ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চৌধুরী নীহারেন্দু হোম সজল

জীবন্ত কিংবদন্তি ॥ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ১৪ অক্টোবর ২০১৬

জীবন্ত কিংবদন্তি ॥ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ

সৃষ্টিশীল শিল্পশোভন সাহিত্যই মানবসভ্যতা ও সমাজের দর্পণ। এ সংস্কৃতি প্রকাশনার বাহন রকমারি পত্র-পত্রিকাসহ বইপুস্তক বা গ্রন্থ। সমাজ সংস্কারে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। ঘুণেধরা ক্ষয়িষ্ণু সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে অনুপ্রেরণা যোগায়। অনুপ্রেরণাপ্রাপ্তরা সৃষ্টিশীল দর্পণে প্রতিবিম্বিত করে থাকেন, স্থূল-সূক্ষ্ম নানাবিধ বিচিত্র বিষয় নিয়ে পুরনোকে নতুন করে গড়ার অঙ্গীকার থাকে প্রতিনিয়ত সাহিত্যকর্মে। বাংলা একাডেমিতে প্রতিবছর অসংখ্য লেখকের লেখা বই প্রকাশিত হচ্ছে। আমার হাতেও সে রকম বই একেবারে কম নয়। তবু কেন জানি না ‘জীবন্ত কিংবদন্তি’ পুস্তিকাখানি অনুপ্রাণিত করে। সবার ওপরে মানুষ সত্য, যিনি ঐ সকল মানুষকে চেনেন, জানেন ও ভালবাসেন। তিনি ক্ষণজন্মা অবিভক্ত বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনের মহানায়ক অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। তাঁকে নিয়ে দেশ-বিদেশের সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, লেখক, দার্শনিক, গবেষক ও রাজনীতিবিদরা ৫৪’র যুক্তফ্রন্টসহ স্বাধীনতা পরবর্তী চলমান সময়ের প্রবন্ধ, নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার এবং মন্তব্য লিখাগুলো দেশ বিদেশের অনলাইনসহ বিভিন্ন দৈনিক সাপ্তাহিক পত্রিকা, ইলেক্ট্রনিক চ্যানেলে প্রকাশিত হয়েছে। ঐ লেখাগুলো সমন্বয় করে সৃষ্টিশীল বই আকারে সংকলিত করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, প্রয়াত ন্যাপ নেতা আবদুল মতিন মাস্টারের সুযোগ্য উত্তরসূরি অধ্যাপক ড. সাইফুল আলম (মামুন)। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় দেশ প্রিন্টার্স, মদিনা টাওয়ার, দক্ষিণ রায়েরবাগ, ঢাকা থেকে, পহেলা ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে। সুনামধন্য প্রকাশক ২৪টি নির্বাচিত প্রবন্ধসহ মোজাফফর আহমদের লেখা ‘আমার কথা’, ‘মানুষের সঙ্গে আমি’, ‘প্রকাশকের কথা’ শিরোনামে একটি লেখা ও দুটি কাব্য নিয়ে অপূর্ব আলপনায় সাজিয়েছেন অমূল্য পুস্তিকাখানি। সাজানো-গুছানো সৃষ্টিশীল গ্রন্থখানা ‘উৎসর্গ’ করেছেন ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের একমাত্র জামাতা প্রয়াত ডা. সৈয়দ খালেদুজ্জামান ও প্রয়াত ন্যাপ নেতা আবদুল মতিন (মাস্টার) দুজনের নামে। প্রকাশক ভূমিকায় লিখেছেন, তাঁর প্রত্যাশা ছিল, ত্রিকালদর্শী এই রাজনীতিক অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ সম্পর্কে লেখা গ্রন্থটি প্রকাশ করা অনেক আগেই উচিত ছিল। তাঁরপরও পহেলা ডিসেম্বর ২০১৫ সালে মহান বিজয় দিবসের প্রারম্ভে এদেশের নবীন রাজনীতিকের হাতে তুলে দিতে পেরেছেন। এটা তাঁর জীবনের সত্যি পরম পাওয়া। তিনি সাদামনের বড়মাপের মানুষ। ‘জীবন্ত কিংবদন্তি’ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ শিরোনামের পুস্তকখানা সম্পাদনা করেছেন, সাপ্তাহিক যুবকণ্ঠের সম্পাদক মো. আক্তার হোসেন। জীবন্ত কিংবদন্তি গ্রন্থে প্রবন্ধ, নিবন্ধ লিখেছেন যারাÑ ১৯৫৪-এর নির্বাচনে মহাবিজয়ের নেপথ্য নায়ক অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ’- মোঃ আমিনুল ইসলাম, ডেইলি স্টার ২০১৪-এর বিশেষ সংখ্যায় মোজাফফর আহমদের সাক্ষাতকার, ‘বেঁচে আছেন শুধু একজন’ ড. মোহাম্মদ হান্নান, ‘ড. মোহাম্মদ হান্নান- বেঁচে আছেন শুধু একজন’ প্রসঙ্গে- সায়েদ জয়নুল, ‘জনতার চোখ’ ‘ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ দেশের ভবিষ্যত চিন্তায় অসহায় ও বিব্রত মোজাফফরÑ রিয়াজ রহমান, ‘ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মোজাফফর’ নবনিকেত, ‘দেশের ভবিষ্যত নিয়ে শংকিত মোজাফফর আহমদ’ মিজানুর রহমান, ‘অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ’ জয়নুল আবেদীন, ‘অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের ৮৭তম জন্মবার্ষিকী ও কিছু কথা’ এম এ ওয়াহাব ও কাজী সিদ্দিকুর রহমান, ‘অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ মানুষের আর্থ-সামাজিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যচ্যুত হননি’ ড. আনিসুল হক, ‘অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ শুধু ন্যাপ নেতাই নন তিনি আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক’ আবদুল গফফার চৌধুরী, ‘অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ সেই প্রজন্ম’ হারুনুর রশিদ, ‘রাজনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ’ মোশতাক আহমদ, ‘কিছু কথা পুস্তকের শিরোনাম স্মরণে’ চৌধুরী নীহারেন্দু হোম সজল, ‘সোনার খাঁচায় কুঁড়েঘরের মোজাফফর’ বাদল নুর/শেখ মেহেদী হাসান/জিন্নাতুন-নুর, ‘‘কুঁড়েঘরের মোজাফফর: যাপিতজীবন: পীর হাবিবুর রহমান, ত্রিকালদর্শী রাজনীতিক মোজাফফর আহমদ এখন রাজনীতির পর্যবেক্ষক” দীনেশ দাশ, ‘সংসারের প্রান্ত জানালায় মোজাফফর আহমদ’ শেখ-উল সাবা, ‘একজন মোজাফফর আহমদ নির্মোহ মানুষের প্রতিকৃতি’ জায়েদুল আহসান পিন্টু, ‘দেশে শোষণ মুক্ত সমাজ হবেই’ বাদল নুর, ‘যেমন আছেন কুঁড়েঘরের মোজাফফর’ সিরাজুস সালেকিন প্রমুখ। ‘আমার কথা’ শিরোনামে লিখেছেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ নিজেই। মানুষ আমাকে যদি ভুল বুঝে, তবু আমি মানুষের কাছে যাব। মানুষের কথা আমি মানুষের কাছে গিয়েই শুনতে চাই। এই মানুষকে আমি কতবার আমার জন্য কাঁদতে দেখেছি। কতবার দেখেছি আমার বুক ভরিয়ে দিয়েছে ভালবাসায়। মানুষ সম্পর্কে আমাকে মিথ্যে কথা বল না, মানুষ আমার বন্ধু। মানুষ আমার আত্মীয়। মানুষ আমাকে ভুল বুঝলে বুঝুক, মানুষের জন্য আমার ভালবাসা। যতই বিলম্ব হোক আমি ফিরতে চাই তোমাদের কাছে ঐ ভাঙা কুঁড়েঘরে। জয় হোক জনগণের, জয় হোক মেহনতি মানুষের। রাজনৈতিক সমাজে কূপম-ূকতা যত বাড়বে, মৌলবাদ, সাম্পদায়িকতা, জঙ্গীবাদ যত শক্তি অর্জন করবে, রাজনীতিক শোষণ বঞ্চনা যত গভীর হবে, অপবুদ্ধিতা যত প্রবল ও সর্বগ্রাসী হয়ে উঠবে, ততই মোজাফফর আহমদ প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবেন। তাঁর রাজনীতিক সৃষ্টিকর্ম মননশীলতাকে নির্মোহ হতে শেখায়, সচরাচর আমরা যা দেখে অভ্যস্ত নই। চারদিকে শুধু প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির যোগ-বিয়োগের হিসাববিজ্ঞানের ছড়াছড়ি; মানুষের জন্য স্বদেশ ও ভূমি সন্তানদের জন্য নিবেদিত রাজনৈতিক নেতাকর্মীর আকালে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ আমাদের বাতিঘর হয়ে আশা জাগিয়ে রাখেন। বাঙালী চেতনাকে যারা বার বার আঘাত করেছেন, বিশ্বায়ন আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী স্বার্থের মায়া কান্নায় যারা বাঙালীর আবহমানকাল ধরে চলে আসা মানবতাবোধকে নানা রকম কূটকৌশলে ছিন্নভিন্ন করার বৈদিক প্রক্রিয়াকে পরিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার মোড়কে তরুণ সমাজের কাছে হাজির করে বিভ্রান্তি ছড়ানোয় লিপ্ত, মোজাফফর আহমদ তাঁদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক; এবং ভাসুরের নাম মুখে আনতে মানা এই বাংলা প্রবাদের মতোই তারা সবকিছু জেনে বুঝে অধ্যাপককে বেমালুম গায়ের জোরে গায়েব করে দেয়ার চেষ্টায় গলদঘর্ম হচ্ছেন। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের সুতীক্ষœাধী মানস যথোপযুক্ত সমালোচনা আর নির্মোহ সত্য প্রকাশের আশ্চর্য ক্ষমতায় আতঙ্কিত হয়েই তাঁর প্রতিপক্ষ তথা এই মাটি ও মানুষের বিরুদ্ধে কাজ করা অপবুদ্ধিবাদিদের প্রথম বিকৃত আক্রোশের শিকার অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ও তাঁর দর্শন-ধর্ম-কর্ম গণতন্ত্রের নিশ্চয়তাসহ সমাজতন্ত্র। অত্যন্ত কাপুরুষোচিত পন্থায় তাঁকে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টার ভেতর দিয়ে আমরা দেখতে পাই তাঁদের আসল চেহারা। তারপরও এ দর্শনটিকে বাস্তবায়নের জন্য গোটা পৃথিবী উন্মূখ। লোমহর্ষক বীভৎস রূপটিকে জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামোর আড়ালে লুকিয়ে রাখার আপ্রাণ ভণিতায় হয়ত ক্ষণিকের জন্য আসল উদ্দেশ্যটি লকিয়ে ফেলা যায়। কিন্তু আমরা জানি, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ তিনি তাঁর স্বকীয় যোগ্যতাতেই আবার ফিরে আসবেন। এই সাময়িক ঘোর কেটে বাঙালী মানস হয়ে উঠবে সুস্থ ও পরিশুদ্ধ। পুরো বইটি উদ্ধৃতি দেয়ার মতো। সংকলিত লেকাগুলো আসলে বিভিন্ন সময়ের প্রতিনিধি। যদিও রচনা প্রকাশনার পত্রিকা নাম ও তারিখ উল্লেখ করা হয়নি। সেটি করা হলে পাঠকদের জন্য আরও সুবিধা হতো। এক্ষেত্রে নবীন পাঠক কিছুটা হলেও হুঁচোট খেতে পারেন। সবশেষে বলা যায়, বইটি চলমান সময়ের রাজনীতি, সমাজনীতি নিয়ে মধ্যবিত্ত মানসের রাগ, ক্ষোভ, হাহাকার, আশা ও আশাভঙ্গের বেদনা ইত্যাদির এক পূর্ণাঙ্গ দলিল। পুরো বইটি এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার মতো। সব মিলিয়ে রাজনীতি মনস্ক প্রজন্ম পাঠকের জন্য এটা একটা ভাল বই নিঃসন্দেহে।
×