ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর ॥ উনিশ শতকের প্রাণপুরুষ

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ১০ মার্চ ২০১৭

ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর ॥ উনিশ শতকের প্রাণপুরুষ

শৈশবকাল থেকেই প্রতিভার স্ফুরণ দেখে মাত্র চার বছর বয়সে পিতা ঠাকুরদাস পুত্র ঈশ্বর চন্দ্রকে গ্রামের পাঠশালায় ভর্তি করে দেন। গ্রামীণ বিদ্যালয়ে পাঠ সমাপ্ত করে ৮ বছর বয়সে পিতার সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র কলকাতার উদ্দেশে রওনা হন। বিনয় ঘোষের ‘বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ’ বই থেকে জানা যায়, গ্রাম থেকে আসার পথে মাইল স্টোন দেখে ঈশ্বরচন্দ্র ইংরেজী সংখ্যাগুলো আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন। মাতা ভগবতী দেবী ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান, মানবিক একজন শাস্ত্রিক মহিলা। বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তির বাহিনী আজও আমাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে বিস্ময়ে অভিভূত করে। কথিত আছে, মায়ের নির্দেশেই শাস্ত্র ঘেঁটে তিনি হিন্দু-রমণীদের মুক্তির সমস্ত উপায় খুঁজে বের করেছিলেন। কিন্তু পিতার বেলায় বাল্যকালে তাঁর বোধ, অভিব্যক্তি একটু ভিন্ন মাত্রার ছিল। বিনয় ঘোষের লেখায় আরও পাওয়া যায়, বিদ্যাসাগর বর্ণিত সুবোধ এবং দুষ্টু বালকের মধ্যে তিনি নিজেই ছিলেন দুরন্ত বালক। বাল্যকালে পিতার নির্দেশ অমান্য করা তাঁর জন্য এক কৌতুকপ্রিয়তা আনন্দ ছিল। পিতা যদি কোনদিন স্নান করতে বলতেন বিদ্যাসাগর ২-৩ দিন পুকুরের ধারেকাছেও যেতেন না। কিন্তু যেদিন মানা করতেন সেদিন তাঁকে আর কেউ পুকুর থেকে তুলতে পারত না। অর্থাৎ অতি বাল্যকাল থেকেই নিজের মতো চলা, স্বাধীন মনোবৃত্তি, স্থিরচিত্ত তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। জীবনভর সেই অকৃত্রিম চারিত্রীক দৃঢ়তায় তিনি বীরদর্পে সামনের দিকে এগিয়ে গেছেন সমস্ত বাধা বিপত্তিকে তুচ্ছ জ্ঞান করে। জ্ঞানতাপস, জনহিতৈষী, মানবিক বোধে আবিষ্ট, নারী জাতির যথার্থ দিশারী বিদ্যাসাগর আজও আমাদের নমস্য, পরম পূজনীয় এবং আরাধ্য প্রবাদপুরুষ। তাঁর শিক্ষা জীবন ছিল সংস্কৃত, বাংলা এবং ইংরেজীর মহাসম্মিলনে এক নিরবচ্ছিন্ন জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তি চর্চা। জ্ঞান সাধনায় নিমগ্ন এক প্রবাদপ্রতিম কৃতী পুরুষকেই ‘বিদ্যাসাগর’ ভূষণে অভিষিক্ত করা হয়। ১৮২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা সংস্কৃত কলেজে তিনি ভর্তি হন ১৮২৯ সালে। মাত্র ৯ বছর বয়সে। কলেজটির বয়সও মাত্র ৫ বছর। আত্মজীবনীতে এই কলেজের স্মৃতি রোমন্থন করে তার শিক্ষার অনেক ঘটনা উল্লেখ করেন ঈশ্বরচন্দ্র। প্রথম বছর পড়াশোনা করেন ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণীতে। পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৮৩০ সালে এই কলেজের ইংরেজী শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৮২৯ থেকে ৩৫ সাল পর্যন্ত তিনি সংস্কৃত এবং ইংরেজী বিষয়ের ওপর তাঁর শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যান। মেধা এবং মননের অনন্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন তিনি তাঁর শিক্ষাজীবনে। প্রতিবছর মাসিক বৃত্তি থেকে শুরু করে গ্রন্থ পারিতোষিক অর্জন করেন সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ। সাহিত্য, অলঙ্কার এই সব কঠিন বিষয়েও তিনি বিশেষ জ্ঞানার্জনে সক্ষম হন। প্রতিবারই নানা পুরস্কারে ভূষিত হতেন। এই তেজস্বী এবং তীক্ষè মেধাবী ছাত্রটি সব সময়ই তাঁর অগ্রজদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হতেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যা তা হলো ১৮৩৯ সালের ২২ এপ্রিল হিন্দুল কমিটির পরীক্ষা দেন ঈশ্বরচন্দ্র। এই পরীক্ষাতেও অসাধারণ কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। ১৬ মে ল কমিটি তাঁকে যে প্রশংসা পত্রটি দেয় তাতেই তাঁর নামের সঙ্গে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিটি সংযুক্ত করা হয়। তাঁর বিস্তৃত কর্মজীবন ও অভিনবত্ব, চমকপ্রদ এবং বর্ণাঢ্য। গভীরভাবে লেখাপড়ায় নিজেকে মনোনিবেশ করতে গিয়ে যে সব সমস্যা মোকাবেলা করেছেন সেখান থেকেই তাঁর বোধোদয় হয় যে কোন ভাষাকে সহজ, সরল এবং সহজবোধ্য করতে না পারলে শিশু বয়সে তা আয়ত্তে আনা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। এই কারণে প্রথমেই তার নজরে আসে মাতৃভাষার প্রতি। বাংলাভাষাকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং সহজবোধ্য করার তার অক্লান্ত প্রচেষ্টা আজও স্মরণীয়। কঠিন ও দুর্বোধ্য বাংলা শব্দ এবং বাক্যকে কতখানি সহজ-সরলভাবে উপস্থাপন করা যায় সে প্রচেষ্টা তিনি সব সময় চালিয়ে গেছেন। শুধু তাই নয়, ভাষার যে গঠনশৈল এবং শৈল্পিকবোধ তাও বিদ্যাসাগরকে তাড়িত করে। ফলে সহজ কিংবা সরলতাই নয় নান্দনিকতাও তার ভাষার অন্যতম শৌর্য হয়ে ওঠে। ভাষা-সৌন্দর্যের ওপর বিদ্যাসাগরের এই অভূতপূর্ব কীর্তি সমকালে বিশেষ আলোড়ন তোলে। এই সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথও বলেন, বাংলা ভাষাকে পূর্ব প্রচলিত অনাবশ্যক সমস্যাড়ম্বর ভার হতে মুক্ত করিয়া তাহার পদগুলোর মধ্যে অংশ যোজনায় সুনিয়ম স্থাপন করিয়া বিদ্যাসাগর যে বাংলা গদ্যকে কেবলমাত্র সর্বপ্রকার ব্যবহারযোগ্য করিয়াই ক্ষান্ত ছিলেন তাহা নহে, তিনি তাহাকে শোভন করিবার জন্যও সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। ১৮৫৩ সাল থেকে তার অসাধারণ রচনা এবং সাহিত্য সংক্রান্ত গ্রন্থগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। ব্যাকরণ কৌমুদীর ১ম, ২য় এবং ৩য় ভাগ প্রকাশ বাংলা ব্যাকরণের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দলিল। এ ছাড়াও মহাকবি কালিদাসের ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম’-এর পরিশুদ্ধ বাংলা রূপান্তর ‘শকুন্তলা’ প্রকাশিত হয়। রামায়ণের কাহিনী অবলম্বনে ‘সীতার বনবাস’ আখ্যানটিও বিশেষ কৃতিত্বের দাবি রাখে। এরই মধ্যে বিধবা বিবাহ প্রচলন, বহুবিবাহ রোধ, শিক্ষা, নারী শিক্ষা প্রসার বাল্যবিয়ের মতো সামাজিক অভিশাপের বিরুদ্ধেও তার ক্ষুরধার লেখনীকে নিরন্তর সজাগ রাখেন। এ ছাড়াও অল্প বয়স্ক বালক-বালিকাদের জন্য ‘বোধোদয়ের মতো এক যুগান্তকারী গ্রন্থও রচনা করেন। বইটির সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের নিজের বক্তব্য ছিল, ‘বোধোদয় নানা ইংরেজী পুস্তক হইতে সঙ্কলিত হইল কিন্তু পুস্তকবিশেষের অনুবাদ নহে। অল্প বয়স্ক সুকুমারমতি বালক-বালিকারা অনায়াসে বুঝিতে পারিবে, এই আশায় সরল ভাষায় লিখিবার নিমিত্তবিশেষ যতœ করিয়াছি।’ মহাপুরুষদের জীবনচরিত পাঠ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে, পরিশীলিত করে, নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে এই বোধে বিদ্যাসাগর ইংরেজী থেকে বাংলায় মহামানবদের জীবনালেখ্য অনুবাদ করলেন। কোপানিকস, গ্যালিলিও, নিউটন, হার্শেল, গ্রোশস, লিনিয়স ডুবাল, জেঙ্কিস ও জোন্সের মতো কয়েকজন জ্ঞানী-গুণী ও বরেণ্য ব্যক্তিদের জীবনচরিত বিদ্যাসাগরের হাত দিয়ে অনূদিত হলো। তিনি শুধু বাংলা ও সংস্কৃতিতেই অগাধ পা-িত্য অর্জন করেছিলেন তা নয়, ইংরেজী ভাষায়ও তাঁর দখল ছিল উল্লেখ করার মতো। শিক্ষা এবং নারী শিক্ষার জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাঁর কর্মযজ্ঞ আজও শ্রদ্ধা মিশ্রিত বিস্ময়ের সঙ্গে স্মরণ করতে হয়। অসংখ্য বিদ্যালয় আর বালিকা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা এই কিংবদন্তি মহামানব আজও শিক্ষার অগ্রনায়ক হিসেবে আদৃত, শ্রদ্ধার্হ। কিন্তু সমকালীন অঙ্গনে সাড়া যেমন জাগিয়েছেন পাশাপাশি সমালোচনার আক্রমণ থেকেও রেহাই পাননি। উনিশ শতকের আর এক কালজয়ী কথাশিল্পী ও সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসে এই কথা বলতেও দ্বিধা করেননি। ‘বিদ্যাসাগর নামে এক মহাপ-িত বিধবা বিবাহের সপক্ষে কথা বলিতেছেন; তিনি যদি প-িত হন তবে মূর্খ কে?’ উনিশ শতকের সাহিত্যের আর এক দিকপাল কবি ঈশ্বরগুপ্ত নারী শিক্ষা নিয়ে যা বলেন তাও বিস্ময়ের উদ্রেক করে। ‘আগে মেয়েগুলো ছিল ভালো, ব্রত ধর্ম কর্তো সবে। একা ‘বেথুন’ এসে শেষ করেছে, আর কি তাদের তেমন পাবে।’ অথচ কবি ঈশ্বরগুপ্ত আধুনিক বাংলা কবিতার একজন পথিকৃৎ। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিনম্র শ্রদ্ধায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বিভিন্ন সময় স্মরণ করেছেন। কবির আর্থিক অনটনের সময় বিদ্যাসাগরের অসামান্য দান তাঁর বিপন্ন জীবনকে কতখানি নিঃসংশয় করেছিল সেই স্মৃতি মধুসূদন বিদ্যাসাগরের উদ্দেশ্যে লেখা এক কবিতায় শ্রদ্ধাভরে উল্লেখ করেছেনÑ ‘বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে। করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে, দীন যে দীনের বন্ধু! উজ্জ্বল জগতে হেমাদ্রির হেম ক্লান্তি অম্লান কিরণে।’ শুধুমাত্র মাইকেলকেই নন, বিদ্যাসাগরের আর্থিক সহযোগিতার কাহিনী সমসাময়িককালে এমনভাবে প্রচলিত ছিল যে তাঁর কাছ থেকে কেউ নাকি কখনও খালি হাতে ফিরে আসত না। আর রবীন্দ্রনাথ তো জীবনভর তাঁর চেতনার বিদ্যাসাগরকে ধারণ করেছেন, প্রাণিত হয়েছেন, দীর্ঘ জীবনের কর্মযজ্ঞ আর সাহিত্য সৃষ্টিতে এই অনুপম ব্যক্তিত্বের ধারককে প্রণতি জানিয়েছেন। কবির ভাষায়, ‘দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রের প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব এবং যতই তাহা অনুভব করিব ততই আমাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ ও বিধাতার উদ্দেশ্য সফল হইবে এবং বিদ্যাসাগরের চরিত্র বাঙালীর জাতীয় জীবনে চিরদিনের জন্য প্রতিষ্ঠিত হইয়া থাকিবে।
×