ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান

বঙ্গবন্ধু এক ‘ঐশ্বরিক আগুন’

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ১২ আগস্ট ২০১৬

বঙ্গবন্ধু এক ‘ঐশ্বরিক আগুন’

এমন কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা নিজের আলোয় আলোকিত করেন পৃথিবীকে, যাঁদের কথায় উদ্দীপ্ত ও অনুপ্রাণিত হয় আপামর মানুষ, যাঁদের মানবিক জ্যোৎ¯œা ¯িœগ্ধতা ছড়িয়ে দেয় মন ও মননভূমিতেÑতাঁরা নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সূর্যসন্তান, কীর্তিমান মানুষ। এমন সূর্যসন্তানকে ধারণ করে, তাঁদের কর্মযজ্ঞে হৃদ্ধ হয়ে ধূলির পৃথিবী হাজার হাজার বছর ধরে হয়ে উঠেছে শ্যামল-সুন্দর, রতœগর্ভা। এই বিরলপ্রাণরা পথের দিশা দিয়েছেন পথ ভোলাদের, কখনও শান্তি ও প্রগতির চাকা ঘুরিয়েছেন একনিষ্ঠ শ্রম ও ঘামে, আবার কখনও তাঁদের নেতৃত্বে শৃঙ্খল ঘুচেছে পরাধীন জাতির। তবে আলোচ্য নিবন্ধে আমরা সচেতনভাবেই পরাধীন বাঙালী জাতির স্বাধীনতা অর্জনের দিকে আমাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করব, যেই দৃষ্টির প্রথম থেকে অন্তিম পর্যন্ত জুড়ে আছেন শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর প্রতি তৎকালীন বিশ্ব নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি। বাঙালী জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাঙালীর মুক্তির দূত, দুর্দিনের কা-ারি। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার একবার বলেছিলেন, ‘এ জগতে কেউ কেউ জন্মগতভাবে মহান, কেউ মহত্বের লক্ষণ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন, আবার কেউ স্বীয় প্রচেষ্টায় মহানুভবতা অর্জন করেন।’ কথাটি বঙ্গবন্ধুর জীবনের সঙ্গেও মিলে যায়। শৈশব থেকেই শেখ মুজিব সচেতন ও সমগ্রতার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন। তিনি জন্ম থেকেই যেন ঐশ্বরিকভাবে নেতৃত্বের ও মানবতার গুণাবলী পেয়ে এসেছেন। তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম বলেছেন, শেখ মুজিব ছিলেন ‘ঐশ্বরিক আগুন’। তিনি তাঁর নেতৃত্বে এ দেশের মানুষকে সেই মুক্তির পথ দেখিয়েছেন, যে পথ পূর্বে আর কেউ দেখাতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ, আজন্ম লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন তাঁকে ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠানে, দেশ থেকে বিশ্বে, কাল থেকে মহাকালের শাশ্বত পথের দিকে ধাবিত করেছে। অন্যায়কে প্রতিরোধ, অবিচারকে প্রতিহত, শৃঙ্খলকে বন্ধনহীন করার মধ্য দিয়ে তাঁর ঐশ্বরিক আগুন জ্বলে উঠেছে বারংবার। যার ফলশ্রুতিতে বাঙালী জাতি পেয়েছে তাদের বহুল প্রতীক্ষিত নেতাকে, স্বাধীনতাকে। কবি শামসুর রাহমান শেখ মুজিবকে কাছ থেকে দেখেছেন। ১৯৪৯ সালের মার্চে শেখ মুজিবসহ ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনে নামে। শামসুর রাহমানও সেই দলে ছিলেন। তাঁর জবানীতে সেদিনের স্মৃতিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ছাত্রনেতা মুজিবের নেতৃত্বগুণ। শামসুর রাহমান লিখেছেন : ‘শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আমরা কিছু সংখ্যক সাধারণ ছাত্র তখন ভাইস চ্যান্সেলরের বাসভবন ঘেরাও করেছিলাম।...মনে পড়ে, সেদিন দশাসই ঘোড়সওয়ার পুলিশের তাড়া খেয়েছিলাম। একটি বলবান অশ্বের খুরের ঠোকন আর পুলিশের ব্যাটের বাড়ি খেতে খেতে বেঁচে যাই কোনমতে। দীর্ঘকায় কান্তিমান শেখ মুজিব তাঁর কথা এবং জ্বলজ্বলে দৃষ্টি দিয়ে আমাদের অনুপ্রাণিত করছিলেন, যোগাচ্ছিলেন সাহস। সেদিন ঘোড়ার পায়ের নিচে পড়ে থেঁতলে গেলেও হয়ত কোন খেদ থাকত না। প্রকৃত নেতার প্রেরণার শক্তি বোধহয় এ রকমই হয়।’ শুধু একটি নয়, এমন অসংখ্য ঘটনার মধ্য দিয়েই শেখ মুজিব ধাপে ধাপে উঠে এসেছেন বাঙালীর হৃদয়ে। অনেক প্রাজ্ঞজনই যুবক শেখ মুজিবকে দেখে বলেছিলেন, মুজিব নিশ্চয়ই একদিন বড় কিছু হবেন। তৎকালীন অনেক রাজনীতিবিদও মুজিবের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের স্ফূরণ ও সম্ভাবনার আলো দেখতে পেয়েছেন। স্বয়ং মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীও তাঁর ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন। তিনি তাঁকে পুত্রবৎ ¯েœহ করতেন। হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীও মনে করতেন শেখ মুজিব তার নামকে কাজ দ্বারা ছাড়িয়ে যাবেন। একবার সোহ্রাওয়ার্দী ঢাকা হাইকোর্টের বিখ্যাত আইনজীবী এসআর পালকে বলেছিলেন, ‘আমি ভবিষ্যদ্বাণী করছি, মুজিব একদিন ইতিহাস সৃষ্টি করবে।’ গণতন্ত্রের মানসপুত্রের এই ভবিষ্যদ্বাণী যে সত্য হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মুজিব সত্যি সত্যিই উজ্জ¦ল ইতিহাস গড়লেন। দেশ স্বাধীন করলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিকামী অসংখ্য বাঙালীর মতো অল্পসংখ্যক বিদেশী নাগরিক ছিলেন, যারা বিশ্বাস করতেন বাঙালীদের আর কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। এই বিশ্বাসীদের দলে এ্যালেন্স গিনসবার্গদের মতো ছিলেন আমেরিকান মিশনারি জেনিন লকারবি। তিনি তাঁর ‘অনডিউটি ইন বাংলাদেশ’ গ্রন্থে শেখ মুজিবকে মূল্যায়ন করেছেন এভাবে : ‘এমন একজন মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে যে অনগ্রসর বাঙালী জাতিকে মুক্তির আস্বাদ দিবে। তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান।’ বিশেষত ১৯৭১ সাল পরবর্তীতে শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন বিশ্ব নেতাদের চোখে বিস্ময়, ঘোরলাগা এক ব্যক্তিত্ব। তৎকালীন বিশ্ব মিডিয়াগুলোও বঙ্গবন্ধুকে যথার্থভাবে মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২ মে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলা হয়েছিল : ‘সাধারণ বাঙালীর কাছে তাঁর কাপড় স্পর্শ করা ছিল তাবিজে শুভ ফল পাওয়ার মতো। তাঁর বাক্যই হয়ে উঠেছিল আইন। ধানম-িতে তাঁর বাসা থেকে তিনি সব করছিলেন। সবার সঙ্গেই ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, তাঁর কাছে যাওয়ায় কোন বাধা ছিল না। ... সম্পদ বা পদমর্যাদার দিকে তাঁর কোন নজর ছিল না, সম্পূর্ণভাবে আন্তরিক ছিলেন জনগণের প্রতি।...প্রতিদানে বাঙালীরাও তাঁকে বিশ্বাস করতেন; তাঁর সততা, আত্মত্যাগ, সাহস ও তাদের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার বিষয়টিও তারা (জনগণ) বিশ্বাস করতেন।’ শেখ মুজিবুর রহমান যে বাগ্মী মানুষ ছিলেন, তা কেবল এদেশের মানুষই নয়, বিশ্বের বাঘা বাঘা মানুষও তাঁর বাগ্মিতা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। মুজিবের বাগ্মিতা এ জন্য নিরেট যে, কারণ তিনি কখনও কোন বক্তব্যে মানুষকে মিথ্যা আশ্বাস দেননি। তিনি যা বিশ্বাস করতেন তাই বলতেন। যা বলতেন তা অন্তর থেকেই উচ্চারণ করতেন। বঙ্গবন্ধু ‘একজন মৌলিক চিন্তাবিদ বলে ভান করেন না, তিনি একজন রাজনীতির কবি, ইঞ্জিনিয়ার নন; কিন্তু বাঙালী কারিগরিবিদ্যা বিশারদের পরিবর্তে শিল্পীমনের অধিকারী বলে পরিচিত।’ তাই তাঁর কথার প্রভাব সহজেই ঐন্দ্রজালিক মায়ায় ছড়িয়ে পড়ত শ্রোতাদের মনের গভীরে। ফলে তারা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতেন বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা। তাঁর বলার দৃপ্ত ভঙ্গি, দৃঢ় অঙ্গীকার বাঙালীদের তৃপ্ত করতে পেরেছিল। তাঁর বাগ্মিতা সম্পর্কে বিশিষ্ট সাংবাদিক, নিউজ উইক সাময়িকীর সম্পাদক লোরেন জেনিকন্স লিখেছিলেন, ‘...একরাশ কাঁচাপাকা চুল, ঝোপসদৃশ গোঁফ এবং সতর্ক কালো চোখের অধিকারী মুজিব দশ লাখ শ্রোতার সমাবেশে আবেগপূর্ণ বাগ্মিতার উত্তাল ঢেউয়ের মাধ্যমে তাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে সক্ষম।’ লোরেন জেনিকন্স যে ‘আবেগপূর্ণ বাগ্মিতার’ কথা বলেছেন, তা যে কেবলমাত্র শেখ মুজিব মুগ্ধরাই জানতেন, উপলব্ধি করতেন তা নয়। বরং শেখ মুজিব বিরোধীরাও তাঁর চরিত্র সম্পর্কে, বাগ্মিতা ও বিশ্বাস সম্পর্কে সচেতনভাবেই অবগত ছিলেন। তৎকালীন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান সরকারকে সমর্থন দিয়ে আসছিল। তাই স্বভাবতই শেখ মুজিব ছিলেন তাদের অপছন্দের ব্যক্তি। কেননা, ‘সঙ্কীর্ণ’ পাকিস্তান সরকারের চলার পথের অন্তরায় ছিলেন ব্যপৃত হৃদয়ধারী বঙ্গবন্ধু। এত কিছু সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র তাঁর গুণগুলোর প্রশংসা না করে পারে নি। ১৯৭০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকায় নিযুক্ত কনসাল জেনারেল আর্থার কে ব্লাড পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পাঠানো এক গোপন নথিতে লিখেছিলেন : ‘মুজিব সারাজীবনই একজন রাজনীতিবিদ। ১৯৪৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১০ বছর তিনি কাটিয়েছেন পাকিস্তানি জেলে, যার চূড়ান্ত পরিচয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা... মানুষ মুজিবকে ছাঁচে ফেলা কঠিন। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তিনি আত্মবিশ্বাসী, শান্ত, চমৎকার। বেশ ঘুরেছেন তিনি এবং শাহরিক। মঞ্চে তিনি জ্বালাময়ী বক্তা। মুষলধারায় বৃষ্টির মধ্যেও তাঁর বক্তৃতা সাধারণকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পারে। দলীয় নেতা হিসেবে কঠিন এবং কর্তৃত্বপরায়ণ, অনেকসময় একগুঁয়ে। বাঙালীদের অভিযোগের কথা বলতে গেলে তিনি হয়ে পড়েন স্বতঃস্ফূর্ত এবং আবেগপ্রবণ।’ সুহৃদ হিসেবে প্রায় কাছাকাছি কথা বলেছেন ইয়াসির আরাফাতÑ‘আপোসহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুম হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।’ মূলত মুজিব চরিত্রে আবেগ, বাগ্মিতা, সাহসিকতা ও ত্যাগের অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছে। যার ফলে তিনি পরিণত হয়েছেন মহানায়কে। মানুষের ভালবাসায় সিক্ত এই নেতা সব সময়ই জনগণকে আপন ভেবেছেন। তাদের কষ্টকে নিজের কষ্ট হিসেবে দেখেছেন। অন্যায় ও অপশাসনের বিরুদ্ধে তাঁর কণ্ঠ এতই সুউচ্চ ছিল যে, মৃত্যুভয়ও তাঁকে কুণ্ঠিত করতে পারেনি। জেল-জুলুম-নিপীড়নের মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবকে দমাতে চেয়েছে। কিন্তু বাংলার মেহনতী মানুষের সম্মিলিত কণ্ঠধারকের স্বর থেমে যায়নি। বরং বিরুদ্ধ স্র্রোতেও তিনি পথ চলেছেন অবিরাম, স্বপ্ন দেখেছেন সোনার বাংলার। তাঁর এবং সাত কোটি মানুষের স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল একাত্তরের যুদ্ধ জয়ের মধ্য দিয়ে। এ কারণেই তিনি মহৎ ও মহান। শ্রীলঙ্কার এক সময়কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী লক্ষ্মণ কাদির গামা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেছেন, ‘শেখ মুজিব বুদ্ধিজীবী ও শ্রমজীবী উভয় শ্রেণীর মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পেরেছিলেন। বাংলার মানুষ তাদের ইতিহাসে শেখ মুজিবুর রহমানের চেয়ে জ্ঞানী-গুণী, শিক্ষিত, বাগ্মী বা প্রাণবন্ত নেতার সাক্ষাত পেলেও তার মতো সফল নেতা কেউ ছিলেন না। তিনি বাঙালী জাতির স্বপ্ন পূরণ করেছেন, তাদের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র উপহার দিয়েছেন।’ ‘দক্ষিণ এশিয়া গত কয়েক শতকে বিশ্বকে অনেক শিক্ষক, দার্শনিক, দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক, রাজনৈতিক নেতা ও যোদ্ধা উপহার দিয়েছে। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান সবকিছুকে ছাপিয়ে যান, তাঁর স্থান নির্ধারিত হয়ে আছে সর্বকালের সর্বোচ্চ আসনে।’ তাই বিখ্যাত সাময়িকী নিউজ উইক তাঁকে আখ্যায়িত করেছিল ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ হিসেবে। লেলিন, ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মতো বঙ্গবন্ধুও সফল নেতা ছিলেন। সংগ্রামের দিক দিয়ে তিনি তাঁদের মতোই সফল। ফিদেল ক্যাস্ট্রোর কাছে শেখ মুজিব ছিলেন বিশেষ এক নাম। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তি ও সাহসে এ মানুষটি হিমালয়ের সমতুল্য।’ মানবতাবাদী মনীষী লর্ড ফেনার ব্রকওয়ে শেখ মুজিবকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দেখেছেন। তিনি বলেছেন, ‘জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধী, ডি ভ্যালেরার চেয়েও শেখ মুজিব এক অর্থে বড় নেতা।’ শেখ মুজিবের সাহসিকতার ও ব্যক্তিত্ব কেবল দক্ষিণ এশিয়াতে নয়, সারা বিশ্বেই বিরল। মুজিব এমন ব্যক্তিত্ব ছিলেন তাঁর প্রশংসা পাকিস্তানী সেনারা পর্যন্ত করেছিল। ’৭১-এর পাকযোদ্ধা মেজর জেনারেল তোজাম্মেল হোসেন মালিক যুদ্ধপরবর্তী তাঁর স্মৃতি কথায় লিখেছেন, ‘বস্তুত শেখ মুজিব দেশদ্রোহী ছিলেন না। নিজ জনগণের জন্য তিনি ছিলেন এক মহান দেশপ্রেমিক।’ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে সেসব সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন তার মধ্যে মিসরের হাসনাইন হাইকেল অন্যতম। তিনি তাঁর মূল্যায়নে বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরেছেন এভাবে : ‘নাসের কেবল মিসরের নন, সারা বাঙালী জাতির মুক্তির দূত। তাঁর জাতীয়তাবাদ আরব জনগণের শ্রেষ্ঠ মুক্তিপ্রেরণা। তেমনি শেখ মুজিবুর রহমান শুধু বাংলাদেশের নন, সারা বাঙালী জাতির মুক্তিদূত। তাঁর বাঙালী জাতীয়তাবাদ বাঙালীর সভ্যতা ও সংস্কৃতির নব অভ্যুদয়মন্ত্র। মুজিব বাঙালীর অতীত ও বর্তমানের শ্রেষ্ঠ মহানায়ক।’ বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের পর বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনের কাজে হাত দেন। তাঁর প্রচেষ্টায় স্বল্প সময়েই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। তিনি দেশ গঠনের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে মনোযোগী হন। সে সময়ে বিশ্বের অধিকাংশ প্রভাবশালী নেতাই বঙ্গবন্ধুকে সম্মান করতেন। বঙ্গবন্ধু যখনই কোন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গিয়েছেন তখনই বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্ব নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। ১৯৭৩ সালের আগস্টে কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন শেখ মুজিবুর রহমান। সেই সময়ে তাঁর সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশী কূটনৈতিক ফারুক চৌধুরী। সেই সম্মেলনে বিশ্বনেতা বঙ্গবন্ধুকে কীভাবে গ্রহণ করেছেন তাঁর বর্ণনা ফারুক চৌধুরী ‘আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধু’ নিবন্ধে পাওয়া যায়। তাঁর ভাষ্যে : ‘অটোয়াতে প্রথমবারের মতো অনেক রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় হয়। অস্ট্রেলিয়ার হুইটলাম, জ্যামাইকার মাইকেল ম্যানলি, মালয়েশিয়ার টুন রাজ্জাক, মরিশাসের শিবসাগর রাম গোলাপ, সিঙ্গাপুরের লি কোয়ান ইউ, নিউজিল্যান্ডের নরম্যান কার্ক, শ্রীলঙ্কার শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে সহ-আন্তর্জাতিক অঙ্গনের জাঁদরেল সব ব্যক্তিত্ব। প্রথম পরিচয়েই মনে হতো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যেন তাঁদের পরিচয় অনেকদিনের। বঙ্গবন্ধুর ব্যবহারের উষ্ণতা ও অমায়িকতা তাদের সবার মনকে ছুঁয়ে যেতে দেখেছি।’ ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু যখন ওআইসি সম্মেলনে যোগ দেন, তখন তাঁর সফর সঙ্গী ছিলেন তোফায়েল আহমেদ। কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনের মতোই বিশ্ব নেতারা ওআইসি সম্মেলনেও বঙ্গবন্ধুকে বিশেষ সম্মান করেন। তোফায়েল আহমেদের লেখনী : ‘বক্তা হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পরিষদের সভাপতি স্বীয় আসন থেকে উঠে এসে বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চে তুলে নিয়েছিলেন। পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর প্রায় ৪৫ মিনিট বক্তৃতার শেষে সভাপতি নিজেই যখন দাঁড়িয়ে করতালি দিচ্ছেন, তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক ও প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বিপুলভাবে করতালি দিয়ে আলিঙ্গন করে অভিনন্দিত করেছেন বঙ্গবন্ধুকে। অভাবনীয় সেই দৃশ্য। নিজ চোখে না দেখলে লিখে বোঝানো সম্ভবপর নয়। বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্ব নেতাদের ছিল গভীর শ্রদ্ধা। আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিমালয়সম উচ্চতায় আসীন ছিলেন তিনি। আমার মনে পড়লে, অধিবেশনে আগত বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা আমাদের কাছে এসে বলেছিলেন, ‘সত্যিই তোমরা গর্বিত জাতি। তোমরা এমন এক নেতার জন্ম দিয়েছ, যিনি শুধু বাংলাদেশের নেতা নন, এশিয়ার নেতা নন; তিনি সমগ্র বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা।’ এই যে বঙ্গবন্ধুকে এভাবে দেখা এবং তাঁকে সম্মান করাÑ তা ছিল বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক ব্যাপার। যার জন্য বাংলাদেশ পরবর্তীতে অনেক রাষ্ট্রের কাছ থেকেই বন্ধুত্বসুলভ আচরণ ও সহযোগিতা লাভ করেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী দেশ গঠনের কাজে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে উল্লেখযোগ্য সহযোগিতা করেছেন। ১৯৭২ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এক ভাষণে বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জনগণের নিকট স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং তিনি তাঁদের তা এনে দিয়েছেন।’ ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বকে এতই সম্মান করতেন যে, তিনি বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন। বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধীর কথোপকথনটি এ প্রসঙ্গে উদ্ধৃতি করা গেল : ‘ইন্দিরা গান্ধী : এক্সেলেন্সি, আমার সিদ্ধান্ত হচ্ছে আগামী ১৭ মার্চ বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে। শেখ মুজিব : মাদাম, কেন এই বিশেষ দিন ১৭ মার্চের কথা বললেন? ইন্দিরা গান্ধী : এক্সেলেন্সি, প্রাইমমিনিস্টার, ১৭ মার্চ হচ্ছে আপনার জন্মদিন!’ প্রতিশ্রুতিস্বরূপ ১৯৭৩ সালের ১৭ মার্চই ভারত বাংলাদেশ থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন শুরু করে। সেদিন ইন্দিরা গান্ধী সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে বক্তব্যকালে বলেন, ‘আজকের দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ও সুখের দিন বটে। কারণ আজ শেখ মুজিবের জন্মদিন। তিনি হলেন এদেশের মুক্তিদাতা।... শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের বন্ধু।’ ভারতের অনেক নেতাই বঙ্গবন্ধু ‘অহিংস গান্ধীবাদী’ নেতা হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। আবার শুধু ইন্দিরা গান্ধী নন, বিশ্বের অনেক বরেণ্য ব্যক্তিই শেখ মুজিবকে ‘বিশ্ববন্ধু’ হিসেবে অবিহিত করেছেন। ১৯৭৩ সালে ‘জুলিও কুরি শান্তি পদক’ পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এ প্রদক বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দিয়েছিলেন বিশ্ব শান্তি পরিষদের মহাসচিব রমেশচন্দ্র। তিনি তাঁর বক্তব্যের একপর্যায়ে সেদিন বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে।’ ফ্রান্সের বিখ্যাত সাহিত্যিক আঁদ্রে মালরো স্বাধীনতার প্রশ্নে বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, তিনি মুক্তিবাহিনীর অধীনে একটি দল পরিচালনা করতে চান। এমনকি তিনি একটি দেশের রাষ্ট্র প্রধানকেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠিতে তিনি রাষ্ট্রপ্রধানকে প্রশ্ন করেছিলেনÑ ‘পৃথিবীর সবচেয়ে পরাক্রমশালী সেনাবাহিনীকে যদি নগ্নপদ ভিয়েতনামীদের হাতে নাজেহাল হতে হয়, তাহলে কি আপনি বিশ্বাস করেন যে ইসলামাবাদের সেনাবাহিনী বারো শ’ মাইল দূর থেকে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় উদ্দীপ্ত একটি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামকে পরাভূত করতে সক্ষম হবে?’ বাংলাদেশের পক্ষে তিনি বিশ্বদরবারে স্পষ্টভাবে কথা বলেছিলেন। ১৯৭৩ সালে আঁদ্রে মালরোকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডক্টরের প্রদান করে। সেসময়ে তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘স্টালিন নয়, হিটলার নয়, মাও সেতুং নয়Ñ গান্ধী ও শেখ মুজিবুর রহমান! যদি জগত এখনও না বুঝে থাকে এঁদের মতের মর্মবাণী, তবে সময় এসেছে এ বিষয়ে দৃষ্টি উন্মোচনের।’ ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর আস্তে আস্তে এমন পরিস্থিতি দাঁড়ায় যে, শেখ মুজিবের নাম উচ্চারণ করাও প্রায় ‘নিষিদ্ধ’ হয়ে যায় যেন। কিন্তু একথা সত্য, জীবিত শেখ মুজিব ও মৃত শেখ মুজিবÑউভয়েই সমান শক্তিশালি। শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারলেও তাঁর আদর্শকে হত্যা করতে পারেনি ঘাতকরা। কারণ আদর্শকে হত্যা করা যায় না। আদর্শই বাঁচিয়ে রাখে ব্যক্তিকে। তাই তৎকালীন সময়ে যতই বঙ্গবন্ধুর নাম ও কর্মকে ছাইচাপা দেয়ার চেষ্টা চলছিলো তা সফল হয়নি। কারণ বঙ্গবন্ধু মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন। আমরা সেই ‘নষ্ট সময়ে’ও দেখি কারও তোয়াক্কা না করে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক নিঃসঙ্কোচে এক বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘এই উপমহাদেশের সমগ্র অঞ্চল বা কোন্ কোন্ বিশেষ অংশের সঙ্গে ধর্ম বা সমাজের শ্রেণীগত কাঠামোর দিক দিয়ে আমাদের অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। কিন্তু স্বতন্ত্র পরিচয় রাখার ক্ষেত্রে আমাদের অদম্য ইচ্ছাই এ সবকিছুকে অতিক্রম করেছে। এই আকাক্সক্ষার প্রতীক হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু এবং এটাই এই বিশেষ মানুষটা আর জনতার মধ্যে গড়ে তুলেছিল এক অবিচ্ছেদ্য সেতুবন্ধান। ...জনতা তাঁকে হৃদয়ে স্থান দিয়েছিল। কারণ তাঁর মধ্যে তারা জাতি হিসেবে নিজেদের পৃথক অস্তিত্ব বজায় রাখার যে গভীর ইচ্ছা তার বহির্প্রকাশ দেখেছিল।’ এভাবেই বঙ্গবন্ধু ও তাঁর আদর্শ শত প্রতিকূলতার মধ্যেও বেঁচে থাকে এবং বাঁচিয়ে রাখে জাতিকে। শেখ মুজিবুর রহমান নিজের ভাবনা সম্পর্কে তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন, ‘ একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালী হিসেবে যা কিছু বাঙালীদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালবাসা, অক্ষয় ভালবাসা, যে ভালবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ বাঙালীদের নিরন্তর ভালবাসার কারণেই বঙ্গবন্ধুর পথচলা হয়ে উঠেছিল কণ্টকময়তায় পরিপূর্ণ, সংগ্রাম ও ত্যাগের মহিমায় উৎকীর্ণ। হুমায়ুন আজাদ মনে করতেন বঙ্গবন্ধু আর সবার মতো রাজনীতি করেননি। তাঁর নীতি জনতার নীতি ছিল। তিনি ‘যুগান্তরের রাজনীতি’ করেছিলেন। তিনি শৈশব- কৈশোর, যৌবন থেকে বেড়ে উঠেছিলেন ইতিহাস বদলে দেয়ার জন্য। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় শেখ মুজিব পরিণত হয়েছেন মহানায়কে। সময় যত এগিয়ে যাবে, বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, ততদিনই শ্রদ্ধার সঙ্গে, হৃদয়ের গহীন থেকে উচ্চারিত হবে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। কোন ষড়যন্ত্রই তাঁর নামকে ম্লান করতে পারবে না। কারণ বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতার বাণী, বঙ্গবন্ধু মানেই শ্যামল, সবুজ বাংলাদেশ।
×