ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

জান্নাতুল মুমিনা

যে পেট্রোল আজও পোড়ায়

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ২৫ নভেম্বর ২০১৬

যে পেট্রোল আজও পোড়ায়

নাম শিরিন। বয়স ৪৫ বছর। সাভার উপজেলার বাইপাইলে তার বাসস্থান। ২০০৮ সালে শিরিনের স্বামী মারা যায়। তিন সন্তানের জননী শিরিন গার্মেন্টসে কাজ করে তার জীবিকা নির্বাহ করত। তিনি সাভার ভিশন গার্মেন্টসে কাজ করতেন। তার উপার্জিত আয় দিয়ে ভালই চলছিল সংসার। কিন্তু কে জানে তার এই সহজ সরল জীবনও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে অন্যের। দিনটি ছিল ২০১৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি। সারাদেশজুড়ে তখন চলছিল উত্তাল রাজনীতির ভয়াল দৃশ্য। যেখানে- সেখানে অতর্কিত পেট্রোল বোমার আঘাতে শত শত মানুষের ঠাঁই হয়েছিল ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে। মানুষের চোখে মুখে সর্বক্ষণ ছিল আতঙ্কের ছাপ। সেই আতঙ্ক নিয়েই প্রতিদিনের মতো শিরিন বাসে উঠেছিল ঢাকার উদ্দেশে। কে জানত তার ভাগ্যেও আছে সেই নির্মম পরিণতি। বাসটি কলেজ গেট অতিক্রম করার সময় হঠাৎ চলন্ত বাসে পেট্রোল বোমার থাবায় এক নিমিষেই ঝলসে যায় শিরিনসহ কয়েকজন যাত্রীর শরীর। এক মিনিটেই আট থেকে দশজন মানুষ পুড়ে পঙ্গু হয়ে যায় সারা জীবনের জন্য। অন্য যাত্রীদের সঙ্গে শিরিনকেও নেয়া হয় ঢাকা মেডিক্যালে। দুই হাতসহ শরীরের অনেক অংশ পুড়ে গিয়েছিল শিরিনের, মুখের শ্রী নষ্ট হয়ে যেন সন্তানদেরও মা বলে ডাকতে ভয় হতো। বার্ন ইউনিটে ৪ মাস অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরায় শিরিন। পোড়া স্থানের যন্ত্রণা যেন প্রতি মুহূর্তে শিরিনকে প্রশ্ন করত কি দোষ ছিল তার। এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুই যেন শ্রেয়। বিধবা দরিদ্র শিরিনের পক্ষে চিকিৎসা করার মতো অর্থ ছিল না। এলাকাবাসী সাধ্যমত চাঁদা তুলে শিরিনের চিকিৎসার জন্য সাহায্য করে। সরকারীভাবে বার্ন ইউনিটের রোগীদের সাহায্যের কথা থাকলেও শিরিনের কাছে এ বিষয় জানতে চাইলে সে বলে কিছু ওষুধ হাসপাতাল থেকে দিয়েছিল কিন্তু সেভাবে কোন সাহায্য সে পায়নি। শিরিনের পরিবারে আজ দুই সন্তানসহ তিনজন বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিল আগেই কিন্তু তাকে সাহায্য করার মতো সক্ষমতা তার মেয়ের নেই। শিরিন বর্তমানে ছেলে দুটিকে ভাতের অভাবে এতিম খানায় দিয়েছে, সেখানে ছেলেরা থেকে খেয়ে কাজ করে কোন রকম নামের পড়াশোনা করছে। তারপরেও তাদের খরচ বাবদ শিরিনকে প্রতিমাসে ভিক্ষা করে ৩ থেকে হাজার ৪ হাজার টাকা দিতে হয়। যে বাসেই ছিল শিরিনের সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের শেষ দিন সে বাসেই এখন শিরিনের জীবিকার অবলম্বন। শিরিনের পোড়া মুখের বিকৃত রূপ অনেকের মনে করুণা সৃষ্টি করলেও, অনেকে তাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়। শিরিনকে প্রতিদিন ভিক্ষা করে ২০০-২৫০ টাকা পেতে প্রায় ১৫-২০টি বাসে উঠানামা করতে হয়। মোটাসোটা ভাল স্বাস্থ্য আজ যেন শিরিনের জন্য আরও অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অসুস্থ শরীরে প্রতি বাসে উঠা শিরিনের জন্য যেন বড় দুর্বিষহ ব্যাপার। আপনার আমার মা-বোনেরা যেখানে প্রতিদিন একবার অফিস করার জন্য বাসে উঠে তিনবার বাসের হেল্পারদের ঝারি দেয় সেখানে শিরিনকে একবার বাসে উঠার জন্য দশবার কটুকথা শুনতে হয় এই মহিলা বাসে উঠছো কেন, নামো, সামনের স্টেশনে নেমে যাবা। এবাভেই চলছে বিধবা দরিদ্র নিঃসঙ্গ শিরিনের প্রতিদিন। কি অন্যায় করেছিল শিরিন? তার এই মানবেতর জীবনের দায় তো আজ নেয়নি কোন রাজনীতিক। কি নির্মম আমাদের রাজনীতির চর্চা, সুস্থ স্বাবলম্বী শিরিনকে পেট্রোলে পুড়িয়ে, পঙ্গু করে মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত পেতে খাওয়াচ্ছে। আজ শিরিন একদিন ভিক্ষা করতে না পারল তাকে না খেয়ে থাকতে হয়। আজ শিরিনের ছেলে দুটি এতিম খানায় মানুষের দ্বারে দ্বারে লাথি খেয়ে বড় হচ্ছে, তাদের মা তাদের চোখের সামনে বিনা কারণে অন্যের দেয়া আগুনে পুড়ে পঙ্গু হয়েছে আজ যদি তারা বড় হয়ে বিপথগামী হয়, কিংবা কোথাও এর প্রতিশোধ নেয়, তখন এ সমাজ কি-বা তার উত্তর দেবে।
×