ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

শামীম হাসান

কন্যা বলে কেন অবহেলা

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ৩০ মে ২০১৬

কন্যা বলে কেন অবহেলা

পরিবার পরিকল্পনার কল্যাণে আজকাল শিশু জন্মহার অনেক কম। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারে সাধারণত দুই-তিনটির বেশি সন্তান দেখা যায় না। এরপরও কিছু কিছু পরিবারে দেখা যায় দুই থেকে পাঁচটি কন্যাসন্তান ও একটি পুত্রসন্তান। আসলে ওই পিতা একটি সোনার টুকরা পুত্র সন্তানের আশায় আশায় এতগুলো কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছে। তার মানে চার-পাঁচটি কন্যাসন্তান ফাউ, যা কিনা একটি পুত্র সন্তানের সমতুল্য নয়। আবার কান একটু খাড়া রাখলেই শুনতে পাবেন কোন পিতা বলছে ‘সোনার আংটি বাঁকাও ভাল।’ কেউ হয়তো তার পুত্রসন্তান সম্পর্কে খারাপ কিছু বলেছে তাই তার পুত্র নিয়ে এই দম্ভোক্তি। পরিবারে সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছে, মা বড় মাছের মাথাটি ছেলের পাতে তুলে দিল। ছোট্ট মেয়েটির লোভাতুর চাহনি দেখে মা বকে দিলেন, মেয়েদের এত খাই খাই করতে নেই। পুরুষ মানুষের ভাল-মন্দ খেতে হয়। আর ছেলেটিও নিজেকে পুরুষভেবে নির্বিকার চিত্তে তা খেয়ে ফেলল। ছেলের বাপেরা মাথা উঁচু করে চলে আর মেয়ের বাপদের নাকি মাথা নিচু করে চলতে হয়। উপরের ঘটনাগুলোর সঙ্গে অনেকেই হয়তো দ্বিমত পোষণ করবেন। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। অনেক সহৃদয়বান বাবার কাছে পুত্রসন্তান বা কন্যা সন্তানের কোন ভেদাভেদ নেই। আজকাল দৃষ্টিভঙ্গিরও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তারপরও সার্বিক দৃষ্টিতে কন্যা সন্তানের প্রতি সমাজের অবহেলার চিত্র এটাই। আসলে কন্যা সন্তানের প্রতি অবহেলা শুরু হয় যখন জানতে পারে মায়ের গর্ভের সন্তানটি কন্যা তখন থেকেই। গর্ভে পুত্র সন্তান থাকলে মায়ের কত কদর তা সবাই জানে। আমরা যতই আধুনিকতার কথা বলি না কেন, যতই নারী স্বাধীনতার সাফাই গাই না কেন, সমাজের প্রতিটি স্তরে কন্যাশিশুর প্রতি অবহেলা এবং বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির চিত্র স্পষ্ট। বখাটে কোন ছেলে যদি কোন কিশোরীকে উত্ত্যক্ত করে তার দায়ভারও চাপানোর চেষ্টা চলে ওই কিশোরীর ওপর। ছেলে-মেয়ে দুইজনে কলঙ্ক করলে কলঙ্কিত হয় মেয়েটিই। কারণ ছেলেটি তো সোনার আংটি। একটু বেঁকে গেলে কিংবা ভেঙে গেলেও তো সোনা! ছেলেরা জলচর পাখির মতো, কলঙ্কের পানি সহজে গায়ে লাগে না। এ কথাগুলো ছেলেদের ছোট করার উদ্দেশ্যে নয়। উদ্দেশ্য মেয়েদের প্রতি বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরার জন্য। আমরা কেন ভাবি না আজকের কন্যাশিশুই আগামী দিনের কোন মমতাময়ী মা, প্রেরণদানকারী কোন স্ত্রী। অনেকেই কন্যা সন্তানের প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে পুত্রসন্তানকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে আগ্রহী। প্রয়োজনীয় সকল সুযোগ-সুবিধা তাকে দেয়া হয়। একজন পুত্রসন্তান ভাল হলে তা অবশ্যই গর্বের বিষয়। কিন্তু একটি কন্যাসন্তান ভাল মানুষ হিসেবে গড়ে উঠলে একটি পরিবারই সুন্দর হতে পারে। তাকে ঘিরে পরিবারের প্রতিটি সদস্য ভাল থাকতে পারে। জন্মের পর থেকেই প্রতিকূল পরিবেশে বড় হয়ে যে মেয়ে শিশু বা নারী কোন ছেলে বা পুরুষের সমপর্যায়ে বা তার চেয়েও এগিয়ে যায় তা হলে তো তাকে স্যালুট করা উচিত। কন্যা বলে কেন অবহেলা করব। তারা কি পুত্র সন্তানের চেয়ে কোন অংশে পিছিয়ে আছে। সে কি পরিবার, সমাজ বা দেশের জন্য কিছুই করছে না। বর্তমানে সমাজ-রাষ্ট্র, অফিস-আদালত সর্বত্রই নারীর অংশীদারিত্ব ও অবদান অনস্বীকার্য। আজ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীরা ক্ষমতাসীন। অনেক দেশেরই রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান নারী। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা, উপনেতা, স্পীকার ও প্রধান বিরোধী দলের নেতা নারী। পিতা-মাতার সম্পত্তিতে সকল সন্তানেরই অধিকার আছে। পুত্র নির্দ্বিধায় ও নিঃসঙ্কোচে পিতার সম্পত্তিকে নিজের সম্পত্তি ভাবে। কিন্তু কন্যা তার ন্যায্য হিস্যা চাইলে লোভী হিসেবে বিবেচিত হয়। অথচ আইন ও ইসলাম ধর্মে তাকে সে অধিকার দিয়েছে। অনেকে আবার ভাবে মেয়েকে সম্পত্তি দেয়া মানে পরের ছেলেকে দেয়া। অথচ এটা ভাবে না এই পরের ছেলেটিই তো তার মেয়ের জীবনসঙ্গী, যার সঙ্গে তার সারা জীবনের সুখ-দুঃখ জড়িত। অন্যদিকে যে বাবার শুধুই কন্যাসন্তান, তারা তো অস্বস্তি ও অনিশ্চয়তায় ভুগেন তার মৃত্যুর পর তার কষ্টার্জিত সম্পত্তি কন্যারা পাবে তো? নাকি দূর সম্পর্কের পুরুষ ওয়ারিশদের তোপের মুখে পড়বে। কারণ বাবা মারা গেলে মেয়েদের হক এর উপর তো তাদের ভাগ বসে। মানুষ কষ্টে সম্পত্তি করে পরবর্তী বংশধরদের সুখের জন্য। বলে রাখা ভাল, এই বংশধর বলতে কিন্তু সাধারণত পুত্রসন্তানকে বুঝিয়ে থাকে। মেয়েদের তো বিয়ে দিলেই ঝামেলা শেষ। হ্যাঁ, মেয়েরা তো ঝামেলাই। ছোট বেলায় বাপের ঝামেলা, যৌবনে স্বামীর ঝামেলা আর বৃদ্ধ বয়সে ছেলের ঝামেলা। দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক জনগোষ্ঠী হচ্ছে নারী। তাই দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আজকের কন্যাশিশুকে অবহেলা করার কোন সুযোগ নেই। সন্তান হচ্ছে বাবা-মার শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তা সে ছেলে হোক বা মেয়ে হোক। উভয়কেই একই দৃষ্টিতে দেখতে হবে। সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের অবজ্ঞা, বঞ্চনা ও বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে যেন কন্যারা পিছিয়ে না পড়ে। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে একজন ছেলে যা পারে, একটি মেয়েও তা পারে। বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে শুধু ছেলেরাই পারে না মেয়েরাও পারে। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য পরিবার থেকেই সর্বপ্রথম কন্যাশিশুর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু হয়। দ্বিগি¦জয়ী নেপোলিয়ন বোনাপার্ট তার জনগণের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি উপহার দিব। নেপোলিয়নের এই কথাতেই বুঝা যায় নারীর গুরুত্ব কত। সেই আদিকাল থেকে শুরু করে আজ অবধি কন্যারা নানাভাবে নির্যাতিতা ও নিগৃহীতা। যুগে যুগে নারীদের হেসে খেলে হত্যা করা হতো, তার কোন জবাবদিহি করতে হতো না। জাহিলিয়াতের যুগে কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দিত। সেই অন্ধকার যুগে আলো ছড়িয়ে এলেন মহানবী (স)। তিনি নারীদের বিশেষ করে কন্যা শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করলেন। কন্যাসন্তান বিষয়ে নবী-করিম (স) বলেন, ‘তোমাদের সন্তানদের মধ্যে মেয়েরাই উত্তম।’ ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম যার প্রথম সন্তান মেয়ে।’ ‘কন্যা হলো সুগন্ধি ফুল-আমি তার গন্ধ নিই আর তার রিযিক আল্লাহর হাতে।’ ‘যে ব্যক্তি একটি কন্যা সন্তানের ভরণ-পোষণ করেছে তার বেহেশত নির্ধারিত হয়ে গেছে’ ইত্যাদি। আশার বিষয় রাষ্ট্রও কন্যাসন্তানের অধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছে। কন্যা শিশুদের প্রতি সব ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ দূর করে সমাজ ও রাষ্ট্রে শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সুষ্ঠু বিকাশের লক্ষ্যে প্রতিবছর ৩০ সেপ্টেম্বর পালন করা হয় ‘জাতীয় কন্যাশিশু দিবস।’ আসুন আমরা কন্যাশিশুকে শুধু কন্যা না ভেবে সন্তান ভেবে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলি। আমার-আপনার কন্যাসন্তানই হবে ভবিষ্যতে কোন এক মহীয়সী নারী। যার জ্যোতিতে আলোকিত হবে সমাজ ও রাষ্ট্র।
×