিন দিন তাক রুরুবাবু খান ঘুরপাক। তারপর পড়ে যান ধপাস। সাবাস! সাবাস! (জলসা ॥ অন্নদা শঙ্কর রায়) অন্নদা শঙ্কর যখন লিখছেন এই ছড়া, রুরুবাবুর বয়স কত? দেড়/দুইয়ের বেশি হবে না হয়ত, কিন্তু ক্রান্তদর্শী অন্নদা শঙ্কর রায় দিব্যচোখে ঠিকই দ্যাখেন, ভবিষ্যতে রুরুর নাচানাচি। রুরু ঘুরপাক খাবে, অতঃপর ‘ধপাস’ পড়ে যাবে। এই পড়ে যাওয়া ‘সাবাস’ নয়। এই পড়ে যাওয়া প্রাণহীন, নিথর, কোন অচেনা-অজানালোকে যাত্রা। যার কোন হদিস নেই, বিজ্ঞানেও প্রমাণিত নেই। অন্নদা শঙ্কর রায় পুত্রকন্যা-নাতি-নাতনির নামকরণ করতেন। রুরু নাম তাঁরই দেয়া। ডাকনাম রুরু। ভাল নাম শরণ্য। শরণ্য রায়। তারিখ মনে নেই, রুরু এলো দাদুদিদুর বাড়িতে, যোধপুর পার্কে, সঙ্গে বিবি (বড় বোন। পোশাকী ভাষায় ‘দিদি’। ঋতুপর্ণা রায়।) মা (তৃপ্তি রায়)। বাবা (অশোক রায়)। দিন ছিল রবিবার। পড়ন্ত বিকেল। শুনেছিলুম, তৃপ্তি রায় ঢাকুরিয়া লেকের কাছেই থাকেন, এ্যান্ডারসন ক্লাব থেকে দূরে নয়। আশ্রয় নিয়েছি অন্নদা শঙ্কর-লীলা রায়ের আস্তানায়, অন্নদা শঙ্কর-লীলা রায়কে ‘দাদুদিদু’ বলছি শুনে বিবির চোখ ছানাবড়া, আচমকা প্রশ্ন : ‘তুমি কে? তুমি তো আমাদের কোন দাদা নও।’ উত্তরে থাকি মৌন। রুরুর ওসব প্রশ্নট্রস্ন নেই, চেয়ারে উঠে কাঁধের উপর চড়াও হয়ে অর্ডার, ‘চলো। বেড়াতে যাব।’ কাঁধে চড়ে যোধপুর পার্কের বাজারে গিয়ে ‘লজেন্স খাব। বাবা-মা’কে একদম বলবে না।’ পকেটে টাকা-পয়সা নেই জেনে, কাঁধ থেকে নেমে দৌড়। পেছনে ছুটতে হলো। বাড়ি ফিরে প্রত্যেকের সামনে অভিযোগ, ‘এই দাদা সিগ্রেট খায়। আমার মুখে ধোঁয়া ছাড়ে।’ অভিযোগেও রেহাই নেই, আবার কাঁধে চড়ে অর্ডার, ‘পয়সা নিয়েছ? ভাল ভাল ক্যাডবেরি কিনবে।’ এও বাহুল্য। বিবিকে সঙ্গী করে, ‘দাদা ক্যাডবেরি চকোলেট কিনবে।’ রুরু-বিবি এতটাই আপন হয়ে যায়, ‘দাদা’র কাছে খোলামেলা আবদার, মনের কথা বলতে দ্বিধা-সঙ্কোচ নেই। বিহ্বলের মালিন্য নেই। আপন কখনও পর হয় না। চকোলেট পেয়ে রুর যে নাচ, আনন্দে, স্ফুর্তিতে, এ রকম নাচ, হয়ত ঘুরে ঘুরে (চকোলেট না পেয়েও), নেচে থাকবে, নাচ দেখে, ১৯৭৪ সালে, অন্নদা শঙ্কর লিখছেন, ‘জলসা’। স্মৃতি যখন খামচায়, ওলোটপালট হয়ে অতীত-বর্তমান। তৃপ্তি-অশোক রায় সপরিবারে বোম্বে প্রস্থান, কলকাতা ছেড়ে। সপ্তাহে একদিন বা দু’দিন তৃপ্তি রায়ের টেলিফোন, বাবা-মাকে। রুরু কাছে থাকলে দাদুদিদুর সঙ্গে কথা নয়। একদিন শুনলুম, চিৎকার করছে, ‘মা, ফোন ছাড়ো, দাদার সঙ্গে কথা বলব।’ কী বলছে? ‘কবে আসবে? তুমি এলে জুহু বিচে শাবানা আজমির বাড়ি দেখাব।’ দেখানোর প্রতিশ্রুতি আগেও পেয়েছি। রুরুদের বাস বারান্দায়, তিন তলায়, মেহবুব স্টুডিওর ঠিক পেছনে। বারান্দা থেকে স্টুডিওর ভেতর-বাইরে কিচ্ছু দেখা যায় না, না গেলেও রুরুর কথা, ‘আমরা দেবানন্দ, হেমামালিনী, ধর্মেন্দ্র, জিনাত আমান, আমজাদ খান, পারভিন বাবিকে দেখেছি। তুমিও দেখবে।’ রুরুর বয়স তখন সাকল্যে সাত। সিনেমার পোকা মাথায় ঢোকেনি তখনও, সিনেমার ফ্যান্টাসিতেও পোক্ত হয়নি, একই ফ্লোরে, পাশের ফ্ল্যাটে নিতিন সিংয়ের বাস, বলিউডি চলচ্চিত্রে যুক্ত, তার আস্তানায় সিনেমার নানা কলাকুশলীর যাতায়াত, কিন্তু এই নিয়ে আদৌ কৌতূহল নেই রুরুর। যোধপুর পার্কে যখন, কিংবা বালিগঞ্জে (বিড়লা মন্দিরের বিপরীতে), অনেকেরই মাথাব্যথা, ‘অন্নদা শঙ্কর হিন্দু, লীলা রায় খ্রীস্টান, হিন্দু-খ্রীস্টান মিলে এক নেড়েকে ঠাঁই দিয়েছে ঘরে। অন্নদা শঙ্করকে বলে দাদু, লীলা রায়কে দিদু।’ Ñ কানে শুনেছি মন্তব্য। রায়-পরিবার ধর্মাধর্মের উর্ধে। বিশ্ব মানবিক। অন্নদা শঙ্করকে দাদু, লীলা রায়কে দিদু বলছি। ওদের কন্যা তৃপ্তিকে দিদি। তৃপ্তির স্বামী অশোককে দাদা। ওদের কন্যাপুত্র বিবি-রুরু দাদা বলছে আমাকে। ডিএল রায় লিখেছেন, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কেন তুমি।’ ঘুরিয়ে বলি, ‘এমন আত্মীয়কুল কোথাও খুঁজে পাবে না কো কেউ।’ Ñ ট্র্যাজেডি, লেখেননি, লিখতে পারেননি। কেন ট্র্যাজেডি? Ñ এও তো ট্রাজেনাটক জিয়া হায়দার ক্যান্সারে আক্রান্ত, ঢাকায় চিকিৎসা সুবিধার নয়, গিয়েছেন মুম্বাইয়ে, বিস্তর খরচ, মরার জন্য যে কোন নিম্ন বা মধ্যবিত্তের সর্বস্ব ব্যয়, নিঃস্ব হয়ে মৃত্যু, তবু আশা, হায়!! চিকিৎসার্থে অগ্রজের মুম্বেতে যাওয়া সঙ্গে রশীদ হায়দার, থাকা, খরচ নানা ঝামেলা। ফোন করলুম রুরুকে। ঘটনা যেন কিছুই নয়, রুরু বললে, ‘আমি আছি।’ Ñ হাসপাতালের ব্যবস্থা, দেখভাল কাঁধে নেয়াই নয়, শুধু হাসপাতালে চিকিৎসার পরে (থেরাপির পরদিন) ওর ঘরে থাকে এক ঘরে, ছেড়ে দিয়ে বন্ধুর কাছে (দিন-রাত্রি যাপন) সকাল থেকে রাত্রি সেবাযতœ। নিয়ে যাচ্ছে পুর্নেয়। বাবা-মার (অশোক-তৃপ্তি রায়) জিম্মিতে রেখেও নিশ্চিত নয়। দায়িত্বে হেরফের নেই। Ñ রুরুর মতো ঈশ্বর কে আছে আর? জার্মান ঔপন্যাসিক পেটার স্নাইডার (ওঁর বিখ্যাত বই ‘বার্লিন ট্রিওলজি’) একটি গল্পে এক চরিত্রের মুখে বলছেন, ‘ঈশ্বর কখন ঘুমোয়, কখন জেগে থাকে, ঈশ্বর ছাড়া কেউ জানে না। ঈশ্বর সকলের দেখভাল করে, নিজের করে কিনা, আমাদের অজানা।... ঈশ্বর স্বাধীন, উপরন্তু এ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়। এ্যাডভেঞ্চার এবং স্বাধীনতা মানুষের মনোজগতে চালিয়ে দিয়েছে। মানুষ জন্মগত একা, ঈশ্বরও একা। যে ঈশ্বরকে ভালবাসে, একা মানুষকেও সে ভালবাসে।’ গল্পের ঘটনা ক্রমশ বিস্তারিত। ‘যে’ হয়ে যায় ‘যারা’, ‘সে’ হয় ‘তারা।’ অর্থাৎ সংখ্যায় বহু, দলবদ্ধ। লেখক বলছেন, ‘ঈশ্বর স্বাধীন,’ ‘এ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়’। রুরুর বেলায় প্রযোজ্য খুবই, স্বাধীনতা, এ্যাডভেঞ্চার ওর মজ্জাগত। আবার দলবদ্ধও। প্রত্যেককে নিয়ে ঘরোয়া, দলছুট হয়েও দলের মধ্যমণি। বিবি-রুরু বার্লিনে ভ্রামণিক। এসেই, একদ- বিশ্রাম না নিয়েই, স্যুটকেস ঘরে রেখেই, ‘চলো, বার্লিনে কোথায় কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, হিটলারের বাঙ্কার, দেখব।’ বিবির মেজাজ বিগড়ে যায়, ‘তুই যা, আমি ঘুমাব।’ খাবারের আয়োজন করছি, দরজা খোলা। টের পাইনি, রুরু কখন বেরিয়ে গেছে। মহাবিপদ। না জানে ভাষা, না চেনে পথঘাট। খুঁজতে বের হই। আধঘণ্টা খুঁজে, না পেয়ে ঠিক করি পুলিশে খবর দেয়া জরুরী। ঘরে ফিরে দেখি রুরু, রাগে কাঁপি, বললে, ‘ঘুরে দেখলাম তোমার বাড়ির আশপাশে কি আছে। চারটি রাস্তার নাম মুখস্থ করেছি।’ এত্ত বাহ্য। বিবি-রুরুকে নিয়ে ব্রাসেলসে গিয়েছি, হেনার আস্তানায়। যেহেতু ছোট ভাই (দুই বছরের বড়), নানা আবদার এবং বিবি-রুরুকে নিয়ে যেতেই পারি। হেনা মহাখুশি। হেনার স্বামী ওমর ফারুক কূটনীতিক, ব্রাসেলসে, বাংলাদেশ দূতাবাসে। হেনার চেয়ে হেনার দুই সন্তান, কন্যা বনতুলি, পুত্র তুষার আরও খুশি। বিবির চেয়ে বয়সে ছোট বনতুলি। লক্ষ্য করি, বিবি হঠাৎ ভারিক্কি, গম্ভীর। ‘দিদি-দিদি’ ভাব গাম্ভীর্য। রুরুর চেয়ে বয়সে ছোট তুষার। মুহূর্তেই বন্ধু দুজনে। ঘরে গিয়ে দুজনে কী শলাপরামর্শ করেছে অজানা, কখন বেরিয়ে গেছে, হদিস। টো টো করে ঘুরে, ডিনারের আগে ফেরা। রুরু বললে, ‘ট্রামে-ট্রামে ঘুরলাম, টিকেট কাটিনি।’ শুনে তাজ্জব। হেনা বকাবকি করলে তুষার। কাঁদো-কাঁদো কণ্ঠে তুষারের কথা, ‘রুরু দা উঠল, আমিও উঠলাম। টিকেট চেকার আসেনি।’ খেতে খেতে অকপটে রুরু জানায়, হেনাকে, ‘তোমার চেয়ে আমার মার রান্না অনেক ভাল।’ বিবি-রুরুকে নিয়ে প্যারিসে হাজির, শিল্পী শাহাবুদ্দীনের ফ্ল্যাটে। শাহাবুদ্দীনের স্ত্রী আনা (ইসলাম)। ওঁদের দুই কন্যা, চিত্র এবং চর্যা। দু’জনেই বিবি-রুরুর ন্যাওটা। ওঁরা বিবি-রুরুর চেয়ে বয়সে ছোট। রুরু বললে, ‘আরে! তোমাদের বাড়ি থেকেই আইফেল টাওয়ার দেখা যায়, ওখানে যাব না। মা-বাবা বলেছেন ল্যুভর মিউজিয়াম দেখতে। কাল যাব।’ শাহাবুদ্দীন জিজ্ঞেস করলে, ‘কি করে যাবে?’ রুরুর ঝটপট উত্তর : কেন? একাই যাব, হেঁটে, লোককে জিজ্ঞেস করে। Ñ এই যে বলা, স্বাধীনচেতার, এ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়ের। প্যারিসের মেট্রো, পথঘাট কিচ্ছু চেনে না, তাতে কী। বয়স বারো-চৌদ্দও নয়। কলকাতা নয়, রুরুর শৈশব-যৌবনের শহর বোম্বে (মুম্বাই)। সব সড়ক, অলিগলি-তস্যগলি হাতের তালুর মতো চেনা, ‘দোসা-ইডলি খাবে? এখানে নয়, ওই গলিতে চলো, হাঁটতে হবে। সস্তা ও সুস্বাদু।’ কোন স্কুল, কলেজে পড়েছে দেখিয়ে, জাহাঙ্গীর গ্যালারিতে প্রদর্শনী দেখে, তাজ হোটেলের পেছনে, কিয়ত দূরে, রেস্তরাঁ-কাম বারে ‘এখানে জার্মান বিয়ার পাওয়া যায়’ বলে ঢুকে পড়ে। ‘ওই রেস্তরাঁয় বেদানার পোলাও বিখ্যাত, শতাব্দী প্রাচীন, মালিক ফার্সি, একবার খেলে পেট ভরলেও মন ভরবে না। আবার যাবে।’ মিথ্যে বলেনি। পর পর তিন দিন লাঞ্চ। রুরু নির্বাসিত, অর্থাৎ স্বভূমি, স্বভাষা ছাড়া ভিনদেশে, ভিন অঞ্চলে ঠাঁই, হোক তা ভারতে, সাংবিধানিক স্বরাষ্ট্রে। রুরুর কাছে ভিন জমিন, ভিন-ভাষা কোন ব্যাপারই নয়, সব ভূমি, সব সমাজ, সব মানুষ, সব ধর্ম, সব জলহাওয়াই আপন, নিজস্ব। মুম্বাইকেও আপন করেছে, আঞ্চলিকতার বদলে সর্বভারতীয়, সর্বদেশীয়, সর্বমানবিক। এই গুণাবলী, অন্নদা শঙ্কর-লীলা রায়ের মানবিকতা থেকেই প্রাপ্ত। অবাক মেনেছি রুরুর অক্ষোহিনী দেখে। ‘অক্ষোহিনী’ বলতে বন্ধুবান্ধব বোঝাচ্ছি। সেনাপতি রুরু। কমান্ডার নয়, প্রত্যেকের সঙ্গে অমায়িক, হৃদয়াত্মক। রুরুই নিয়ে গিয়েছে রাজেশের বাড়িতে। ওখানেই থাকছে। আড্ডা। রুরুর টানে একদল হাজির। ওঁরা ফিল্মের সঙ্গে যুক্ত। মেয়েটির নাম সুজাতা (হয়ত), রাজস্থানী। বললে, শরণ্য ঈশ্বর। আমাদের দেখভালে। এ রকম প্রাণবন্ত ঈশ্বর ছাড়া আমরা নিষ্প্রভ। ‘ঐব রং ড়ঁৎ পঁপশড়ড়, ধ যধৎনরহমবৎ ড়ভ ঝঢ়ৎরহম, ’ Ñএই বয়ান কতটা সত্যি?Ñ পরখ করি। অক্ষোহিনীকুল বললে, ‘ইয়েস।’ রুরুর দিগন্ত উদ্ভাসিত হাসি। সুজাতা ওকে চুমু খেলে। বার্লিন-সময় রাত্রি দেড়টা। গোটা তল্লাট তুষারে আচ্ছন্ন, শীতের তাপমাত্রা মাইনাস সতেরো, হঠাৎ টেলিফোন, আমেরিকার পেনসিলভানিয়ার লানসভেল থেকে, বিবির কণ্ঠ, আমার রুরু, আমার রব, এ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে, তোমার রুরু মারা গেছে গোয়ায়। শূটিংয়ে গিয়ে (রুরু হিন্দী ফিল্মে জড়িয়েছিল কয়েক বছর আগে। সংলাপ, স্ক্রিপ্ট রচনায়।) আমার ভুবন তো আজ হলো কাঙাল, কিছু তো নাই বাকি, ওগো নিষ্ঠুর, দেখতে পেলে তা কি। রুরু-ছাড়া মুম্বাই, পুনে কাঙাল, নিরক্ত, প্রাণহীন। ৮ মার্চ ২০১৭ বার্লিন, জার্মানি
×