ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

জাকারিয়া স্বপন

লড়াই করেই বাঁচতে হয়

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ১৮ জুলাই ২০১৬

লড়াই করেই বাঁচতে হয়

ধানমণ্ডির একটি ক্যাফেতে আমার এক বন্ধু যুগল কফি খেতে গিয়েছে। ঢাকা শহরে আগে কফি খাওয়ার খুব একটা প্রচলন ছিল না। বাইরে কোথাও বসা যায়, সেই কনসেপ্টটাও বাংলাদেশে গত কয়েক বছরের। এমনকি ঢাকার কর্মজীবী মানুষ সপ্তাহের কর্মদিবসগুলোয়ও অনেক রাতে বাইরে খেতে যায়। সপ্তাহের কর্মদিবসে গভীর রাত পর্যন্ত বাইরে ডিনারে থেকে, পরের দিন তারা কিভাবে অফিস করে সেটা আমার মাথায় ঢোকে না। বাংলাদেশের অফিসগুলো খুব বেশি যে এ্যাফেকটিভ না, তার একটি অন্যতম কারণ হয়ত এই রাতজাগা কালচার। তারা রাত জেগে পার্টি দেবে, আড্ডা দেবে, আত্মীয় কিংবা বন্ধুদের বাসায় গিয়ে হাজির হবে। পরের দিন অফিস, এটা যেন কোন বিষয় নয়। আমি প্রায়ই দেখি, রাত এগারোটা কিংবা আরও পরে কর্মজীবী মানুষ রেস্টুরেন্ট কিংবা কফিশপ থেকে ফেসবুকে চেকইন করছে, ছবি পোস্ট করছে। আমি নিশ্চিত, তাদের কাছে অফিসের কাজটা মোটেও মুখ্য নয়। হয়ত পুরো জাতিটাই এমন। তাই হয়ত আমরা কাজের দিক থেকে, সেবার মানের ব্যাপারে বিশ্বের অনেক দেশ থেকে পিছিয়ে আছি। কারণ আমাদের ভেতর সেই সেন্স অব রেসপনসিবিলিটি তৈরি হয়নি। একদিন কাছের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা তোমরা যে এত রাতে বাইরে খেতে যাও, পরের দিন অফিসের কাজে সমস্যা হয় না? সে উত্তর দিল, ঢাকা শহরে খাওয়া ছাড়া তো আর কিছু করার নেই। মানুষ করবে কী! যেহেতু মানুষের আর কিছু করার নেই, তাই গভীর রাত পর্যন্ত বাইরে খেতে যাওয়ার কালচারটা শুরু হয়েছে এবং সেই সঙ্গে অসংখ্য ক্যাফে তৈরি হয়েছে। এসব ক্যাফে তরুণদের সংখ্যাই বেশি। তাই হওয়ার কথা। এরা নিজের বন্ধুদের বাসায় না এনে, ক্যাফেতে বসে আড্ডা দিতে পছন্দ করে। পরিবারগুলোও ঝামেলামুক্ত থাকে। আমার বন্ধু দম্পতি কফিতে চুমুক দিয়েছে। তারা বসেছে দরজার কাছেই। আমার বন্ধুটি দরজার দিকে মুখ করা আর তার স্ত্রী ক্যাফের ভেতরের দিকে। তিনি দেখতে পেলেন আরও কিছু ছেলেমেয়ে ভেতরে বসে আড্ডা দিচ্ছে। একটা কোনায় ৭-৮ জনের একদল তরুণ-তরুণী। তারা হৈ-হুল্লোড় করছে। দেখে মনে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী হবে। হঠাৎ করেই একজন ক্রেতা ক্যাফেতে প্রবেশ করলেন। সেও বয়সে তরুণ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের মতো। মাথায় টুপি, গায়ে পাজামা-পাঞ্জাবি, পেছনে ব্যাকপ্যাক। (এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ব্যাকপ্যাকের বেশ প্রচলন হয়েছে।) ভেতরে যে ৭-৮ জন তরুণ-তরুণী আড্ডা দিচ্ছিল তাদের একজন পেছন দিয়ে দৌড়ে পালাল। ৪-৫ জন দৌড়ে চলে এলো দরজায়। মুহূর্তের মধ্যে ক্যাফেতে অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ল। আমার বন্ধুর স্ত্রীও বের হয়ে আসতে যাবেন। বন্ধুটি গোঁয়ারের মতো তার স্ত্রীর হাত ধরে বসে থাকল। অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করছে সে। টুপি পরা ছেলেটি হাঁটতে হাঁটতে ভেতরে চলে গেল। কাউকে খুঁজছে সে। কিন্তু অন্য তরুণরা দ্রুত ক্যাফে ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। একজন বিলটা দ্রুত দিতে দিতে আমার বন্ধুর সঙ্গে চোখাচোখি হলো। বলল, জাস্ট স্ক্যায়ার্ড! এই হলো বর্তমানের বাংলাদেশ! জঙ্গীরা কি শুধু এতটুকুই চেয়েছিল? ॥ দুই ॥ সন্ত্রাস ইস্যুতে সরকার বেশ নড়েচড়ে বসেছে। এতদিন বিভিন্ন হত্যাকা- সংঘটিত হওয়ার পর সাধারণ মানুষের মনে এক ধরনের বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল যে, এসব হত্যাকা- বন্ধে সরকারের সদিচ্ছা নেই। কিন্তু এবার সেটা কাটতে শুরু করেছে। সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খুব দ্রুতই অনেক কিছু বের করে ফেলতে পারছে। অনেকগুলো ডট যুক্ত করার প্রয়াসে নেমেছে। জঙ্গীরা কে কোথায় ছিল, এখন কারা কারা মিসিং, তাদের সঙ্গী-সাথী কারা, কোথায় তাদের আস্তানা, টাকা-পয়সা আসছে কোথা থেকে ইত্যাদি বিষয় বের করতে শুরু করেছে এবং ক্ষেত্র বিশেষে সাফল্যও দেখা যাচ্ছে। তবে আমি বিশ্বাস করি, আমাদের এজেন্সিগুলোর আরও ভাল কাজ করার সুযোগ ছিল এবং এখনও আছে। তাদের যে ক্যাপাসিটি তৈরি করার দরকার ছিল, সেটা তৈরি হয়নি। বাংলাদেশের মতো একটি জনবসতিপূর্ণ দেশে মাত্র তিন লক্ষাধিক পুলিশ কাজ করে। অবস্থা এমন যে, ছোট চাদর দিয়ে পুরো শরীর ঢাকার মতো অবস্থা। মাথা ঢাকলে পা বের হয়ে যায়, আবার পা ঢাকতে গেলে মাথা খালি হয়ে যায়। কিন্তু এত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তাদের ওপর আস্থার সঙ্কট আছে। তাই এখনও কাউকে খুঁজে পাওয়া না গেলে প্রথমেই মানুষ মনে করে, সে গুম হয়ে গেছে। জঙ্গী কাজে নিখোঁজ, সেটা এতদিন মনে করত না এবং পুলিশকেও জানাত না। এই আস্থার জায়গাটা ফিরিয়ে না আনতে পারলে, কখনই জনগণকে এই সঙ্কটে পুরোটা পাওয়া যাবে না। আর যাদের পাওয়া যাবে না, তারাই কোন না কোনভাবে সাহায্য করবে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে। তারা কখনই পুলিশের কাছে যাবে না। তারা ভাববে, উল্টো ঝামেলায় পড়ব নাকি! সাধারণ মানুষ বুঝতেই চাইবে না যে, এতে দেশের ক্ষতি ঠেকানো যাবে। তারা নিজেদের জীবনকেই আগে বাঁচাতে চাইবে। তাই পুলিশের প্রথম কাজ হতে পারে তাদের ওপর মানুষের আস্থার সঙ্কটটি যতটা সম্ভব কাটিয়ে ওঠা। আমি বুঝলাম, আমাদের পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দক্ষতা এখনও ততটা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এই কঠিন সময়ে একদল মানুষ প্রমাণ করার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে যে, এই দেশের সকল জঙ্গী কর্মকা-ের সঙ্গে আইএস জড়িত। তারা কি বিষয়টি বুঝে করছেন, নাকি না বুঝে করছেন বুঝতে পারছি না। দেশ এখন একটি সঙ্কটময় মুহূর্ত পার করছে। কারও ভেতর যদি সামান্যতম দেশপ্রেম থাকে তাহলে এই সময়ে দেশের স্বার্থ ছাড়া আর কোন কিছুই ভাবা উচিত নয়। কিন্তু আমরা অনেকেই সেটা করছি না। আমরা কি এর পরবর্তী সংঘাতগুলোর কথা ভেবে দেখেছি? ভাবখানা এমন যে, বাংলাদেশ যদি স্বীকার করে আইএস আছে, তাহলেই যেন সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ব্যাপারটা কি আসলেই তাই? এতে সমস্যার সমাধান হবে না, আরও জটিল হবে। এর মাধ্যমে বিদেশী কিছু এজেন্ট বাংলাদেশের মাটিতে ঢুকে যাবে। এটা কি কেউ বুঝতে পারছে না? নাকি আমরা সেটাই চাইছি? এখন পর্যন্ত যে ক’টি দেশে অন্যরা সাহায্য দানের নামে ঢুকেছে, তার প্রত্যেকটি দেশ এখন রক্তাক্ত। বাংলাদেশেও আইএস আছে এটা প্রমাণ করার জন্য কেউ কেউ মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এই দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের চেষ্টার অন্ত নেই। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান সমস্যা যদি হয় সন্ত্রাসবাদ, তাহলে আমাদের নিজেদের কি করার কিছুই নেই? আমরা কি বাংলাদেশে আফগানিস্তান কিংবা পাকিস্তানের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাই? যারা এই বিষয়গুলো নিয়ে আড্ডায় কথা বলেন, সামাজিক মাধ্যমে যুক্তির জোয়ার তোলেন, তাদের জন্য একটাই সতর্কতাÑ মনে রাখবেন ‘কান্ট্রি ফার্স্ট’। দেশ বাঁচলে সব পাবেন। আর দেশ না বাঁচলে, সব যাবে। হারানো দেশ আর ফেরত পাবেন না। তাই দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষতি হয়, এমন কিছু করা কোন অবস্থাতেই ঠিক হবে না। কখনই না। ॥ তিন ॥ আমেরিকায় সাধারণ মানুষ অস্ত্র রাখতে পারে এবং তার নিজের নিরাপত্তার জন্য সেটা ব্যবহার করতে পারে। আমেরিকার এই অস্ত্র রাখাটা অনেকেই পছন্দ করেন না। কারণ, কিছু পাগল মানুষ সেই অস্ত্র দিয়ে স্কুলের বাচ্চা থেকে শুরু করে ক্লাবের মানুষ পর্যন্ত মেরে ফেলে। এটাই এর নেতিবাচক দিক। কিন্তু এর ইতিবাচক দিকও আছে। প্রথম দিকটি হলো, জাতি হিসেবে মানুষ অনেক সাহসী হয়। তারা অস্ত্র চালাতে পারে এবং এটা তাদের ভেতর এক ধরনের সাহসের সঞ্চার করে। এরা ভয়ে কুঁকড়ে যায় না। দ্বিতীয় দিকটি হলো, ক্ষমতার ভারসাম্যতা। প্রতিটি মানুষ কিন্তু এই গ্রহের প্রাণী। তার স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার আছে। একজনের কাছে অস্ত্র থাকবে, আরেকজনের কাছে থাকবে না- এটা ভারসাম্যহীনতা। বিষয়টা সমানে সমান হতে হবে। ডাকাতের কাছে অস্ত্র থাকলে গৃহস্থের কাছেও থাকতে হবে। নইলে গৃহস্থকে বাঁচাবে কে? রাষ্ট্র তো সবসময় বাঁচাতে পারছে না। আর রাষ্ট্র নিজেই যদি কারও ওপর চেপে বসে? যেভাবে কালো মানুষগুলোকে মেরে ফেলছে পুলিশ। এর প্রতিকার কী? অস্ত্রের মুখে অস্ত্র ছাড়া মৃত্যু অনিবার্য। তৃতীয় উপকার হলো, সন্ত্রাস দমন। সন্ত্রাসীরা যদি জানে আপনার কাছেও একই অস্ত্র থাকতে পারে, সেক্ষেত্রে কেউ আপনার সঙ্গে মাস্তানি করতে আসবে না। এই পৃথিবীতে যদি আবার কখনও বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় (যার সম্ভাবনা একদম উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না), দেখবেন চীন আর আমেরিকার মানুষরা বেশি জয়ী হবে। এরা যুদ্ধটা শিখে ফেলেছে। লড়াই করে কিভাবে বাঁচতে হয়, সেই ট্রেনিংটা হয়ে গেছে। এবারে বাংলাদেশের কথা বলি। গুলশান আর শোলাকিয়ার ঘটনার পর আমরা অনেকেই কুঁকড়ে গেছি। গুলশান-বনানী এলাকায় গেলে এখন মনে হয় ভূতুড়ে এলাকা। দিনের বেলা প্রবেশ করতে কঠিন নিরাপত্তার বেষ্টনী। আর রাতে সেখানকার রাস্তায় লোকজনের কোন দেখা নেই। জমজমাট রেস্তরাঁগুলো ফাঁকা। শুনতে পেলাম, এখন বন্ধুরা আড্ডার জন্য অফিসে ডাকেন, রেস্টুরেন্টে খেতে যান না। আমরা ভয়ে মরে গেছি। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে নানা গুজব। কোথায় কত ঘণ্টার মধ্যে হামলা হবে, এসব ম্যাসেজ মানুষ পেতে শুরু করেছে। পুরো শহরেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন, এভাবে কতদিন? আমরা কি মরার আগেই মরে যাব? এক বন্ধু মজার একটি বিষয় লিখেছে। তার মতে, বাংলাদেশে আপনি কাউকে ভয় দেখাতে চান? কিছু করার দরকার নেই। শুধু তার কানে কানে গিয়ে বলেন, ভাই ভয় পাবেন না। দেখবেন আতঙ্ক কেমনে ছড়ায়। গুলশান, শোলাকিয়া আর ফ্রান্সে হামলার পর আজকে বাংলাদেশজুড়ে সেই ভয়টাই ছড়াচ্ছে। ফেসবুকে, মানুষের কথায় আজ সারাদিন শুনলাম আগামী ৪৮ ঘণ্টায় শপিংমলে যাবেন না। ফেসবুকে এক বন্ধু সকালে এই সতর্কবার্তা দেয়ার পর অতি উৎসাহ নিয়ে আজ সারাদিন বসুন্ধরা সিটিতে কাটালাম। দেখলাম যারা কিছুই না জেনে বসুন্ধরায় এসেছিল এর-ওর কাছ থেকে খবর পেয়ে এখন চলে যাচ্ছে। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে নিরাপত্তা ব্যবস্থার কড়াকড়ি। বসুন্ধরা সিনেমা হলের সামনে গিয়ে দেখা গেল গেটে বসুন্ধরার নিরাপত্তাকর্মীদের পাশে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ। যেন এখনি হামলা হবে। আর তারা সব থামিয়ে দেবে। মূল গেটে যেভাবে তল্লাশি হচ্ছে তাতে আতঙ্ক সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তির বদলে শঙ্কা বাড়ছে। জঙ্গী হামলা প্রতিরোধে নিরাপত্তা ব্যবস্থা অবশ্যই জোরদার করতে হবে। কিন্তু সেটা এমনভাবে করতে হবে যেন মানুষ বুঝতেই না পারে। আর সাধারণ মানুষই পারে অযথা আতঙ্ক ছড়ানোর চেয়ে তুড়ি মেরে সব উড়িয়ে দিতে। কারণ আমরা ভয় না পেলেই ওরা ব্যর্থ। কাজেই চলুন আমরা সতর্ক থাকি। কিন্তু ভয়ের চোটে সব বন্ধ না করে দেই। যারা মানুষ মারছে, নৃশংসতা, বর্বরতা ও বীভৎসতার মাত্রা দিনে দিনে বাড়িয়ে চলেছে তারা তো এটাই চায়। আমরা কি তাদের সফল হতে দেব? সারাবিশ্বে যেভাবে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে এসব নিয়েই আমাদের সামনে জীবনযাপন করতে হবে। ফ্রান্সে এর আগেও দুটি ভয়াবহ হামলা হয়েছে; কিন্তু তা বাস্তিল দিবসের আতশবাজি উৎসবকে বন্ধ করেনি। আমাদেরও তাই ঘরে ঢুকে যাওয়া চলবে না। সতর্ক নিশ্চয়ই আমাদের থাকতে হবে; কিন্তু মরার আগে মরা যাবে না। আর এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলার মুখোমুখি হলে বাঁচার সম্ভাবনা যেহেতু খুবই কম, তাই মরার আগে একটু হলেও লড়াই করে মরা ভাল। ॥ চার ॥ দেশে এবং বিদেশে যখন সন্ত্রাস আর জঙ্গী নিয়ে আমাদের জীবন যায় যায় অবস্থা তার ভেতর একদিন সরকার রামপালে বিদ্যুত কেন্দ্র তৈরি করার চুক্তিটি সম্পন্ন করে ফেলেছে। এ বিষয়ে দেশ দুইভাগে বিভক্ত। গণমাধ্যমগুলো এটা নিয়ে গবেষণাধর্মী রিপোর্ট খুব একটা প্রকাশ করেছে চোখে পড়েনি। মানুষের ভেতর অনেক কনফিউশন রয়েছে। যেমন একজন মানুষের ফেসবুকে একটি মন্তব্য এখানে উল্লেখ করছি। তিনি লিখেছেন, ‘রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য সরকার সুন্দরবনের এক হাজার আটশত চৌত্রিশ (১,৮৩৪) একর জমি অধিগ্রহণ করেছে। আমার প্রশ্ন হলো- বাংলাদেশের অন্য কোথাও কি এ পরিমাণ জায়গা ছিল না? যদি না পেয়ে থাকেন আমার বাড়ি নরসিংদী রায়পুরাতে রয়েছে। মেথিকান্দা রেলস্টশেনের পেছনে কমপক্ষে ৫ হাজার একর জমি পাবেন। একটা পুরাতন এয়ারপোর্টের জন্য এরশাদ জায়গাটা অধিগ্রহণ করেছিলেন। এখন এমনিতেই পড়ে আছে। চলুন না রামপালের পরিবর্তে রায়পুরাতে বিদ্যুত কেন্দ্র করি।’ আরেকজন তার ফেসবুক দেয়ালে লিখেছেন, ‘রামপাল বিদ্যুতপ্রকল্প’ নিয়ে আমার যতটুকু জানা, তাতে এই প্রজেক্ট সুন্দরবনের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। যে ভারতীয় কোম্পানি এই প্রজেক্টে কাজ করবে, সেই ভারতেই এই প্রজেক্ট ছাড়পত্র পাইনি। কারণ তাদের আইন আছে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে এমন প্রজেক্ট করা যাবে না। আমরা সেই প্রজেক্ট ৯-১৩ কিলোমিটার রেডিয়াসে করার অনুমতি দিয়ে দিয়েছি। তবে আমার সবচেয়ে বেশি ভয় লেগেছে, সুন্দরবনের ভেতর নদীর মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত কয়লার স্টিমারের কারণে সুন্দরবনের প্রাণী বৈচিত্র্যের ওপর এর প্রভাব। সন্দেহ নেই, আমাদের দৈনন্দিন জীবন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য বিদ্যুত দরকার। একটু বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করলে সেই বিদ্যুতও পাওয়া সম্ভব, সুন্দরবনকেও রক্ষা করা সম্ভব। সবচেয়ে সহজ বিকল্প প্রজেক্টটিকে রিলোকেট করা। বিজ্ঞজনরা নিশ্চয়ই আরও ভাল বিকল্প বলতে পারবেন।’ এই ছোট্ট দুটি আবেদন অসংখ্য সাধারণ মানুষের মনের কথা বলে যায়। কিন্তু সরকার কেন এটা শুনছে না? বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন তার ফেসবুকে একটি কঠিন স্ট্যাটাস দিয়েছেন। পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে সেটা এখানে উল্লেখ করছি। ‘আনু মোহাম্মদ স্যাররা এখন রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রের বিরোধিতা করছেন। ওনারা এই পর্যন্ত কোন সরকারের কোন উন্নয়ন প্রকল্পটি সমর্থন করেছেন কিংবা সাধুবাদ জানিয়েছেন? আমার জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে আমি এখনও পর্যন্ত খুঁজে পাইনি। আপনারা কেউ জানলে জানাবেন।’ খোকন এর একদিন আগেই লিখেছিলেন, ‘বিদ্যুত কেন্দ্র হচ্ছে রামপালে, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে নাকি সুন্দরবন?’ এই শিরোনামের লেখাটিতে তিনি যা বলেন, তার অংশ বিশেষ তুলে ধরছি। ‘আপনাদের কেন মনে হলো সরকার গবেষণা না করেই রামপালে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করছেন। নাকি সব জ্ঞানের বহর আপনাদের কাছেই আছে? আর সবাই গ-মূর্খ। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দেশপ্রেম নাই আর আপনাদের পেটভর্তি দেশপ্রেমÑ এই যুগে এসে এইটাও ভাবতে হবে? এইটা ভাবার আগে মরণ হওয়া ভাল!’ আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি না কোন্টা সঠিক, কারণ আমি এটা নিয়ে গবেষণা করিনি। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলোÑ সবকিছুতেই আমাদের এত দূরত্ব কেন? রাষ্ট্রের বড় বড় ইস্যুতে আমাদের এমন দূরত্ব কারও জন্যই মঙ্গল নয়। ॥ পাঁচ ॥ গতকাল রাতে ঘুম আসছিল না। ফ্রান্সের আক্রমণের খবরগুলো মনকে অশান্ত করে রেখেছিল। গভীর রাতে খবর পেলাম তুরস্কে সামরিক ক্যু হয়েছে। সবগুলো মিডিয়া কভার করছে। তখন সবেমাত্র ঘটনা শুরু হয়েছে। এই খবরের পর আর ঘুম এলো না। ২০১৬ সালে এসে ক্যু! বর্তমানে এই গ্রহের যে দেশগুলোয় এখনও সামরিক ক্যু হতে পারে কিংবা হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাদের জনগণ যে প্রাচীন যুগে আছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ক্যু হয় যখন রাষ্ট্রের ওপর জনগণের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। জনগণ যদি একটি দেশের মাটির মালিক হয়, বাতাসের মালিক হয়, গাছপালার মালিক হয়, অক্সিজেনের মালিক হয়, সূর্যের আলোর হিস্যার মালিক হয় তাহলে সেই জনগণ সেটাকে রক্ষা করার জন্য জীবন দেবে, যেভাবে সে তার সন্তানদের রক্ষা করতে জীবনকে বাজি রাখতে পারে। আর যারা এটা পারে না তাদের রাষ্ট্রের ওপর কর্তৃত্ব নেই। তারা হলো ওই মাটির অতিথি। অতিথিদের কোন অধিকার থাকে না। সারাদিন পর বোঝা গেল, অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছে। তবে তুরস্কের ব্যর্থ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় পৃথিবীর গণতন্ত্রকামী কোটি কোটি মানুষ চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটিয়েছে। এই যুদ্ধে তুরস্কের জনগণের বিজয় হয়েছে, গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে। পুরো ঘটনা থেকে যদি কিছু বিষয় তুলে আনি তাহলে দাঁড়াচ্ছে এমনÑ ১. প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেছেন যে, সরকার উৎখাতের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, কয়েক শ’ বিদ্রোহীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যদিও কয়েকটি স্থানে এখনও বিদ্রোহীদের সঙ্গে সংঘর্ষ চলছে। কিছু কিছু সামরিক এলাকা বিদ্রোহীদের হাতে। এরদোগান এই ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থ্যানের জন্য তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ফেথুল্লাহ গুলেনকে দায়ী করেছেন, যিনি এখন আমেরিকার পেনসেলভেনিয়ায় নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। ২. অভ্যুত্থানকারীদের অভিযোগ ছিল যে, প্রেসিডেন্ট এরদোগান দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার পরিপন্থী কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ৩. এরদোগান ছুটিতে ছিলেন। সেখান থেকে ইস্তানবুুল ফিরে এসে সরকারকে রক্ষা করার জন্য এরদোগান সর্বসাধারণকে পথে নেমে আসতে বলেন। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। জনগণের চাপের মুখে ইস্তানবুুলে আত্মসমর্পণ করেছে বিদ্রোহী সৈন্যরা। বসফোরাস সেতুতে দেখা গেছে যে, বিদ্রোহীরা সাঁজোয়া যান থেকে নেমে দুহাত উঁচু করে আত্মসমর্পণ করছে। তবে এখনও বিমান, নৌ আর স্পেশাল ফোর্সসহ সেনাবাহিনীর বিশাল অংশ বিদ্রোহীরা নিয়ন্ত্রণ করছে আর আঙ্কারা ও ইস্তানবুুলের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে সরকার। সেনাবাহিনীর বিশাল অংশ এই দুই শহরের বাইরে, যা বিদ্রোহীরা নিয়ন্ত্রণ করছে। ৪. সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল হুলুসি আকারকে (যাকে বিদ্রোহীরা বন্দী করেছিল) উদ্ধার করা হয়েছে। তবে কমপক্ষে ৯০ জন নিহত হয়েছেন। তার মধ্যে অনেকেই বেসামরিক ব্যক্তি। আর আহত হয়েছেন ১,১৫৪ জন। সরকার অনুগত সেনা এবং বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন ১৬ জন। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩,০০০ জনকে আটক করা হয়েছে, যার মধ্যে ২৯ কর্নেল ও ৫ জন জেনারেল আছে। ৫. সেনাবাহিনীর অনেক সদস্যকে জনগণ কর্তৃক প্রকাশ্যে নির্যাতন করতে দেখা যায়। তবে এই সময়টাতে বিশ্বের কিছু মিডিয়া সমালোচনার মুখে পড়ে। তাদের অনেককেই বর্ণচোরা, অসাধু মিডিয়া এবং তথাকথিত ‘লিবারেল ভ-ের মুখোশধারী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বিশেষ করে বিবিসি এবং সিএনএন-এর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে। তারা তুরস্কের জনগণের চরম সঙ্কটের মুহূর্তে গণতন্ত্রের পক্ষে কথা না বলে প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে নিয়ে বিদ্রƒপাত্মক রিপোর্ট প্রচার করেছে। এদিকে প্রেসিডেন্ট ওবামা এবং সেক্রেটারি অব স্টেট জন কেরি গণতন্ত্রকে সমর্থন করে সাধুবাদ পেয়েছেন। এ প্রসঙ্গে অনেকেই বলছেন, বিদ্রোহীদের হাতে যে পরিমাণ মিসাইল আর যুদ্ধবিমান আছে তা মোকাবেলা করার ক্ষমতা এরদোগানের নেই। বিভিন্ন মিডিয়ার মতে, ন্যাটো আর আমেরিকা বলছে বিদ্রোহীদের কাছে ৭৫টা ট্যাক্টিক্যাল নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড রয়েছে। আর ফ্রি এল্যাইড সায়ন্টিস্ট ওয়েব পেজ বলছে এই সংখ্যা ২৫০-৩০০ হতে পারে। এর সঙ্গে রয়েছে কনভেনশনাল ওয়ারহেড। এই বিপুল পরিমাণ অস্ত্র কিভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা হবে সেটা দেখার বিষয়। কিন্তু তারপরেও মানুষ যেভাবে রাস্তায় নেমে এসেছে, তাতে এটা বোঝা গেছে তারা মাঠ ছেড়ে দেয়নি। মাটির অধিকার তাদের চাই-ই চাই। তারা প্রতিষ্ঠা করেছে, লড়াই করেই এই গ্রহে থাকতে হয়। ॥ ছয় ॥ বাংলাদেশেও যদি আমাদের বাঁচতে হয়, তাহলে লড়াই করেই বাঁচতে হবে। গা বাঁচিয়ে আর চলা যাবে না। এটার মুখোমুখি হতেই হবে। হয়ত মানুষের জয় হবে। নইলে জঙ্গীদের। তবে বাঙালীদের লড়াই এবং সেই বিষয়ে কতটা টেক্টিক্যাল সেটা বোঝার জন্য একটি কৌতুকের সাহায্য নেয়া যেতে পারে। একজন ব্রিটিশ, একজন জাপানী এবং একজন বাঙালী একসঙ্গে আমাজনের জঙ্গলে বেড়াতে গেল। তখন হঠাৎ তারা একদল জংলীর হাতে বন্দী হয়। জংলী সর্দার তাদের বলে, তোরা আমাদের এলাকায় অবৈধভাবে এসেছিস, তোদের শাস্তি মৃত্যুদ-। তোদের মেরে, চামড়া ছিলে সেই চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বানাব। তবে তোদের একটা সুযোগ দেয়া হবেÑ কে কিভাবে মরতে চাস সেটা বেছে নেয়ার। ব্রিটিশ ভদ্রলোকটি বলল, আমাকে একটা ছুরি দাও। সে ছুরি পেটে ঢুকিয়ে আত্মহত্যা করল। জাপানী লোকটিও ঠিক একইভাবে সামুরাই দিয়ে আত্মহত্যা করল। কিন্তু বাঙালী চাইল একটা কাঁটা চামচ। তারপর সেটা দিয়ে সারা শরীর খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করতে লাগল। জংলী সর্দার তো অবাক। সে বলল, কিরে তুই মরবি তো মর; কিন্তু এত কষ্ট করছিস কেন? বাঙালীর উত্তর : আমি মরব তো মরব; কিন্তু তোকে ডুগডুগি বানাতে দেব না। লেখক : তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ [email protected]
×