ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

রফিকুজ্জামান রণি

’৭১-এর খ-চিত্র পাতায় পাতায় মুক্তিযুদ্ধ

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ২৫ নভেম্বর ২০১৬

’৭১-এর খ-চিত্র  পাতায় পাতায় মুক্তিযুদ্ধ

বাঙালী জাতির বেদনামিশ্রিত ও গৌরব-মহিমান্বিত একটি অধ্যায়ের নাম- স্বাধীনতা। ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ, দুই লাখ বীরকন্যার সম্ভ্রমের ভেতর থেকে জেগে ওঠা এই শব্দটি আমাদেরকে দিয়েছে বৈষম্যহীন বেঁচে থাকার অধিকার, লাল সবুজের পতাকা আর পৃথিবীর বুকে নিজেদের অস্তিত্ব তুলে ধরার এক স্বতন্ত্র মানচিত্র। দিয়েছে শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিচর্চার বিস্তীর্ণ জমিন। এখনও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটকে ঘিরে প্রতিনিয়ত এগিয়ে চলেছে নিবিড় গবেষণা। তৈরি হচ্ছে অগণন গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ ও সিনেমা-নাটক। দুষ্টের কালো থাবা এবং অপরাজনীতির বিবর্ণ ছায়া এসে স্বর্ণখচিত এই ইতিহাসটিকে বার বার ম্লান করার অপপ্রয়াসে নেমেছিল। এমনকি প্রকৃত ইতিহাস বিকৃত করে, মনগড়া ইতিহাস ঢুকিয়ে দিয়ে স্বার্থ লাভের উল্লাসে মেতে ওঠেছিল একশ্রেণীর জ্ঞানপাপী গোষ্ঠী। তবে বাঙালীর জাািতসত্তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ইতিহাসের এই সোনালি মুহূর্তকে কলুষিত করার অপচেষ্টা সফল হতে দেয়নি এদেশেরই সচেতন মহল। তারা অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে কুচক্রীমহলের নগ্ন প্রয়াসকে। ’৭১-এর বিজয়ের চার দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও পূর্বজনদের পাশাপাশি উত্তরপ্রজন্মের তরুণদের মধ্যেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সচেতনতা এবং শ্রদ্ধাবোধ দিন দিন বেড়েই চলেছে। পাশাপাশি স্বাধীনতার শত্রুদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি আদায়ের ক্ষেত্রেও সব শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে তরুণসমাজও হয়ে ওঠেছে সোচ্চার, উদ্যমী। মহান অর্জনকে স্মরণীয় করে রাখতে এবং সময়ের দায়বোধকে অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ করে রাখার প্রয়োজন উপলব্ধি করে লেখনীর দিকেও ঝুঁকেছেন কেউ কেউ। গাজী মুনছুর আজিজের ‘৭১-এর খ-চিত্র’ গবেষণাগ্রন্থটি সে ধারাবাহিকতারই একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট নিয়ে এখানে প্রায় ২৫টির মতো রচনা স্থান পেয়েছে। গাজী মুনছুর আজিজের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণাকর্ম ইতিপূর্বে মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর থেকে প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ প্রতিবেদন’ বইয়ের পাশাপাশি দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাগজে ঠাঁই পেয়েছে এবং দৃষ্টি পড়েছে বোদ্ধামহলেরও। ‘৭১-এর খ-চিত্র’ বইটি মূলত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক-সাময়িকীতে প্রকাশিত তার প্রতিবেদনগুলোর সঙ্গে নতুন কিছু লেখা সংযুক্ত করে প্রকাশ করা হয়েছে। ‘৭১-এর খ-চিত্র’ গ্রন্থে অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনসংগ্রামের বাস্তবতার কথাসহ পাকিবাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে হত্যাকা-ের শিকার হওয়া এবং গণকবরে পরিণত হওয়া নিরীহ মানুষদের কথা তুলে ধরেছেন লেখক। গুরুত্বসহকারে আলোকপাত করেছেন বীরাঙ্গনাদের দুর্বিষহ জীবন-সংগ্রামের নির্মম বাস্তবতার কথাও। এখানে নয়জন বীরকন্যার তথ্যচিত্রসহ ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে বিভিন্ন সময়ের ও ঘটনাপ্রবাহের শতাধিক দুর্লভ আলোচিত্রও তুলে ধরেছেন তিনি। যদিও দেশের সব গণকবরের ইতিহাস একটিমাত্র গ্রন্থে তুলে ধরা সম্ভব নয়। তারপরও বলা চলে যে, প্রায় অর্ধশতাব্দির কাছাকাছি পূর্ব-সময়ে সংঘটিত একটি দেশের ইতিহাস, বিভিন্ন অঞ্চলের গণকবর এবং পাকিবাহিনীর হাতে নিমর্মভাবে খুন হওয়া বাঙালীদের কথা সবিস্তারে তুলে ধরা সহজ নয়। তারপরও প্রত্যাশা রাখা যায়, আাগামী কর্মগুলোতে লেখক দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গণকবরের ইতিহাস তুলে ধরার জন্য আরও বেশি উদ্যোগী হবেন। সন্ধান দেবেন খানসেনাদের নৃশংসতার প্রমাণস্মারক বধ্যভূমিগুলোর। ‘৭১-এর খণ্ডচিত্র’ বইয়ে ঠাঁই পেয়েছে- খানসেনাদের হাতে নিহত হওয়া দাফন-কাফনহীন এবং গোছল ছাড়া সমাহিত হওয়া ৫১ শহীদের করুণ কাহিনী। তাছাড়া বক্তালীর গণহত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা, সিরাজগঞ্জের দশ বীরকন্যার জীবনকথা, পতাকা বাহক আবদুস সাত্তারের জীবন সংগ্রামের বয়ান, জগন্নাথপুরের আট কবরের অনুপুঙ্খ আলোচনা, মুক্তিযুদ্ধের বীরকন্যা কাননবালার নাম নাজমা বেগম হওয়ার নেপথ্য কাহিনী, মুক্তিযুদ্ধে হেমায়েত বাহিনীর দূরদর্শিতার গল্প, অবাঙালী মুক্তিযোদ্ধাদের কৃতিত্ব ও মুক্তিযুদ্ধে ফাদার রিগনের অবদান, মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলার ফুটবল দল, গণহত্যার সাক্ষী জল্লাদখানা ও জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ইত্যাদি তথ্যচিত্রসহ তুলে ধরেছেন তিনি। বইয়ের ভূমিকার দিকে তাকালে দেখা যায়Ñ স্বাধীনরাষ্ট্রে অযতেœ, অবহেলায়, অনেকটা পরাজিত সৈনিকের মতো বড় দুঃসহ জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা এক সূর্যসন্তান তথা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের শেষ জীবনের করুণ চিত্র। দেশমাতৃকার সম্মান রক্ষার্থে একদিন যিনি হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন, স্বাধীনতা অর্জনের কয়েক যুগ অতিবাহিত হওয়ার পরও একজন মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার হিসেবে কলার ঝুড়ি ছাড়া স্বাধীনরাষ্ট্র তাকে আর কী দিয়েছে! সামান্য পাঠ নেয়া যেতে পারেÑ ‘চন্দনীমহল গ্রাম। সে গ্রামে রয়েছে ‘স্টার জুট মিলস’ নামের সরকারি পাটকল। সে পাটকলের গেটের সামনে একজন বয়সী লোক কলা বিক্রি করেন। নাম তার ফয়েজ। সবাই তাকে ডাকে ফয়েজ কমান্ডার বলে। আমরা তার কাছ থেকে কলা কিনি। সকাল-বিকেল যখনই স্টার গেটের সামনে যাই, দেখি ফয়েজ কমান্ডার বসে আছেন সামনে কলার ঝুড়ি নিয়ে।...ছেলে বেলায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যার সঙ্গে আমার প্রথম কথা হয়, তিনি এই ফয়েজ কমান্ডার।’ এছাড়াও সংগ্রামের সময়কালে আমাদের দেশে ব্যবসায়িক কারণে ছুটে আসা পাকিস্তানী নাগরিক, অবাঙালী মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ খান পাঠান যখন স্বজাতির অত্যাচার দেখে বাঙালী মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কাজ করতে গিয়ে পাকিবাহিনীর হাতে লাঞ্ছিত হন, তারপরও মুক্তিকামীদের সেবায় ওষুধ সরবরাহ রাখা বন্ধ করেননি তখন বাঙালী হিসেবে যেমন গর্বে বুক ফুলে ওঠে; তেমনিভাবে আবার লজ্জাও জাগ্রত হয় যখন দেখা যায় অবাঙালী মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ খান পাঠানের প্রতি যথার্থ দায়িত্বশীল আচরণ করা হয় না স্বাধীনরাষ্ট্রে। গাজী মুনছুর আজিজ তার ‘৭১-এর খ-চিত্র’ বইয়ে এরকম অনেক নির্মম বাস্তবতার ইতিহাস তুলে ধরেছেন অনেকটা সচিত্র প্রতিবেদনের ঢঙে। আমরা বইটির পাঠকপ্রিয়তা এবং সাফল্য কামনা করি। ধ্রুব এষের চমৎকার প্রচ্ছদে ঢাকা ‘৭১-এর খ-চিত্র’ বইটির প্রকাশ করেছে সাহস পাবলিকেশন। মূল্য ধরা হয়েছে ২১৫ টাকা মাত্র।
×