ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নূর কামরুন নাহার

আমিনুল ইসলামের কবিতা ॥ ইতিহাস ও আধুনিকতার ল্যাপশট

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬

আমিনুল ইসলামের কবিতা ॥ ইতিহাস ও আধুনিকতার ল্যাপশট

‘বৃষ্টির নূপুর শুনে যে-নদী নেচে ওঠে আপনার নিঃসঙ্গ অন্তরে আর বলে ও আকাশ! চাও তো সিন্ধমুখী পানিপথে সাথি হয়ে যাও! আমি তার কাছে সঁপেছিলাম আমার যাবতীয় জলশূন্য দিন।’ আমিনুল ইসলাম তার যাবতীয় জলশূন্য দিন যে নদীর কাছেই সঁপে দিক তাঁর তৃষ্ণার নদী ও পূর্ণতার পাঠ একান্তই কবিতার কাছে সমর্পিত। কবিতা আপাদমস্তক গ্রাস করে নিয়েছে তাঁর রাত্রি-দিন আর দিনযাপনের বাস্তবতা, অথবা এই দিন যাপনের যে বাস্তবতা তাই হয়ে উঠেছে কবিতা। আমিনুল ইসলাম তার নিত্যদিনকে ধারণ করেছেন কবিতায়। চারপাশে বেজে ওঠা শব্দ, সময়, জীবন, সম্পর্কগুলোর বাণিজ্যিকীকরণ, লেনদেন, বহুজাতিক সংস্কৃতি এসব কিছুই তার কবিতার বিষয়-আশয়। বন্দরে বন্দরে স্বপ্নের বিলবোর্ড / মোড়ে মোড়ে হৃদয়ের ছবি ফলে তো এসে যায় অনেকেই/সাথে নিয়ে মহামূল্যবান পুঁজি। ন্যাশনাল শরীর- মাল্টিন্যাশনাল মন। এভাবেই আমিনুল ইসলাম কবিতায় সমকাল, আধুনিক বোধ, প্রাত্যহিক জীবন, ডিজিটাল জীবন, কর্পোরেট জীবন, আমলাতন্ত্র, হৃদয়হীনতাকে, ক্ষয়ে যাওয়া বোধকে তুলে নিয়ে এসেছেন শিল্পিত অবয়বে। মুন্সিয়ানার সঙ্গে কবিতার শরীর সাজিয়েছেন দৈনদিনের চেনা শব্দের অচেনা আমেজে আর চমৎকার উপমায়- সম্মত সিদ্ধান্ত হয়ে জড়িয়ে আছো প্রজ্ঞাপিত প্রাণে নাকি হয়ে উঠবে তলবীসভার নোটিস- অথচ হইনি আমরা দিগন্তের ছবি। ফিতাবাঁধা সিদ্ধান্তের মতো আর কত ঝুলে রবে আমাদের এক দফা দাবি? তুমি দেখাওনি ব্যালান্স শীটের ভাঁজ/আমিও চাইনি ব্যংক রির্জাভের চাবি। আমাকে দেখে হাসে- মর্নিংওয়াকে আসা ওয়ানটাইম হাওয়া। কর্পোরেট জীবন এবং আমলাতন্ত্র তার জীবনযাপনের অংশ হলেও আমিনুল শেকড় সন্ধানী কবি। নিজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে খুঁড়ে আনতে গিয়ে গিয়ে কখনও কখনও তার কবিতা গদ্যময় হয়ে উঠেছে। কিন্তু তার যাত্রা শেকড়ের দিকে। তার যাত্রা সোনালি অতীতের জরির ঝালরের দিকে। এই সময়ের পায়ে পায়ে তিনি জড়িয়ে দিতে চেয়েছেন ইতিহাসের মহাকালকে জীবন্ত করতে চেয়েছেন কালের সেই কুশীলবদেতর। তার কবিতার বিশিষ্টতা জাতীয়তার সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার মেলবন্ধন। নিজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে বৈশি^ক ইতিহাস ও বোধের বিস্তৃতি। এই সেই সোনা মসজিদ-আমাদের পূর্বজনদের প্রেম ও ঘামের সাক্ষী; ঘুণে-পোকার ঈর্ষা জাগিয়ে তাকে কাটে দিনরাত-কালের করাত আর ছদ¥বেশী ইঁদুর; স্রোতখোয়া নদীপাড়ের মতো কখন যে ভেঙ্গে পড়ে! এবং আপনাবিস্মৃতি! দ্যাখো- মন্দিরের পায়ের নিচে পায়ের পাতার মতো সমতলভূমি; এখানেই ছিল সেই নদী আর সেই গন্ধেশ্বরীর ঘাট; আহাঁটু উদোম পা ছড়িয়ে সন্ধ্যাবতী কতদিন বসেছেন এই ঘাটে! কোন্ শ্রমণের প্রেম নগ্নপায়ে চুমু খেয়ে কথায় কথায় আমরা এসে গেছি পাহাড়পুর। পাহাড় নেই, পর্বত নেই; আছে শুধু পাহাড়সমান অতীতের সোনালি গৌরব। পুঁজির বেদীতে হাসে স্ফুয়ার্ট মিল; আর অভুক্ত শিশুর মতো একপাশে পড়ে আছে প্রাচ্য হৃদয়। ... আমি ঘুরি পথে ও প্রান্তরে ;/সিডনির ব্লু মাউন্টেনে কৃষ্ণকায় আদিবাসী সাইমনকে দেখে/ মনে হয়েছিল- পুরনো পুঁথির মতো গায়ে তাঁর পরিচিত ঘ্রাণ। ইতিহাসও ঐতিহ্যের এই ভাঁজ খুলতে, সভ্যতার উৎস খুঁজতে আর শেকড় খুঁড়তে গিয়ে তিনি ব্যবহার করেছেন নানা মিথ। আমিনুলের কবিতাকে স্বতন্ত্র করেছে এই উপমহাদেশের নানা আঞ্চলিক মিথ এবং কিংবদন্তিদের উপস্থিতি। আমিনুল খুব দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন ইসলামী সংস্কৃতির নানা শব্দ ও কাহিনী- তারপর কতদিন বেহুলার পা ধুয়ে দিয়ে সে হেসেছে আর শীতল বেণী রায়-সময় শরীরের ভাঁজে ভাঁজে রেখে গেছে বঞ্চনার ছাপ, নবুয়তলাভের বয়স পার হয়ে এসেছি সেই কবে; ...আকাশ থেকে নেমে কুর্ফার মাটিতে তোমাকে পেলাম তরুণ-তুর্কী হাওয়া! তোমার ছোঁয়ায় জেগে উঠল প্রত্যাবৃত্ত যৌবনের প্রমত্ত প্রবাহ; এখন আমার নবায়িত যৌবন পাহাড়ী বন্যার মতো ভিজিয়ে দিতে পারে আঙ্গুরের ক্ষেত ভেবে তোমার যৌবনের আনাচ-কানাচ; হে গাজীর দেশের মেয়ে- আমি জানি তুমি আমার সাধের সঙ্গী হবে না; হয়ত এ কান্না শুনে মাথা নোয়াতো বিতর্কিত বিধাতার/সিংহাসন ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সিদরাতুল মুনতাহাও। আমিনুল প্রেমে বিশ্বাসী। একই সঙ্গে ভাঙতে চেয়েছেন তথাকথিত প্রেমের সংজ্ঞা। মানব-মানবীর প্রেম যে শুধু দেহজ বা কামজই নয়। প্রেমের যে আরও ভিন্ন গন্তব্য রয়েছে, রয়েছে ভিন্ন যাত্রাপথ এবং একই সঙ্গে শরীরী প্রেমের বাইরেও যে প্রেম অনিন্দ্য সুন্দর ও অনির্বচনীয় আনন্দের বিষয় হতে পারে সেটা বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই আমিনুল কবিতায় উচ্চারণ করেছেন নারী-পুরুষের রেল লাইন ভালবাসা কিংবা ঘৃণা, প্রেম অথবা বৈরিতার সাইনবোর্ড ঝোলানো স্টেশন ছাড়া অন্য কোন ঠিকানায় পৌঁছুতে পারে না- যোগাযোগ- তত্ত্বের এহেন স্বতঃসিদ্ধ ভেঙ্গে দিতে আমরা হাঁটতে শুরু করেছি; লাগেজ-টিকেটের প্রয়োজন হবে না; কারণ, আমরা ওয়েটিং রুমে ফেলে এসেছি প্রেমের মোড়ক-আঁটা স্বার্থপরতার যাবতীয় লাগেজ। প্রেমের তথাকথিত সংজ্ঞাকে লাগেজবন্দী করে দুর্দান্ত এক মানবিক সম্পর্কের দিকে যাত্রা করেও শেষ পর্যন্ত আমিনুল ইসলাম কিন্ত প্রেমিকই। প্রেমই তার আরাধ্য। প্রেমের বিজয় পতাকা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রেমযোদ্ধা- কিন্তু তথ্য অধিকার আইন যাই বলুক, যতই যুক্তি তুলে ধরুক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, এটা জানার সুযোগ পাবে না অন্য কেউ। শুধু তুমি জেনে রেখো... ইউরোপের নানা ক্লাবে খেলেও মেসি যেমন আর্জেন্টিনার, আইপিএলে কাউন্টিতে খেলেও সাকিব যেমন বাংলাদেশের, বিজয় সেনের রাজধানী বিজয়নগরের ধূসর ধ্বংসাবশেষে দঁাঁড়িয়ে থাকা হে অনার্য রাজকন্যা, প্রণয়ের পতাকা হাতে আমিও তেমনি তোমার! আমি কবি... ভালোবাসা আমার বদ-অভ্যাস এতকিছু জেনেও লাল হৃদচিহ্ন হয়ে দাঁড়াও আমার সবুজ নেশার সম্মুখে, আমি ঝড়ের গাছ হয়ে উঠি। কবিতার প্রতি নিমগ্নতা, সুন্দরের প্রতি নিবিষ্টতা কবিকে প্রেমে জারিত করে। এই প্রেম শুধু নারী-পুরুষের প্রেম নয়, এই প্রেম কবির অন্তর্গত ভাবনা, জীবনের দিকে প্রত্যাবর্তন ও অনিবার্য মায়ার বন্ধন। তাই বাবার জুতা জোড়াও তাকে জড়িয়ে রাখে প্রেম, মায়া আর স্মৃতির মধুর বেদনায়। আল্নার নিচে পড়ে আছে বাদামি রঙের একজোড়া জুতা যেন ড্রাইভারহীন আধপুরনো টয়োটা! আমার ইচ্ছে করে-জুতজোড়া পায়ে দিয়ে হাঁটতে মূলত কবি প্রেম নিরপেক্ষ হতে পারেন না। আমিনুলও এর ব্যতিক্রম নন। প্রেম দেহ বা দেহাতীত যাই হোক। প্রেম কামজ বা আত্মজ যাই হোক। প্রেমকে বায়বীয় বা তত্ত্বীয় যেভাবেই দেখা হোক না কেন, প্রেম যে এক তৃষ্ণা ও মরীচিকা, এক দুর্বিনীত মোহ এটা আমিনুলও স্বীকার করেন- ভালোবাসা অন্তরঙ্গ অনিয়মের নদী অবৈধ জলে ভেজাবে না পা অথচ ওজু-করা মন নিয়ে কেন যে কূলে এসে দাঁড়াও! কেন যে? আমিনুলের কবিতা আমি প্রিয়। কবিতায় আমিনুল থাকেন অস্তিতময়। তার কবিতা উপলব্ধির ও অভিজ্ঞতার। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের পথে হাঁটা এখন জহুরীর। আবার কখনও কখনও তার কবিতা রক্তাক্ত হৃদয়ের আর্তনাদ যে আর্তনাদ আত্মমগ্নতার না হয়ে অনেকটাই সামষ্টিক চেতনার ক্ষয়ের। আমি কি বাতিকগ্রস্ত? নাকি আমার রয়েছে অদ্ভুত ইন্দ্রিয়- যা আমাকে জাগিয়ে দেয় ইতিহাসের মোড়ে মোড়ে নিদ্রিত উঠোনে। ইতিহাসকে যিনি আনতে চেয়েছেন দিনযাপনের বাস্তবতায় ও আধুনিকতায়। স্বর্ণালী অতীত, পূর্বপুরুষের বীরত্বের গাথাকে আনতে চেয়েছেন সমকালীন ভাবনায়। পূর্বপুরুষের গৌরব, রক্তের ঋণ এবং এই ধুলায় মিশে থাকা আমার আমি বা আমার অস্তিত্বের রেখা আবিষ্কার করতে চেয়েছের বৈশি^ক নাগরিক হিসেবে। চেয়ে দেখি-সবখানেই আমি। আমি এবং আমি। কবে যে বড় হলাম? কেউ কি আমাকে হাত ধরে হাঁটতে শিখিয়েছিল? আমিনুলের কবিতাকে চিহ্নিত করতে হলে আমাদের ধারণ করতে হয় তাই ইতিহাসের সেই স্বর্ণাক্ষর আর একই সঙ্গে কসমোপটিলান জীবন ও প্রাত্যহিক জীবনে মিশে যাওয়া বিশ^ায়ন, যান্ত্রিকতা ও বোবা যন্ত্রণা। আমিনুল যেমন তার কবিতায় ব্যবহার করেছেন নিত্যদিনের আধুনিক বৈশি^ক শব্দ তার মতো করেই তার কবিতাকে বলা যায় ‘ইতিহাস ও আধুনিকতার ল্যাপশট।’ ইতিহাস ও আধুনিকতার মিশেলে আধুনিক নগর জীবন ও আমাদের লুপ্ত ঐতিহ্য আরও আলোকচিত্রিক হয়ে উঠুক তার কবিতায় আমিনুল ইসলামের এই জন্মদিনে এই প্রত্যাশা। [email protected]
×