ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

রহস্যময় কামরূপ কামাখ্যা

প্রকাশিত: ০৭:০০, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬

রহস্যময় কামরূপ কামাখ্যা

সিলেট থেকে আমরা সকাল দশটার দিকে রওনা দেই। গন্তব্য তামাবিল বর্ডার। সেখান থেকে মেঘালয় রাজ্য হয়ে আসামের রাজধানী গৌহাটি। আমাদের এবারের গন্তব্য কামরূপ কামাখ্যা। কথিত আছে জাদু বিদ্যার তীর্থ স্থান হলো কামরূপ কামাখ্যা। কামাখ্যা মন্দির হলো ভারতের অসম রাজ্যের গৌহাটি শহরের পশ্চিমাংশে নীলাচল পর্বতে অবস্থিত হিন্দু দেবী কামাখ্যার একটি মন্দির। এই মন্দির চত্বরে দশমহাবিদ্যার মন্দির আছে। এই মন্দিরগুলোতে দশমহাবিদ্যা অর্থাৎ ভুবনেশ্বরী, বগলামুখী, ছিন্নমস্তা, ত্রিপুরাসুন্দরী, তারা, কালী, ভৈরবী, ধূমাবতী, মাতঙ্গী ও কমলা- এই দশ দেবীর মন্দির। এর মধ্যে ত্রিপুরাসুন্দরী, মাতঙ্গী ও কমলা প্রধান মন্দিরে পূজিত হন। হিন্দুদের, বিশেষত তন্ত্রসাধকদের কাছে এই মন্দির একটি পবিত্র তীর্থ। আমাদের চার চাকার বাহন জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার, টিলাগড় পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তামাবিল বর্ডার এর দিকে সকাল বেলা বাসা থেকে বের হওয়ার আগে খিদেয় পেট চু চু করছিল পরে নতুন কিছু দেখার আসায় পেটের রাম রবনের যুদ্ধ যে কোথায় উড়াল দেয় তার কোন হদিস ছিলনা। তবুও এর মাঝে মা জোড় করে কেক আর বিস্কুট খাওয়াল। গাড়িতে এসি চলছে এর পরেও গরম লাগছে ভাদ্র মাসের গরম বলে কথা। আমরা দেখতে দেখতে এসে পৌঁছলাম জৈন্তা বাজারে সেখানে প্রবেশের পর থেকেই পরিবেশটা কেমন জানি পরিবর্তন হয়ে গেল। একটা ঠাণ্ডা আবহাওয়া পরশ বুলাতে লাগল। রাস্তার ডানপাশে সব উঁচু উঁচু পাহাড়। অঝোর ধারায় ঝরনার জল সমতল ভূমিতে এসে পড়ছিল। অসাধারণ সে দৃশ্য চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। তামাবিল ঢুকার পর প্রায় দুই ঘণ্টার যাত্রার সবচেয়ে বাজে সময় আমাদের মাঝে এসে উপস্থিত হলো। ভাঙ্গা রাস্তা সঙ্গে বিশালাকৃতির গর্ত মনে হচ্ছিল গাড়ি যেন এই আটকা পড়ে গেল। আমরা সাড়ে বারোটার দিকে ডাউকি বর্ডারে এসে পৌঁছাই। সেখানে পরিচিত থাকায় তেমন একটা সময় লাগেনি আধঘণ্টার মধ্যে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে নো ম্যান্স ল্যান্ড পার হয়ে আমরা ভারতের সীমান্তে পৌঁছে যাই। সেখানে আগে থেকেই বাপ্পি দা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল, বাপ্পি দাই ইমিগ্রেশনের সব ঝক্কি ঝামেলা শেষ করলেন। আমরা রওনা দিলাম শিলং এর দিকে। এক পাশে খাঁদ আর এক পাশে পাহাড় মাঝে মাঝে মেঘের আনাগোনা। আমরা প্রায় তিনটার দিকে শিলং এসে পৌঁছালাম। গৌহাটিতে হোটেল পাওয়াটা দুরূহ আর আবহাওয়া বেশ গরম তাই আমারা প্রথমে শিলং এসে থাকলাম আর শিলংয়ের লোভনীয় পরিবেশ হাতছাড়া করতে চাইলাম না। আপনি চাইলে সরাসরি গৌহাটি যেতে পাড়বেন তবে আগে থেকেই হোটেল ঠিক করে নেয়া ভাল। কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পরলাম শিলং শহর ঘুরতে। পুলিশ বাজার এলাকা ঘুরে ফিরে এলাম রাত আটটার দিকে কারণ কাল সকাল সকাল উঠতে হবে আমাদের মূল গন্তব্য আসামের রাজধানী গৌহাটিতে যেতে হলে একটু আগেই রওনা দিতে হবে। শিলং থেকে গৌহাটি একদিনে গিয়ে ভাল ভাবে ঘুরে ঐ দিনেই ফিরে আসা যায়। কাক ডাকা ভোরে আমরা ঘুম থেকে উঠে প্রস্তুত নতুন গন্তব্যে যাবার জন্য কিন্তু আমাদের আজকের গন্তব্যের সাথী সুনিল দা এখনও এসে পৌঁছাইনি। অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হচ্ছে না অবশেষে সুনিল দা এসে উপস্থিত দেরি হবার কারণ হিসেবে বললেন শিলং থেকে গৌহাটি রাস্তায় বন্যার ঢল এর জন্য রাস্তা বন্ধ ছিল তাই আসতে দেরি হয়েছে। আমরা রওনা দিলাম নতুন গন্তব্যে। গৌহাটি শহরের প্রবেশের আগেই বেশ তাপমাত্রা অনুভব করলাম আমরা আমাদের চার চাকার মহাজন বললেন শিলং এর আবহাওয়া আর গৌহাটির আবহাওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন। শিলং এ বেশ ঠাণ্ডা কিন্তু গৌহাটি তে আবার বাংলাদেশ এর মতো বেশ গরম। আমরা কামাখ্যা মন্দিরের গেটে এসে পৌঁছালাম। বেশ সুন্দর স্থাপত্যশৈলী। কামাখ্যা গেট থেকে মন্দিরের কাছে যেতে সময় লাগল প্রায় পাঁচ মিনিট। আঁকাবাঁকা চড়াইপথ ধরে উপরে ওঠার সময় গৌহাটি শহরকে দেখতে পেলাম। দেখলাম, মন্দির-সংলগ্ন এলাকাটি বহু মানুষের উপস্থিতিতে সরগরম হয়ে রয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে মন্দির চত্বরে প্রবেশ করলাম। অভিনব স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি কামাখ্যা মন্দিরগুচ্ছকে ঘিরে আছে সুন্দরভাবে বাঁধানো চাতাল। মন্দিরগাত্রে শোভা পাচ্ছে দেবদেবী এবং নারী-পুরুষের মূর্তি। মন্দির পরিসরে বেশিরভাগ পান্ডা ব্যস্ত তাদের যজমানদের নিয়ে। বাকিরা ছোট ছোট দলে ছড়িয়ে থেকে দিব্যি আড্ডা দিচ্ছে। কামাখ্যার পান্ডাদের পরনে লাল বসন, গলায় একাধিক রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে বড় লাল টিপ। গাড়িতে থাকাকালীনই আমাদের সুনিল দাদা বললেন গাড়িতে জুতা, ক্যামেরা, মানিব্যাগ রেখে যাবার জন্য। বলে রাখা ভাল মন্দিরের ভেতরে আপনি ক্যামেরা নিয়ে ঢুকতে পাড়বেন না। আমি আবার জিগ্যেস করলাম ৫০০ টাকার টিকেটের লাইন কোনটা আমি আগে থেকে শুনেছিলাম যে সেখানে ৫০১ টাকার আর ১০১ টাকার টিকিটের লাইন আছে দাদা বললেন আগে ছিল কিন্তু নতুন সরকার আসার পর এই টিকিটের নিয়ম বন্ধ করে দিয়েছে। সবাই কে এখন একই লাইন ধরে ভিতরে প্রবেশ করতে হয়, মন্দিরে পান্ডাদের ছাড়া পূজা দেওয়া যায় না। আমরা গাড়ি থেকে নেমে একজন পান্ডা ঠিক করলাম। বেশ। বয়স্ক নাম জগদীশ। ওনাকে কিছু টাকা দিলাম পূজার দ্রব্যাদি কেনার জন্য। উনি আমাদের এগিয়ে নিয়ে চললেন প্রথমে আমরা একটা লোহার ব্রিজ পেরিয়ে মন্দিরে দিকে ধাবিত হলাম জগদীশ পান্ডে মন্দির সংলগ্ন সৌভাগ্যকুন্ডে গিয়ে কুন্ডের জল আমার গায়ে ছিটিয়ে দিলেন আর কি জানি মন্ত্র পরলেন। একদিকে কুন্ডের জ্বলে সবাই সিক্ত হচ্ছে অন্যদিকে ডান পাশে অবস্থিত গণেশের মূর্তিতে পূজা দিচ্ছে। ভেতরে ঢোকামাত্র এক অদ্ভুত পরিবেশের মধ্যে গিয়ে পড়লাম। ধূপের গন্ধ, ফুলের সৌরভ, নিভে যাওয়া মোমবাতি এবং প্রদীপের গন্ধ, ভক্তদের দেবী বন্দনা, পান্ডাদের মন্ত্রপাঠ, দলবিচ্ছিন্ন মানুষদের ডাকাডাকি, চেঁচামেচি- সব মিলিয়ে মনে হয় এ যেন সম্পূর্ণ এক অন্য জগৎ। মূল গর্ভ গৃহ অন্ধকার শুধুমাত্র প্রদীপের আলোয় আলোকিত। ভিতরে খুব কম সময়ই পাওয়া যায় অবস্থানের জন্য । আমরা দেবী দর্শন করে বাইরে বের হলাম। জগদীশ পান্ডে এ মন্দির সম্পর্কে জানালো, প্রাকৃতিক এক রহস্যময় গুহাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এই কামরূপ কামাখ্যা মন্দির। ওই যে দেখুন, সিংহাসনে আসীন অষ্টধাতুর কামাখ্যা দেবীর বিগ্রহ। একসময় এ জায়গায় কেউ গেলে আর ফিরে আসত না। হাজার বছরের রহস্যময় স্থান কামরূপ কামাখ্যা। এখনও জাদুবিদ্যা সাধনার জন্য বেছে নেওয়া হয় কামাখ্যা মন্দিরকেই। কামরূপ কামাখ্যার আশপাশের অরণ্য আর নির্জন পথে নাকি ঘুরে বেড়ায় ভালো-মন্দ আত্মারা। ছোট্ট দুটি শব্দ। ‘কামরূপ কামাখ্যা’। আর এই দুটি শব্দের মধ্যেই লুকানো তাবৎ রহস্য, রোমাঞ্চ আর গল্পগাথা। কামাখ্যা মন্দিরে চারটি কক্ষ আছে: গর্ভগৃহ ও তিনটি মণ্ডপ (যেগুলোর স্থানীয় নাম চলন্ত, পঞ্চরতœ ও নাটমন্দির)। গর্ভগৃহটি পঞ্চরথ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। অন্যগুলোর স্থাপত্য তেজপুরের সূর্যমন্দিরের সমতুল্য। এগুলোতে খাজুরাহো বা অন্যান্য মধ্যভারতীয় মন্দিরের আদলে নির্মিত খোদাইচিত্র দেখা যায়। জগদীশ পান্ডে কে বললাম, এবার মন্দিরের বাইরে কোথাও গিয়ে বসি। মন্দিরের বাইরে এলাম আমরা হেঁটে পূর্ব দিকে এগিয়ে চললাম। আমরা ব্রহ্মপুত্রের তীরে গিয়ে বসি। হেঁটেই চলছি, দেখি প্রতিটি বাঁকেই দৃশ্যপটের পরিবর্তন ঘটছে। পাহাড়ের ওপর থেকে ব্রহ্মপুত্রের প্রবহমান পথ, নদী-তীরবর্তী বিভিন্ন ঘাট এবং গৌহাটি শহরের অনেকটা অংশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আমরা একটা আশ্রমে ঢুকতেই দেখি, কয়েকজন পান্ডা বসে গল্প করছে। এক সন্ন্যাসী বসে আছে ‘সাপ‘ নিয়ে। বিরাট এক কালনাগিনী দেখেতো ভয়ে আঁতকে উঠলাম। জগদীশ পান্ডে আমাকে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে বলল, সাপ দেখে ভয় পাচ্ছেন কেন। আমরা তো সাপ নিয়ে খেলাধুলা করি। এদিকে আমার পেটে রাম রাবনের যুদ্ধ চলছে আমার চেহারা দেখে দেখে হয়তো জগদীশ পান্ডে বুঝতে পেরেছেন আমার পেটে যে রাম রাবণে যুদ্ধ চলছে উনি বললেন চলুন আখড়ায় খাওয়া-দাওয়া করে নিন ওনার কথা আর ফেলতে পারলাম না। গরম গরম ভুনা খিচুড়ি, ছানার তরকারি, সবজি, আর পায়েস অসাধারণ স্বাদ। জগদীশ পান্ডে বলল, চলুন শ্মশানঘাটের পরে এক জঙ্গল রয়েছে- এ জায়গায় গেলে কামরূপ কামাখ্যা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবেন। আর ওখানেই তো জাদুটোনা হয়। আর এ জন্যই তো এই কামরূপ কামাখ্যাকে বলা হয় জাদুটোনার দেশ। শ্মশানঘাটের পাশ দিয়ে আমরা হেঁটে চলছি। জগদীশ পান্ডে বললো, সন্ধ্যা হওয়ার পরে এ পথে কেউ আর আসতে চায় না। বললাম, কেন? জগদীশ পান্ডে বললো শ্মশানে বসে কারা যেনো ভয়ভীতি দেখায়। তাদের চেহারা বড়ই বিদঘুটে। আমার কেমন জানি ভয় ভয় লাগলো। আর এদিকে সন্ধ্যা হতে চললো ওকে বললাম, জাদুটোনা দেখবো না চলো ফিরে যাই। আমরা ফিরে এলাম আমাদের গাড়ির কাছে ফিরে চললাম শিলং এর পথে। পথের ঠিকানাÑ ঢাকা থেকে গৌহাটি বিভিন্নভাবে যেতে পারবেন ঢাকা থেকে কলকাতা সেখান থেকে ট্রেন অথবা প্লেন এ করে যেতে পারবেন গৌহাটিতে তবে সবচেয়ে সহজ পথ হচ্ছে ঢাকা থেকে সিলেটের পর শিলং হয়ে গৌহাটি। তবে সেক্ষেত্রে আপনাকে ডাউকি বডার উল্লেখ করে দিতে হবে। ংঁসধহঃধংৎঁঃর@ুধযড়ড়.পড়স
×