ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

হাজীপুর দুর্গ

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

হাজীপুর দুর্গ

ভোরবেলা ঘুম ভেঙেই মনে হলো, আজ শুক্রবার। এই দিনটির জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। অনেক দিনের একটা শখ পূরণ হতে যাচ্ছে- আর কয়েক ঘণ্টা পরই। প্রকৃতি বাংলাদেশের, সুজন সেন গুপ্তর দলবলের সঙ্গে আমরা চললাম গন্তব্য হাজীগঞ্জ দুর্গ। হাজীগঞ্জ দুর্গ নারায়ণগঞ্জ শহরের হাজীগঞ্জ এলাকায় শীতলক্ষ্যার পশ্চিম তীরে অবস্থিত। ঢাকা থেকে হাজীগঞ্জ দুর্গে যেতে প্রায় ১ ঘণ্টা লেগে গিয়েছিল। হাজীগঞ্জ দুর্গ আবার খিজিরপুর দুর্গ নামেও পরিচিত। জলদুর্গের বৈশিষ্ট্যম-িত দুর্গটি শীতলক্ষ্যার সঙ্গে পুরাতন বুড়িগঙ্গার সঙ্গমস্থলে নির্মিত হয়। সম্ভবত মুঘল সুবেদার ইসলাম খান কর্তৃক ঢাকায় মুঘল রাজধানী স্থাপনের পরে নদীপথে মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে দুর্গটি নির্মিত হয়। নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক হাজীগঞ্জ কেল্লার স্থানটির সামনে দাঁড়াতেই বুকটা কেমন যেন ধক করে উঠল। অদ্ভুত সুন্দর বিশাল এক কেল্লা। একটু একটু শিহরণও জাগল ভেতরে এই ভেবে, এ বিশাল কেল্লাটি তৈরি করা হয়েছিল যুদ্ধের জন্য। ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে মুঘল শাসক ঈশা খাঁ মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের কবল থেকে এ জনপদকে রক্ষা করার জন্য শীতলক্ষ্যা-ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা নদীর মিলনস্থলে কেল্লাটি নির্মাণ করেন। এখানে দিনের পর দিন না জানি কত যুদ্ধ হয়েছে। কথা বলছিলাম হাজীগঞ্জ দুর্গ এলাকার সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তি নাসির উদ্দিনের সঙ্গে তিনি বললেন, ১৭০০ শতাব্দী বা তারও আগে নির্মিত এ দুর্গের সঠিক স্থপতির নাম তেমন পরিষ্কারভাবে কোথাও নেই। তবে ধারণা করা হয়, সম্ভবত সুবেদার ইসলাম খানের সঙ্গে সংঘর্ষকালীন ঈশা খাঁ এ দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর রাজধানী সোনারগাঁয়ের নিরাপত্তার জন্য মীর জুমলা অধিকাংশ সময় অবস্থান করতেন এ কেল্লায়। প্রায় দুই কিলোমিটার জায়গা নিয়ে বিস্তৃত এ দুর্গ। দুর্গের মাঝে পুরোটাই ফাঁকা মাঠ। ধারণা করা হয়, এখানে অবস্থান নেয়া-সৈন্যরা এ মাঠে তাঁবু খাটিয়ে থাকত। সেই সময়ে যেহেতু নদীপথই ছিল যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম তাই নদীপথের আক্রমণ রুখতে নদীর তীরবর্তী জায়গাতেই নির্মাণ করা হয় এ দুর্গটি। বর্তমানে মাঠটি বাচ্চাদের খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে। এদিকে প্রকৃতি বাংলাদেশ টিম এর স্বরূপ সেন গুপ্ত তার দলবল নিয়ে ক্রিকেট খেলা শুরু করে দিল আর এদিকে আমরা দুর্গের আশপাশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। এটি একটি ইট-সুরকির তৈরি ছোট চতুর্ভুজাকৃতি দুর্গ। দুর্গটি বেশ চওড়া দুর্গ-প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। দুর্গের প্রাচীরে রয়েছে বন্দুক বসিয়ে গুলি চালাবার ফোকর। দুর্গের উত্তর দেয়ালেই দুর্গের একমাত্র প্রবেশপথ ‘দুর্গ তোরণ’। কিছুটা উঁচু এই দুর্গে ঢুকতে হলে আপনাকে প্রবেশ তোরণের প্রায় ২০টি সিঁড়ি ডিঙ্গাতে হবে। আর তোরণ থেকে দুর্গ চত্বরের নামতে হবে ৪টি ধাপ। প্রাচীরের ভেতরে চারদিকে চলাচলের পথ রয়েছে প্রাচীর ঘেঁষেই। দুর্গের পূর্ব-দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় দুটি বুরুজ আছে। আরও একটি বুরুজ রয়েছে দক্ষিণ পাশে। তাছাড়া উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম কোনায় ছোট দুটি বুরুজ অংশ আছে, যেখানে একসঙ্গে কয়েকজন বন্দুক বসিয়ে গুলি চালাতে পারত। দুর্গের পূর্ব-দক্ষিণ কোনে রয়েছে একটি ওয়াচ টাওয়ার। টাওয়ারে ঢোকার জন্য ছিল ছোট্ট একটি পূর্বমুখী দরজা। ভেতরে ঠিক মাঝখানে একটি মোটা গোল পিলার, পিলারের সঙ্গে ছিল গোলাকার সিঁড়ি। আজ পিলারটি টিকে থাকলেও নিচের দিকের অনেকটুকু সিঁড়িই ভেঙ্গে গেছে। শুধু কি তাই! গোটা ওয়াচ টাওয়ারটি আজ বিলীন হওয়ার পথে। দুর্গে চত্বরের পশ্চিম দিকে আছে বেশ বড় একটি আমগাছ, আর পূর্বপাশে আছে বড় একটি লিচুগাছ। লিচুগাছটি বিচিত্রভাবে বেঁচে আছে তার অর্ধেক খয়ে যাওয়া দেহ নিয়ে। নাসির উদ্দিন আমাদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিলেন, আর বললেন, সময়ের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন লোক ব্যবহার করতেন এ দুর্গ নিরাপত্তার জন্য। আবার কখনও এখান থেকে পরিচালনা করেছেন যুদ্ধ। এক সময় ঢাকার নবাবরা এটিকে ঘিরে হাফেজ মঞ্জিল নামক একটি প্রাসাদ ও উদ্যান নির্মাণ করেছিলেন এমন জনশ্রুতিও আছে। সময়ের ব্যবধানে এক সময়ের রক্ত হিম করা নাম হাজীগঞ্জ দুর্গ। এখন এক নীরব নিস্তব্ধ পুরাকীর্তি। কেল্লার পথে খাসজমির ওপর পাটগুদামগুলো স্বাধীনতার পর থেকে অস্থায়ী লিজের কারণে সৌন্দর্য ক্ষুণœ হতে থাকে। যদিও মাঝে মাঝে চলে প্রশাসনের লোক দেখানো সংস্কার যা উল্লেখ করার মতো কিছুই নয়। আর এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিন পর ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে রূপকথার গল্প বলে প্রতীয়মান হবে। এরপর আমরা গেলাম বিবি মরিয়মের সমাধি ও মসজিদে। এটি হাজীগঞ্জ দুর্গ থেকে কিছুদূর এগুলেই পাওয়া যাবে। হাজীগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত বলে এ মসজিদটি হাজীগঞ্জ মসজিদ নামেও পরিচিত। ঐতিহাসিকদের মতে, শায়েস্তা খাঁ ১৬৬৪ থেকে ১৬৮৮ সালের মধ্যবর্তী একটি সময়ে এ মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদের কাছে তাঁর কন্যা বিবি মরিয়মের সমাধি রয়েছে বলেই মসজিদটির নাম বিবি মরিয়ম মসজিদ এবং এ নামেই এটি বেশি পরিচিত। মুঘল আমলের নিদর্শন পাওয়া যায় এ সমাধিতে। দুর্গটি বাংলাদেশ প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের অধীনে সংরক্ষিত। এখনও দুর্গটি চমৎকার স্থাপত্য নিয়ে মুঘলযুগের গৌরবের কথা বলছে। পথের ঠিকানা : ঢাকার যে কোন স্থান থেকে আপনাকে প্রথমে যেতে হবে, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী বা কমলাপুর। গুলিস্তান বা যাত্রাবাড়ী থেকে নারায়ণগঞ্জ যেতে পারবেন এসি বা ননএসি বাসে। ভাড়া পরবে ২৫ থেকে ৩৫ টাকার মধ্যে। আর কমলাপুর থেকে যাবেন ট্রেনে, ভাড়া ১০ টাকার বেশি নয়। কমবেশি ৪৫ মিনিটে পৌঁছে যাবেন ঢাকা থেকে ২২ কিলোমিটার দূরের নারায়ণগঞ্জে। নারায়ণগঞ্জ বাস বা ট্রেনস্টেশান থেকে ১৫ থেকে ১৮ টাকায় রিকশাভাড়া নেবে হাজীগঞ্জ কেল্লাতে। মোবাইল : ০১৭১৭-৬৭৪৩১০, [email protected]
×