ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যাডমিন্টনে রৌপ্য জেতার আনন্দে বললেন হায়দরাবাদকন্যা সিন্ধু

‘প্রত্যাশার চেয়েও বেশি পেয়েছি’

প্রকাশিত: ০৭:০৪, ২১ আগস্ট ২০১৬

‘প্রত্যাশার চেয়েও বেশি পেয়েছি’

ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে পড়ল সবুজ কোর্টে। নেটের উল্টো দিকে তার প্রতিদ্বন্দ্বীও তখন সোনার পদক জয়ের উল্লাসে চিৎকার করতে করতে শুয়ে পড়েছেন। চোখে তার আনন্দের জল। তবু রিও সেন্ট্রোর ফ্লাড লাইটের আলোয় দারুণ উজ্জ্বল লাগছিল হলুদ পোশাকের মেয়েটাকে। চোখটা ছলছল করছিল হায়দরাবাদের নতুন মহাতারকার। কেন কাঁদছেন তিনি। সোনার মেডেল গলায় ঝুলাতে পারেননি তাই? হ্যাঁ সেটাই। কিন্তু হৃদয় তো জিতেছে। চেষ্টার পরিশ্রমে নাছোড় লড়াই। ১৩০ কোটি মানুষের দেশের স্বপ্নের ভার কাঁধে নিয়ে রিওতে এঁকেছেন অভূতপর্ব এক রুপালি রেখা। তিনিই তো ভারতের প্রথম মেয়ে যিনি রৌপ্য আনলেন অলিম্পিক গেমসের আসর থেকে। গোটা স্টেডিয়াম উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানাচ্ছে তাকে হাতাতালি দিয়ে। বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বর খেলোয়াড় স্পেনের ক্যারোলিনা মারিনের বিরুদ্ধে পুসারলা ভেঙ্কট সিন্ধুর চোখ ধাঁধানো যুদ্ধের সাক্ষী থাকতে পেরে সবাই আপ্লুত। সিন্ধুর পদক দেখতে গ্যালারিতে শতাধিক ভারতীয় ক্রীড়াবিদ, সমর্থন। সবাই ছুটে এসেছিলেন। সিন্ধু একেকটা পয়েন্ট জেতার পর তারাই মেক্সিকান ওয়েভ তুললেন গ্যালারিতে। হৃদয় দাগকাটা এক দৃশ্য। আমি তৃপ্ত, রিও অলিম্পিকে আসার আগে এ উচ্চতায় পোঁছব ভাবিনি। আমি যে লক্ষ্য নিয়ে প্রথম অলিম্পিকে খেলতে এসেছি তার চেয়ে বেশি পেয়েছি। একটা পদক নিয়ে যাচ্ছি দেশে। এমন সাফল্য যা ব্যাডমিন্টনে ভারতের কেউ পাননি, মিডিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে বলছিলেন সিন্ধু। কোর্টে যে দুঃখ ঝরে পড়েছিল কয়েক মিনিটের জন্য অনেকটা উধাও। গলায় রুপার পদক ঝুলানো মেয়েটা এখন যেন অন্য গ্রহের মানুষ। কান্না ভুলে হাসলেন তিনি। মুখে বিষাদ-মেঘের লেশমাত্র নেই। দু’বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ক্যারোলিনার সঙ্গে তার লড়াইকে কেউ কেউ বলছিলেন ‘একতরফা’। সেটাই জমিয়ে দিলেন সিন্ধু। প্রথম গেমটায় পিছিয়ে থাকতে একেবারে শেষ পর্বে এসে ১৯-১৯ থেকে ২১-১৯-এ জিতে গেলেন। পরের গেমটায় অবশ্য বাঁ হাতি ক্যারোলিনা প্রায় দাঁড়তেই দেননি সিন্ধুকে। স্পেনের তারকা জিতলেন ২১-১২ পয়েন্টে। কিন্তু চূড়ান্ত গেমে সিন্ধু আবার অন্য চেহারায়। মাথা ঠা-া রেখে শরীরের মধ্যে কিভাবে বারুদ জ্বলাতে হয় সেটা তো একাডেমিতে শিখেই এসেছিলেন ভারতীয় তারকা। তৃতীয় গেমে ক্যারোলিনার সঙ্গে সিন্ধু ১৫-২১ পয়েন্টে হারলেন, সেটা নিছক পরিসংখ্যান। অঙ্ক বলবে না চূড়ান্ত গেমেও পিছিয়ে পড়তে কিভাবে বারবার ম্যাচে ফিরে এলেন সিন্ধু। আসলে মেয়েদের এককের ৮৩ মিনিটের ফাইনাল এত উপভোগ্য হলো যে আবেগ ধরে রাখাই কঠিন হয়ে পড়ছিল দর্শকদের। অসাধারণ লড়াই। শুরু থেকেই কোর্ট ময়লা হয়েছে, পা পিছলে যাচ্ছে- নানা অজুহাতে রেফারির ওপর চাপ সৃষ্টি করছিলেন ক্যারোলিনা, যা দেখে সিন্ধুও পাল্টা চাপ তৈরি করতে থাকেন। তৃতীয় সেটে ১০-১০ হওয়ার পর সেটা এমন পর্যায়ে গেল যে, আম্পায়ার অন্তত তিনবার দু’জনকে সতর্ক করলেন। সিন্ধু পরে বলছিলেন ওটা আমাদের খেলায় হয়। ট্যাকটিক্সের অঙ্গ বলতে পারেন। ঠিক তখনই চোখের সামনে ভেসে উঠল আরও একটা ছবি। ম্যাচ শেষে কোর্টে কাঁদছিলেন ক্যারোলিনা। সিন্ধু ততক্ষণে একটু ধাতস্ত হয়েছেন। পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে ক্যারোলিনার কাঁধে হাত রাখলেন তিনি। জানিয়ে দিলেন স্বর্ণপদক জেতার শুভেচ্ছা। পরক্ষণেই যেন পরম মমতায় সিন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন ক্যারোলিনা। হায়দরাবাদকন্য হৃদয় জয় করেছেন সোনার পদক গলায় ঝুলাতে না পারলেও। অসাধারণ এ মুহূর্তটা শুধু নিজের দেশের নয়, সারাবিশ্বের কাছে পাকাপাকি জায়গা করে নিলেন সিন্ধু, অসাধারণ খেলোয়াড়িত আচরণে। প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিয়েও শ্রদ্ধাশীল আচরণ। ক্যারোলিনা যোগ্য হিসেবেই জিতেছে, বললেন সিন্ধু। ফাইনালে তো কেউ হারে কেউ জেতে। আমি আজ হেরেছি। সেমিফাইনালে যখন উঠেছিলাম তখন ভেবেছিলাম ব্রোঞ্জের জন্য লড়তে নামছি। আজ যখন নামলাম তখন সোনার পদকটাই জিততে চেয়েছিলাম। হয়নি-তাতে কী? ঠিক আছে। কোন দুঃখ নেই। স্যারকে (কোচ গোপীচন্দ্র) সবার আগে কৃতিত্ব দিতে চাই। জানাচ্ছি কৃতজ্ঞতা। সত্যিই অলিম্পিক হচ্ছে বিশ্ব ক্রীড়ার সেরা ‘শো’। যেখানে সবার বেলায় ‘এলাম দেখলাম, জয় করলাম’ কথাটা চলে না। ম্যাচ শেষে কোচ গোপীচন্দ্র তার ছাত্রীকে বললেন, ভেব না তুমি হেরেছ। তুমিই তো আমাদের গর্ব!
×