ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ৪ জানুয়ারি ২০১৭

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

নবম অধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের ওয়াশিংটন দূতাবাসে পদায়ন (গতকালের পর) ওয়াশিংটনে কূটনীতিবিদদের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে বা আসরে কখনও ১২০ বা ১২৫ আসনের বেশি আওয়ামী লীগকে কেউ দিত না। শুধু আমিই সাহস করে বলি যে আওয়ামী লীগ ১৪০ আসনের কম পাবে না। এই অপ্রত্যাশিত ফলাফল আমার মনে হয় সমুদয় পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসীদের এবং বিশেষ করে কেন্দ্রীয় সরকারকে ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ করে এবং তখনই ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। তখনই আকস্মিকভাবে ভুট্টো এবং পাকিস্তানী প্রতিরক্ষা গোষ্ঠী এক জোট হয়ে তাদের কার্যক্রম নির্ধারণে ব্রত হন। ভুট্টোর ক্ষমতালোভ ছিল সীমাহীন, ১৯৭০ সালের ২০ ডিসেম্বরে তিনি ঘোষণা দেন যে, তিনি কোন মতেই বিরোধী দলে থাকবেন না; পাকিস্তানের নেতা হিসেবে তাকে ক্ষমতা প্রয়োগে অধিকার দিতেই হবে। তার দাবি হলো, পাকিস্তান ফেডারেল সরকারে তাকে ক্ষমতার শরিক করতে হবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমহারে। তার এই হিসেবে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি হবেন ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা হবেন না। এ রকম আজগুবি দাবি যে গণতন্ত্রে গ্রহণযোগ্য নয় সে ব্যাপারে তার কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশই ছিল না। ইয়াহিয়া নিজে আমার মনে হয় নির্বাচনের ফলাফলে একেবারেই হতভম্ব হয়ে যান এবং তার আশ্রয় হয় মদ্যপান এবং অনৈতিক কর্মকা-। এই সুযোগে পুরো রাষ্ট্রক্ষমতাটাই চলে যায় একটি সামরিক দুষ্টচক্রের হাতে যেখানে ভুট্টো ছিলেন মধ্যমণি। ৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু এক ধরনের নির্বাচনী বিজয় উৎসব পালন করে জানিয়ে দিলেন যে, ভবিষ্যতের সংবিধান ছয় দফার আলোকেই প্রণয়ন করতে হবে। তিনি এজন্য পশ্চিম পাকিস্তানের সহযোগিতাও কামনা করলেন। ১৯৭১ সাল আমাদের জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমার মনে হলো যে, শুধু ১৯৭১ সালের বিভিন্ন ঘটনাবলী সম্বন্ধে একসঙ্গে আমার বক্তব্য উপস্থাপন করব। আগেই বলে রাখি এই সময়ে আমি দেশে ছিলাম না এবং ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসে প্রথম ৬ মাস কাজ করি। পরবর্তী সময়ে কিছুদিন আমি একজন ব্যক্তি লবিস্ট হিসেবে আমেরিকার কংগ্রেস চষে বেড়াই এবং আগস্ট মাস থেকে মুজিবনগর সরকারের ওয়াশিংটন মিশনে কার্যরত থাকি। ইতোমধ্যেই বলেছি যে, ৩ জানুয়ারিতে সারাদেশের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব সাফল্যের জন্য উৎসব উদযাপন করেন। রেসকোর্স ময়দানের এই মহাসমাবেশে ৬ দফা বাস্তবেই একটি জাতীয় চার্টারে রূপান্তরিত হলো। ১২ জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানে এলেন এবং দু’দিন তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু বৈঠক করলেন। ১৪ তারিখে তিনি বললেন, তাদের আলোচনা সন্তোষজনক হয়েছে। তিনি ঘোষণা করলেন যে, বঙ্গবন্ধুই ভবিষ্যত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। ১৪ জানুয়ারিতে ঢাকায় আওয়ামী লীগ কার্যকরী পরিষদ জেনারেল ইয়াহিয়াকে ধন্যবাদ জানাল এবং আবারও বলে দিল যে, ছয় দফার ভিত্তিতেই তারা সংবিধান প্রণয়ন করবে। পরের দিনই ভুট্টো হুমকি দিলেন আসন্ন জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে তার দল অংশগ্রহণ করতে পারবে না। অতঃপর ১৭ জানুয়ারি জেনারেল ইয়াহিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের বিজয়ী নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর লারকানা আস্তানায় গেলেন। লারকানায় প্রকাশ্যে জেনারেল ইয়াহিয়া যান শিকারের উদ্দেশ্যে। কিন্তু আমাদের ধারণা সেখানে তিনি এবং তার উপদেষ্টারা কিভাবে আওয়ামী লীগের দাবির মোকাবেলা করা যাবে সে সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। লারকানায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে আরও ছিলেন তার প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার মেজর জেনারেল পীরজাদা এবং সেনাপ্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ। এই আলোচনার ক’দিন পরেই জুলফিকার আলী ভুট্টো ২৭ জানুয়ারিতে ঢাকা গেলেন এবং ৩ দিন ধরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠক করলেন। তার মূল কথা ছিল তিনি কী করে ক্ষমতায় অংশ নিতে পারেন। আরও দেখুন তার নির্বাচনী ইশতেহারে কিন্তু ছয় দফা নিয়ে বিশেষ কোন বক্তব্য নেই। তিনি কখনও ভাবেননি যে ছয় দফা নিয়ে তার কোন ঝামেলা পোহাতে হবে। আগেই বলেছি, সেনাবাহিনীর বিবেচনায় ছয় দফা তো কোন বিষয়ই ছিল না। তারা নিশ্চিত ছিলেন যে আওয়ামী লীগ একশ’ আসনে জিতলে তাদের ভুট্টোর সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছতেই হবে। সেই সমঝোতা সাধনে তারা যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে পারবে। পূর্ব পাকিস্তানের বিষয় নিয়ে তখন নিজেদের পছন্দমতো ব্যবস্থা তারা প্রতিষ্ঠা করবে। তাতেই পাকিস্তান রাষ্ট্রটি পরিচালনায় তাদের ভূমিকাই মুখ্য ও বিনিশ্চায়ক হবে। ৩০ জানুয়ারি আর একটি নাটক অনুষ্ঠিত হলো লাহোরে। দু’জন কাশ্মীরী মুসলমান একটি ভারতীয় ফকার বিমান ছিনতাই করে নিয়ে গেল লাহোরে। তারা যাত্রী ও ক্রুদের ছেড়ে দিল কিন্তু বিমানটি ছাড়ল না। ভুট্টো মহাধুমধামে তাদের অভিনন্দন জানাতে গেলেন ৩১ জানুয়ারিতে আর দোসরা ফেব্রুয়ারিতে ছিনতাইকারীরা বিমানটি পুড়িয়ে দিয়ে একটি আনন্দানুষ্ঠান করল এবং পাকিস্তানে এই দুই বীরপুরুষ আশ্রয় নিল। পাক ভারত সম্পর্ক এই মোক্ষম মুহূর্তে উত্তপ্ত করার ঝুঁকি নিলেন ভুট্টো এবং জেনারেল ইয়াহিয়া। অবশেষে ১৩ ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া ঘোষণা করলেন যে তেসরা মার্চে জাতীয় পরিষদের বৈঠক ঢাকায় বসবে। এই ঘোষণার পর ইয়াহিয়ার পরবর্তী কার্যক্রম কেমন যেন একটু বেখাপ্পা ছিল। তিনি ২১ ফেব্রুয়ারিতে তার যে নির্দলীয় মন্ত্রিসভা ছিল সেইটি বিদায় করলেন অর্থাৎ তখন তার উপদেষ্টা বলতে রইলেন শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা। এর মধ্যে অবশ্য একজন বাঙালী ছিলেন মেজর জেনারেল ইস্কান্দার করিম। তার কয়েকদিন পরেই প্রথম মার্চে জেনারেল ইয়াহিয়া বোমা ফাটালেন। তিনি ঘোষণা করলেন যে, জাতীয় সংসদের যে অধিবেশন ১ মার্চে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হলো। এই বিষয়ে যাকে তিনি ভবিষ্যত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন তার সঙ্গে কোন আলোচনাই করলেন না। এই ঘোষণার প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিক্রিয়া হলো ৩ মার্চে সাধারণ হরতাল ঘোষণা। সমাজে এক অন্য প্রতিক্রিয়া হলো যে, চট্টগ্রাম বা ঢাকার মতো কতিপয় নির্দিষ্ট শহরে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে মহাজের জনগোষ্ঠীর সংঘর্ষ। এই সংঘর্ষে ১২০ জনের মতো মারা গেল এবং আহত হলো ৩৩৫ জন। হরতাল কিন্তু চলতেই থাকল। জেনারেল ইয়াহিয়া ৬ মার্চে পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর এডমিরাল আহসানকে অব্যাহতি দিলেন এবং পূর্ব এলাকার সামরিক প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুবকে তার অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে লাটসাহেবের নিযুক্তি দিলেন। বঙ্গবন্ধু আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, ৩ মার্চে তিনি রেসকোর্স ময়দানে জনসভায় বক্তব্য রাখবেন। এই জনসভায় তিনি পৌঁছেই মঞ্চে দাঁড়ালেন এবং ১৮ মিনিটের একটি বক্তব্য প্রদান করলেন। এই বক্তব্যটি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ বক্তৃতা হিসেবে বিবেচিত হয় এবং সারাবিশ্বে উল্লেখযোগ্য বক্তৃতার একশ’টির মধ্যে একটি বলেই ইতোমধ্যে স্বীকৃতি পেয়েছে। চলবে...
×