ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলার সেই গ্রামীণমেলা

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

বাংলার সেই গ্রামীণমেলা

তৎকালীন পূর্ব বাংলার মহকুমা শহরগুলোয় মেলা বসত ২৯ আর ৩০ চৈত্র। সেই চৈত্র দিনের অলস বেলায় ঘুঘু, শ্যামা, ময়ূর, কোকিল, গাঙচিল, বউকথা কও’র ডাক শুনে শুনে নির্জন পথ হয়ে মেলায় যাওয়ার স্মৃতি হয়ত আজও অনেকের মনে থাকার কথা। মেলায় মাটির পুতুল, বাঘ, সিংহ, হরিণ, বানর, হাঁড়িপাতিলসহ নানা রংবেরঙের সামগ্রী মিলত। ৫০ বছর আগে বাবা-মায়ের দেয়া একটি আধুলি নিয়ে দু’হাত ভরে খেলনা সামগ্রী নিয়ে তখনকার কিশোর-কিশোরীরা ঘরে ফিরত। সঙ্গে দেলবাহার। আজ তাতো দেখি না। আজও চৈত্রসংক্রান্তিতে মেলা বসে, বৈশাখীমেলা সবই আছে। তবে গ্রামীণ ছোঁয়া কোথায়? সেই ঐতিহ্য যেন সর্বত্র কৃত্রিমতায় ছেঁয়ে গেছে বা বিলুপ্তির পথে। শুধু কি তাই! এক সময় এই বাংলাদেশে বারো মাস মেলা পার্বণে মুখরিত ছিল। মানুষের কর্মব্যস্ততা, বৈশাখের ১ তারিখ নববর্ষ ও হালখাতা এ দিনেই সারাদেশে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। যা নববর্ষের মেলা নামে এখন পর্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে আছে। প্রতিবছর মাঘের শেষ বুধবার ফাল্গুনের প্রথম বুধবার বগুড়া জেলার গাবতলীর মহিষবাথান এলাকায় পোড়াদহের মেলা বসে। সন্ন্যাস পূজা উপলক্ষে মেলাটি হতো বলে এক সময় এর নাম ছিল ‘সন্ন্যাস মেলা’। এখন এর নাম পোড়াদহের মেলা। এই মেলায় বড় বড় মাছ ওঠে। মাছের বড় ক্রেতা হলো শ্বশুরবাড়িতে আসা জামাইরা। এরা পছন্দসই মাছ কিনে নিয়ে যায় শ্বশুরবাড়ি। বগুড়ার এ অঞ্চলের মানুষের কাছে এ মেলাটির গুরুত্ব অনেক বেশি। পাবনার বড়াল নদীর তীরে বোঁথড় গ্রামে চৈত্রসংক্রান্তিতে চড়কের মেলা অনুষ্ঠিত হয়। তবে গ্রামের নামানুসারে এ মেলাকে বলা হয় বোঁথড়ের চড়ক মেলা। চড়ক গাছকে কেন্দ্র করে হয় এই মেলা। ৩০ বা ৩১ চৈত্রে শুরু হয়ে চলে তিন দিন। রাত যত গভীর হয় মেলা ততই জমে ওঠে। এই মেলায় শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে বিদ্ধ করা হয় লোহার শলাকা। কখনওবা জ্বলন্ত লোহার শলাকা ছুড়ে দেয়া হয় গায়ে। এখানে চড়কে যাকে ঝোলানো হয় তাকে বলা হয় সন্ন্যাসী। এই সন্ন্যাসীকে লোহার ছক দিয়ে চাকার সঙ্গে বেঁধে ঘোরানো হয় একটি উঁচু চড়ক গাছে। চড়ক মেলার অ্যনতম আকর্ষণ এটিই। এ ছাড়াও বোঁথড়ের চড়ক মেলায় বায়োস্কোপ, সার্কাস, নাগরদোলা, জাদু, পুতুলনাচ ইত্যাদিও থাকে। উল্লেখযোগ্য মেলার মধ্যে রয়েছে মাইজভা-ারীর মেলা। এ মেলা প্রতিবছর ১০ মাঘ চট্টগ্রামের মাইজভা-ার গ্রামে অনুষ্ঠিত হয়। চৈত্র মাসের অমাবস্যার আগে ত্রয়োদশ তিথিতে গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দিতে অনুষ্ঠিত হয় মতুয়া মেলা। একে ওড়াকান্দি মেলাও বলা হয়। এই মেলায় শঙ্খধ্বনির তালে তালে ভক্তরা-‘হরিবোল হরিবোল’ গেয়ে চলে। মেলায় কুটির শিল্প, হস্ত শিল্পজাত পণ্যের পাশাপাশি পাওয়া যায় ঘরের জিনিসপত্র। মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র এই তিন মাসে অধিকাংশ জায়গায় মেলা হয়। মাঘ মাসে রাজশাহীর বারুনীর মেলা, ললিতনগরের মেলা, ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈলের কাতিহার মেলা, যশোরের সাগরদাঁড়ির মধুমেলা, বিক্রমপুরের রামপালের মেলা, বগুড়ার কেলুয়ার জগদীশ গোসাই মেলা, ফরিদপুরের তাড়াইলের মাঘী পূর্ণিমার মেলা, বরিশালের সূর্যমনির মেলা, কালীতলার মেলা, পঞ্চগড়ের আটোয়ারীর নিরাশীর মেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের সাতমোড়ার মেলা প্রভৃতিও কম উল্লেখযোগ্য নয়। ফাল্গুন মাসের উল্লেখযোগ্য মেলা শরীয়তপুর জেলার নড়িয়ার সুরেশ্বর মেলা, দিনাজপুরের গোরখাই মেলা, বগুড়ার ধুনটের বকচরের মেলা, নরসিংদীর মনোহরদীর শাহ্রানীর মেলা, হবিগঞ্জের বোলেশ্বরী প্রভৃতি। এসব মেলা যুগ-যুগান্তর ধরে রূপসী বাংলায় টিকে থাকুক- এই প্রত্যাশা। লিয়াকত হোসেন খোকন রূপনগর, ঢাকা
×