ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

দর্শন কেন পড়তে হবে

প্রকাশিত: ০৭:২১, ৩ জুন ২০১৬

দর্শন কেন পড়তে হবে

দর্শন নিয়ে যখন উইল ডুরান্টের ‘দ্য স্টোরি অব ফিলোসফি’, বার্ট্রান্ড রাসেলের ‘হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলোসফি’, ডব্লিউটি স্টেইস-এর ‘এ ক্রিটিক্যাল হিস্ট্রি অব গ্রিক ফিলোসফি’র মতো এ রকম ডজনখানেক অসাধারণ ও সুখপাঠ্য বই পড়ি তখন ভাবি বাংলা ভাষায় এ রকম বই নেই কেনই বা এত কম কেন? দর্শনের ইতিহাসের বেশিরভাগ বইয়েই একটা জিনিস দেখা যায়- সেটা হলো দার্শনিকগণ হঠাৎ করেই আবির্ভূত হন। যেন কোন শূন্যস্থান পেয়ে তারা উড়ে এসে জুড়ে বসলেন। মানুষের ইতিহাসের মতো দর্শনের ইতিহাস এত সরল নয়। আবার দুর্বোধ্যও নয় যেমনটা অনেক ঐতিহাসিক বানিয়ে ফেলেন। বার্ট্রান্ড রাসেলের কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে হবে দার্শনিকগণ একই সঙ্গে কার্যকারণ আবার ইফেক্ট বা ফলাফলও। মানে তারা তাদের সময়ের ঘাত-প্রতিঘাতের ফল আবার যেসব দার্শনিকগণ সৌভাগ্যের বর পেয়ে থাকেন তাদের চিন্তা পরবর্তীতে তাদের দেশ বা সমাজ গ্রহণ করেছে এবং বিশ্বকে উপহার হিসেবেও দিয়েছে। এ জন্য কোন দর্শন ও দার্শনিকের আলোচনা করার সময় তার সময়কাল বা তার সময়ের সঙ্কট, সমাজের ঘাত-প্রতিঘাতের ওপর আলো না ফেললে দর্শন বোঝা যাবে না। আরেকটা কথা, দর্শন শুধু স্কুলে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ারই বিষয় নয় বা অল্প কতক পি তের হাতের মোয়াই নয়। বরং এটা সমাজ ও সম্প্রদায়ের অভিজ্ঞতাও যাপনের অংশ। প্রত্যেকটা সমাজ, দেশ বা সম্প্রদায়ের দর্শন রয়েছে সেটা নিজের হোক বা ধার করা হোক, শক্তিশালী হোক কিংবা দুর্বল হোক। কেউ দর্শন জানুক বা না জানুক দর্শন তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর সেটা যদি জানা যায় তাহলে ভাল নয় কি? কিভাবে পৃথিবী এখানটাতে এসেছে, কিভাবে এখন চলছে, ভবিষ্যতটা কেমন হতে পারে সেটা জানা বা জানার চেষ্টা মহান প্রচেষ্টা নয় কি? দর্শন বা দার্শনিকদের কথা, দর্শনের ইতিহাস পড়ার সময় আমরা এ বিষয়টা খেয়াল রাখব। বাংলা ভাষায় দর্শন নিয়ে এমন কোন বই কি আছে যেটাকে চোখ বুঝে নতুন পাঠকের কাছে ধরিয়ে দিতে পারবেন? দর্শনের ছাত্র ছাড়া অন্যরা খুব সহজে দর্শনের জগতে প্রবেশ করতে পারবে? যদি না থাকে তাহলে দ্রুত একাধিক বই নিয়ে আসা উচিত। পাঠকদের জন্য ইউরোপ আমেরিকাতে প্রত্যেকটা বিষয়ের ওপরই অত্যন্ত সুন্দর আবার জনপ্রিয় বই থাকে। বাংলা ভাষায় এর বহুল প্রচলন জরুরী। দর্শনকে যদি জ্ঞানের মা বলা হয়ে থাকে তাহলে এর ওপর অনেক জোর দেয়া আবশ্যক বৈকি। কারণ মা যেমন সন্তান তেমনই তো হবে। কোন একটা যুগকে বা জাতিকে বুঝতে হলে তাদের দর্শনকে বুঝতে হবে। আর এই দর্শন বোঝার জন্য আমাদের নিজেদেরও কোন না কোনভাবে দার্শনিক হতে হবে বলে মনে করেন বার্ট্রান্ড রাসেল। দর্শনকে আসলে অনেক অনেক প্রশস্ত শামিয়ানা বা সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিতে দেখে থাকে। এক্ষেত্রে আসলে ব্যক্তির অবস্থানই এটা নির্ণয় করে দেয়। মানুষ আসলে ততটুকুই দেখে যতটুকু তার ক্ষমতা আছে বা ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করে। এ জন্য আমরা যখন দর্শন নিয়ে আলোচনা করব তখন এর বিস্তৃত ক্যানভাসটাই মনে রাখব। তাহলে আমাদের ও সমাজের লাভ হবে। দর্শনের মহান শিক্ষক বার্ট্রান্ড রাসেল মনে করেন দর্শনের সীমানাটা ধর্মতত্ত্ব ও বিজ্ঞানের মাঝামাঝি ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’-এ। সব নিশ্চিত জ্ঞান বিজ্ঞানের আওতাভুক্ত। এই নিশ্চিত জ্ঞানের বাইরের যে জগত সেখানটাতে দখলদারিত্ব করে ধর্মতত্ত্ব। এই নিশ্চিত জ্ঞান ও অনিশ্চিত জগতের মাঝামাঝি যে জায়গাটা সেটা দর্শনের ভাগে বরাদ্দ! যে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারে না বিজ্ঞান বা ধর্মতত্ত্বের নিশ্চিত উত্তর মনোপূত হয় না সেগুলো নিয়েই কায়কারবার দর্শনের। দর্শনের কিছু চিরন্তন প্রশ্ন হচ্ছে, ‘আমি কে? এই মহাবিশ্বের কোন উদ্দেশ্য আছে কি? এটা কি কোন নির্দিষ্ট পরিণতির দিকে ধাবিত হচ্ছে? প্রকৃতি জগতের কি কোন নিয়ম আছে? এ নিয়মগুলো কিভাবে গড়ে উঠল? মানুষের জীবনটা কেমন? এটা কি শুধু সুখময় আর ভোগময়? নাকি শুধু কষ্টের? জীবনের ফলাফল বা অর্জন কি একটা বিশাল শূন্য (০)? প্রজ্ঞা বলতে কি কোন জিনিস আছে? নাকি সেটাও আমাদের অজ্ঞতার পরিপূর্ণ বিকাশ? সত্য পথ বলতে কি কোন পথ আছে? নাকি সত্য পথও চিপাগলি হয়ে অন্ধকারেই ধাবিত হয়? এই যে এমনতর বিভিন্ন প্রশ্নগুলো, এগুলোর উত্তর বিজ্ঞানের গবেষণাগারে প্রস্তুত করা যায় না বা বিজ্ঞান পারে না। বিভিন্ন ধর্ম এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সামর্থ্য রাখে বলে দাবি করে। তাদের সেইসব নিশ্চিত উত্তরে আধুনিক মন নিশ্চয়তা পায় না। এ প্রশ্নগুলোকে অধ্যয়ন করা দর্শনের কাজ। দর্শন সব প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর দেয় বলে দাবি করে না বরং এগুলো নিয়ে অধ্যয়ন, অনুধ্যান বা গবেষণা করে যায়। নিশ্চিত উত্তর দেয়া সম্ভবপর হয় না বলে উত্তরের ভিন্নতা একটি স্বাভাবিক ফল। সূত্র : স্ট্যাডি ফোরাম
×