ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সৌদিতে বাংলাদেশের শ্রমবাজার উন্মুক্তের পথ সুগম হলো

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ৮ জুন ২০১৬

সৌদিতে বাংলাদেশের শ্রমবাজার উন্মুক্তের পথ সুগম হলো

তৌহিদুর রহমান ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৌদি সফরের মধ্য দিয়ে সেখানে বাংলাদেশের শ্রমবাজার উন্মুক্ত হওয়ার পথ সুগম হয়েছে। এ সফরের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের প্রভাব বাড়বে। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে বাংলাদেশের প্রতি কোন সৌদি চাপ নেই বলেও প্রমাণিত হয়েছে। সৌদি আরবের নেতৃত্বে সন্ত্রাসবিরোধী জোটে যোগ দেয়ায় দেশটি সন্তোষ প্রকাশ করেছে। এছাড়া দুই দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরালো হয়েছে বলে আশা প্রকাশ করেছেন কূটনীতিকরা। সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদের আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সৌদি আরবে ৫ দিন সফর শেষে মঙ্গলবার ঢাকায় ফিরেছেন। সৌদি আরব সফরকালে বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকে বাংলাদেশের শ্রমবাজার, বিনিয়োগ, সন্ত্রাস প্রতিরোধ ইত্যাদি বিষয় আলোচনা হয়েছে। দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকের মধ্য দিয়ে আরও গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৌদি আরব সফর সামনে রেখে সেদেশে শ্রমবাজার উন্মুক্তের বিষয়ে আলোচনা প্রাধান্য দেয় বাংলাদেশ। কেননা সৌদি আরবে প্রায় ২৫ লাখ বাংলাদেশী কর্মী কাজ করছে। দেশটিতে শ্রমবাজারে আধা দক্ষ ও দক্ষ জনশক্তির চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশ সৌদিতে আরও বেশি হারে জনশক্তি রফতানির মাধ্যমে এই সুযোগকে কাজে লাগাতে চায়। দেশটির শ্রমমন্ত্রী মুফরেজ বিন সাদ আল হাকবানির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বৈঠক হয়েছে। সেই বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে আরও ৫ লাখ জনশক্তি নেয়ার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে সৌদি আরব। এছাড়া বাংলাদেশের কর্মীদের তিনি ব্যাপক প্রশংসাও করেছেন। বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক ছাড়াও চিকিৎসক, শিক্ষক ও প্রকৌশলীদের নেয়ার বিষয়েও আগ্রহ প্রকাশ করেছে দেশটি। সৌদি আরব এখন বাংলাদেশ থেকে নারী কর্মী নিতে আগ্রহী। তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সৌদি কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে, নারীদের পাশাপাশি পুরুষ কর্মীদেরও নিতে হবে। কেননা ইতোমধ্যে বেশকিছু নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ শর্ত দিয়েছে নারীদের সঙ্গে তাদের নিকটাত্মীয় নিতে হবে। বাংলাদেশে শর্তে সাড়া দিয়ে নারীদের পিতা, স্বামী বা ভাইদের নিতে রাজি হয়েছে সৌদি আরব। প্রধানমন্ত্রীর সৌদি আরব সফরের বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ড. ওয়ালিউর রহমান জনকণ্ঠ’কে বলেছেন, শেখ হাসিনার সৌদি আরব সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আরও জোরালো হলো। সৌদি আরব বাংলাদেশের অন্যতম জনশক্তির বাজার। এ সফরের মধ্য দিয়ে জনশক্তি পাঠানোর পথ আরও সুগম হয়েছে বলে তিনি জানান। এছাড়া সৌদি আরব সফরে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের প্রভাব বাড়বে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। সৌদি আরব সফরকালে ৫ জুন সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন শেখ হাসিনা। দুই দেশের শীর্ষ নেতার এই বৈঠকে সৌদিতে বাংলাদেশের শ্রমবাজার, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সন্ত্রাস প্রতিরোধসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। এছাড়া বিশ্বশান্তি ও উন্নয়নের বিষয়েও আলোচনা করেছেন দুই নেতা। এছাড়া ইসলাম ধর্মের নামে বিভিন্ন দেশে দেশে যারা সন্ত্রাসবাদ কায়েম করছে, তাদের প্রতিহত করারও ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সৌদি বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজ। সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যের শীর্ষ প্রভাবশালী দেশ হিসেবে বিবেচিত। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও অর্থনীতির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত সৌদি আরব। তাদের পাশ কাটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কোন দেশ সাধারণত কিছু করতে পারে না। তাই বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদি আরবের গভীর সম্পর্কের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোর ওপরও বাংলাদেশের প্রভাব বাড়বে বলে আশা করছেন কূটনীতিকরা। মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জনকণ্ঠ’কে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সৌদি সফরের সময় দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই কম হলেও সফরের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশি। তিনি জানান, সব সময় চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সইয়ের সংখ্যার ভিত্তিতে সফরের সফলতা নির্ভর করে না। একটি সফর সফলের বিষয়টি অনেক কিছুর পরই নির্ভর করে বলে তার মন্তব্য। সৌদি আরবের নেতৃত্বে আইএসবিরোধী সামরিক জোটের বিষয়ে ইতোমধ্যেই সমর্থন দিয়েছে বাংলাদেশ। আইএসবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রমে বাংলাদেশ ও সৌদি আরব একযোগে কাজ করবে। আইএসবিরোধী জোটে থেকে সন্ত্রাস প্রতিরোধে ইনফরমেশন বিনিময়, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কাজে যুক্ত থাকবে বাংলাদেশ। তবে প্রধানমন্ত্রীর সৌদি আরব সফরের আগ মুহূর্তেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জানান, সৌদি আরবে পবিত্র মসজিদ রক্ষার জন্য অতীতের মতো ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে সৌদি জোটে বাংলাদেশ সৈন্য পাঠাবে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এমন বার্তা দেয়ায় সৌদি আরব বাংলাদেশের প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করেছে। সূত্র জানায়, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকেই বিএনপি-জামায়াতের পক্ষ থেকে অপপ্রচার চালানো হয়, সৌদি আরব এই বিচারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে। এছাড়া দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়েছে বলেও অপপ্রচার চালানো হয়। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৌদি আরব সফরের মধ্য দিয়ে বিএনপি-জামায়াতের সেসব অপপ্রচার এখন মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে। কেননা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সাদরে গ্রহণ করেছে সৌদি আরব। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরব সমর্থন দিয়ে আসছে। পাকিস্তান ও তুরস্ক এই বিচারের বিপক্ষে অবস্থান করলেও সৌদি আরব বরাবরই যুদ্ধাপরাধের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে। এছাড়া সৌদি আরবের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার সৌদি আরব সফরের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে মধ্যপ্রাচ্যের সমর্থন আরও জোরালো হয়েছে। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে বাংলাদেশের প্রতি কোন সৌদি চাপ নেই বলেও প্রমাণিত হয়েছে। গত বছর শেখ হাসিনাকে সৌদি আরব সফরের আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানান সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ। ওই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েই সৌদি আরব সফরে যান প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর সৌদি আরব সফরের মধ্য দিয়ে সেখানকার শ্রমবাজার বাংলাদেশের শ্রমবাজার বাংলাদেশে সৌদি আরবের বিনিয়োগ ও অন্যান্য সহযোগিতাও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। গত কয়েক বছরে ঢাকা ও রিয়াদের সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ ও শক্তিশালী হয়েছে। দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়েও সফর হয়েছে। এবারের সফরের সময়ে দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে নিয়মিত বৈঠক হওয়ার জন্য একটি চুক্তিও সই হয়েছে। চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল বিন আল জুবায়েরের আমন্ত্রণে দেশটি সফর করেন মাহমুদ আলী। সে সময় দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নানা বিষয়ে আলোচনা করেন তারা। সৌদি আরবে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর রিয়াদ সফরের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়। সে অনুযায়ী গত ৩ থেকে ৭ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সৌদি আরব সফর করেন। উল্লেখ্য, সালমান বিন আবদুল আজিজ সৌদি আরবের বাদশা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর এটাই ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম সৌদি আরব সফর। এর আগে ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী সরকার গঠনের পর ওই বছরই এপ্রিল মাসে সৌদি আরবে সরকারী সফর করেন। সে সময় প্রয়াত বাদশা আব্দুল্লাহর সঙ্গে ঐতিহাসিক বৈঠকে মিলিত হন। তারই ধারাবাহিকতায় সৌদি সরকার পরবর্তীতে সেদেশে কর্মরত বাংলাদেশীদের জন্য ইকামা পরিবর্তন ও অবৈধ শ্রমিকদের জন্য সাধারণ ক্ষমার লক্ষ্যে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এবার প্রধানমন্ত্রীর সৌদি আরব সফরকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীসহ উচ্চ পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা প্রতিনিধি দলে ছিলেন। এছাড়া ১০ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দলও প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে সৌদি আরব সফর করেন।
×