ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

যমুনা মাহমুদ কামাল সংখ্যা

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ১৮ নভেম্বর ২০১৬

যমুনা মাহমুদ কামাল সংখ্যা

চতুর্মাসিক যমুনার এবারের প্রকাশনা মাহমুদ কামাল সংখ্যা। ’৭০-এর দশকে প্রথিতযশা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মাহমুদ কামালের ষাটতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে অষ্টম সংখ্যার এই সঙ্কলনটি বের করা হয়। সবুজ মাহমুদের সম্পাদনায় ও প্রকাশনায় ‘যমুনা’র এবারের প্রচ্ছদ করেছেন আরিফুর রহমান। সাময়িকীটি উৎসর্গ করা হয় সদ্য প্রয়াত লব্ধপ্রতিষ্ঠার তিনজন বিশিষ্ট সাহিত্যিকের স্মরণে। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, প্রবাসী কবি শহীদ কাদরী এবং আর এক খ্যাতিমান কবি রফিক আজাদকে শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে সাময়িকীটি স্মরণীয় করা হয়। ১৯৫৭ সালের ২৩ অক্টোবর জন্ম নেয়া মাহমুদ কামালের বর্ণাঢ্য জীবন এবং সাহিত্যের পথযাত্রায় তার নিরন্তর এগিয়ে চলাকে বিচিত্রভাবে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছেন প্রতিটি প্রবন্ধকার। বিচিত্র কর্মযজ্ঞে নিজেকে সম্পৃক্ত করে সৃজনশীলতার ক্ষেত্রকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছেন যশ্বসী কবি মাহমুদ কামাল। বিরাট এই গ্রন্থে মাহমুদ কামালের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে যারা আলোচনা-পর্যালোচনা করেছেন তারাও দেশের জ্ঞানী-গুণী ও খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। আর তাই কবিকে নিয়ে লেখা প্রতিটি প্রবন্ধই নিজস্ব রচনাশৈলীতে অনবদ্য এবং বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। বিভিন্ন লেখকের লেখায় উঠে এসেছে ষাটের দশকের উত্তাল রাজনৈতিক স্রোতধারায় মাহমুদ কামালের শৈশব-কৈশোর পার হয়ে যৌবনের স্বর্ণ অধ্যায়ে পদার্পণ যা সত্তরের মহিমান্বিত দশকে কবির জীবন ও চলার পথ কিভাবে তৈরি করে দেয়। আলোচ্য সাময়িকীর লেখকদের লেখায় উঠে এসেছে মাহমুদ কামাল মূলত একজন কবি। কাব্যলক্ষ্মীর আরাধনায় যিনি সর্বক্ষণ নিমগ্ন থাকেন। তবে সৃষ্টিশীল মানুষদের সমকালীন সমাজও প্রাণিত করে, উদ্বিগ্ন করে, সচেতন বোধ তার মননশীলতাকে বিচিত্র পথে তাড়িতও করে। ফলে একমাত্র কবিতার জগতই তার অভীষ্ট লক্ষ্য হতে পারে না। সমাজের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, অর্জন, আনন্দবেদনা, ইচ্ছা-অনিচ্ছার আকাক্সক্ষা ও বিরোধও তার চেতনাকে বিভিন্ন আঙ্গিকে শাণিত করে। কবি মাহমুদ কামালও কোনভাবেই তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। কবিতার গুচ্ছমালা যেমন তার সৃষ্টিশীল আঙ্গিনাকে পূর্ণ করে পাশাপাশি শুদ্ধ চেতনার অকৃত্রিম বোধও তার চিন্তাশীলতাকে নানা মাত্রিকে উদ্বেলিত করে। ফলে কবিতা ছাড়াও গল্প, উপন্যাস এবং প্রবন্ধ সাহিত্যেও তার গতিপথ ছিল নিরন্তর। পঞ্চাশের দশকে ভাষা আন্দোলনের উত্তাপ তাকে স্পর্শ করতে না পারলেও ষাট-সত্তরের দশকে দেশত্ববোধ আর মাতৃভাষার উত্তাল স্রোত যেভাবে তাকে ছুঁয়ে যায় তার অনন্য স্বাক্ষর তার বিচিত্র গ্রন্থাবলী, টাঙ্গাইলের মফস্বলে জন্ম নেয়া মাহমুদ কামাল সারাদেশের নৈসর্গিক প্রাচুর্য, বৈষয়িক সম্পদ এবং নদীমাতৃক বাংলার স্রোতস্বিনীর অববাহিকায় নিজেকে পূর্ণ করেছেন, সমৃদ্ধ করেছেন তার নান্দনিক ভাব সম্ভারে। কবিকে নিয়ে লেখা বিচিত্র প্রবন্ধে এসব বিষয় পাঠকদের কবিকে জানতে, বুঝতে অনেক বেশি প্রভাব ফেলবে। সাহিত্যকে বিষয় করে কবি নিজেকে সমর্পণ করেছেন শিক্ষকতার মতো মহান পেশায়। যা তার সৃজনবোধের অনুষঙ্গ বললে বেশি বলা হবে না। কবিকে সমাজ, প্রকৃতি, ঐতিহ্য যেভাবে ভাবিত করেছে একইভাবে নারীচেতনাও তার সাহিত্যের অন্যতম বিশেষ দিক। নারীর প্রতি ভালবাসা, নিজেকে সমর্পণ করা, নারীসত্তায় নিজেকে অনুভব করা তার সৃষ্টির পথপরিক্রমায় এক দীপ্ত প্রয়াস। যার কারণে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পরকীয়া’র কথা সিংহভাগ লেখকের লেখায় স্থান পেয়েছে। রোমান্টিক কবির কাছে নারী শুধু শরীরী অবয়বে উপস্থাপিত হয়নি আরও গভীরে, সমমূলে তিনি নারীসত্তায় অবগাহন করেছেন। তার ‘পরকীয়া’ বৈষ্ণব সাহিত্যের রাধা-কৃষ্ণ প্রেমের এক অতুলনীয় প্রতিচ্ছায়া বলে বিভিন্ন লেখকের অভিমতে স্পষ্ট হয়েছে। সাময়িকীটি শুধু কবি মাহমুদ কামালকেই পাঠকদের সামনে হাজির করবে তা নয়, সমসাময়িক সমাজ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক গতি নির্ণয়সহ আরও অনেক প্রেক্ষাপট পাঠকদের কাছে স্পষ্ট হবে। মানুষ যেমন ব্যক্তিক একইভাবে সে সামাজিকও। সে দায়বদ্ধতায় কোন মানুষ তার সময় এবং কালকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কবি মাহমুদ কামালও পারেননি। তার সেই বোধ আর সচেতনতা প্রবন্ধকারদের মুগ্ধ করেছে। সেই দিকটিও নানাভাবে আলোচিত হয়েছে। প্রচুর প্রবন্ধের সমাহারে এতবড় আয়োজন সত্যিই অভিনন্দনযোগ্য। প্রবন্ধের বিষয়গত মান ও প্রশংসার দাবি রাখে। নতুন পাঠক তৈরি করতে সাময়িকীটি বিশেষ ভূমিকা রাখবে এ আশা করতেই পারি। আগ্রহী পাঠকদের চাহিদা মেটাতে পারবে এই কামনায় গ্রন্থটির সর্বাঙ্গীন সফলতা আশা করছি।
×