ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

যান্ত্রিকতার কাছে হার মেনেছে আবেগ

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২৮ জানুয়ারি ২০১৭

যান্ত্রিকতার কাছে হার মেনেছে আবেগ

হাতে বোনা উলের তৈরি শীতের পোশাকের দিন শেষ হয়েছে অনেক আগেই। যান্ত্রিক জীবনে সবকিছুই যখন হাতের নাগালের মধ্যে তখন দিনের পর দিন উল-কাঁটার-সন্ধির দিনও ফুরিয়ে গেছে। তবে এর আবেদন এখনও রয়েছে গ্রামাঞ্চলে। এখনও শখের বসে বাড়িতে বসে পরিবারের ছোট ছোট পরিধেয় তৈরি করে গ্রামীণ নারীরা। এখন এমন দৃশ্য সচরাচর দেখা মেলা ভার। তারপরেও ঘরে বসে সেলাইপ্রেমী নারীরা নিতান্তই শিশুদের জন্য তৈরি করে উলের ছোট ছোট পরিধেয়। যেমন মাফলার, টুপি কিংবা গায়ের চাদর। কেউ নতুন উল কিনে, আবার কেউ পুরনো উলের সোয়েটার কিনে সেখান থেকে উল খসিয়ে এসব পরিধেয় তৈরি করে একান্ত অবসরে সংসারের অন্যসব কাজের ফাঁকে। শীত শুরুর আগে থেকেই উল-কাঁটার সংগ্রহ শুরু হয়। আগে গ্রামের আঙিনায় এমন দৃশ্য হরহামেশা দেখা গেলেও এখন অতীত। যান্ত্রিক যুগে বর্তমানে পোশাকের বাজারে চলে এসেছে জ্যাকেট, সোয়েটার, মাফলার, টুপি স্কার্ফ আরও কত কি। নানা ডিজাইনে অসাধারণ সব কম্বিনেশনে মিলছে এসব পোশাক। এসব কারণে উল কাঁটার ব্যবহারও নেই বললে চলে। বাজারে এখন আর আগের মতো শীতকাল এলে উলের দোকানে ভিড় দেখা যায় না। এখন উলের দোকান থাকলেও সেখানে কেনাবেচা কমে গেছে। বরং উলের দোকানদাররাও তাদের দোকানে উলের পরিবর্তে স্থান দিয়েছে উলের তৈরি পোশাকের। আগে শীতকাল শুরু হবার দু-তিন মাস আগে থেকে ঘরের মা-বোনেরা সোয়েটার বোনা শুরু করেছে। ঘরের নারীরা শুধু সোয়েটার, মাফলার, শিশুদের টুপি বোনাই নয় পরিবারের জন্য তৈরি করেছে অনেক পরিধেয় বস্ত্র। সংসারের নিয়মিত কাজের বাইরে চলেছে এসব কাজ। এখন এসবও অতীত হয়ে গেছে। ঘরের মা-বোন শখ করে এসব করেছে। দুটি ধাতব কাঠি দিয়ে সন্তানের গায়ের মাপ নিয়ে বিভিন্ন রঙের উলের গুটি থেকে বুনেছে সোয়েটার। সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা কাজের ফাঁকে তাদের হাত চলেছে অনবরত। এক সময় দেখা গেছে অসম্ভব সুন্দর ফুল সোয়েটার। ঘরের সবার জন্যই সোয়েটার বুনেছে মা-বোন মিলে। এখন বাজারে হাজারো রঙের আধুনিক মানের সোয়েটারের কাছে মা বোনদের হাতে বোনা সোয়েটার তুচ্ছ হলেও তাতে থেকেছে মায়ের আদর আর ভালবাসা। এখন অনেক দামী দামী লেদারের জ্যাকেট নেমেছে, তবে তাতে নেই প্রিয়জনের হাতের স্পর্শ কিংবা মায়ের ভালবাসা। রাজশাহীর তানোর উপজেলার ইলামদহী গ্রামের রফিকুল আলম মুকুল। এখন গাজীপুরের এক সোয়েটার কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাঁর কোম্পানিতে এখন নানা ধরনের শীতের পোশাক তৈরি হয়। বেশিরভাগই উলেন। তবে ছোটবেলায় মায়ের হাতে তৈরি সেই সোয়েটারের সঙ্গে যে ভালবাসা মিশে ছিল এখন তা নেই। তিনি ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করে বলেন, আগে শীত শুরুর আগেই বাবার কাছে মা বায়না ধরতেন উল কিনে দেয়ার জন্য। তখন কাঁটাও পাওয়া যেত না। স্কুলে যাওয়ার পথে সাইকেলের গ্যারেজ থেকে ফেলে দেয়া স্পোক নিয়ে এসে মায়ের হাতে দিতেন। মা সেগুলো শানে ঘষে মাথা পাতলা করে বোনার কাজে লাগাতেন। বাবা বাজার থেকে উল কিনে দিতেন না। বাধ্য হয়ে মা ঘরের পুরনো সোয়েটার, মাফলার থেকে উল খসিয়ে সেই উলে বুনতেন নতুন সোয়েটার মাফলার। নানা রঙের উলের এসব সোয়েটার আর মাফলারে উঠত নতুন ডিজাইন। তিনি বলেন, এখন মেশিনে আরও ভাল ডিজাইন হয়। আরও মসৃণ সোয়েটার মাফলার, টুপি তৈরি হয় তবে সেই সময়ে মায়ের হাতের তৈরি সোয়েটারে যে ভালবাসা আবেগ জড়িয়ে ছিল এখন তার বালাই নেই। রাজশাহী শহরের সাগরপাড়া এলাকার জুলেখা পারভীন জানান, তিনি এখনও শীতের শুরুতে উলের ছোটখাটো পোশাক যেমন শিশুদের টুপি, গলায় পেঁচানো টাই ও মাফলার তৈরির চেষ্টা করেন। তবে সময়ের অভাবে আর শেষ করতে পারেন না। শীত বিদায় নেয় অথচ তার সেই পোশাক তৈরি শেষ হয় না। আর বাচ্চারাও হাতে তৈরি এসব পোশাকের অপেক্ষায় থাকে না। বাজার থেকে কিনে দিতে হয়। একই এলাকার কলেজছাত্রী ইসরাত তো উল-কাঁটার কথা শুনেই অবাক। কিভাবে উল কাঁটায় শীতের পোশাক বোনে তা কখনো শোনেনি। তার মতো হাল জামানার প্রজন্ম হয়ত এসবের কদর বুঝবে না। তবে আগের দিনের মানুষের কাছে বিশেষ করে গ্রামীণ নারীদের মধ্যে এখনও উল-কাঁটা বোনার অভিজ্ঞতা রয়ে গেছে। Ñমামুন-অর-রশিদ রাজশাহী থেকে
×