ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আজাদ রহমান

বাংলা ভাষা বাংলা খেয়াল

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বাংলা ভাষা বাংলা খেয়াল

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যার পর আমি ছোটবেলা থেকেই বাবার কোলে বসে সঙ্গীতচর্চা করতাম হিন্দী বন্দেজের নানা রূপ শুনতাম, শিখতাম তখন থেকে তারই ধারাবাহিকতায় বাংলার প্রকৃতির প্রতি, বাংলা ভাষার প্রতি ভিন্ন আকর্ষণ অনুরাগ অনুভব করতাম। পারিবারিক সূত্রে জন্ম থেকেই সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ যেমন ছিল শৈশব থেকেই আত্ম নিবেদিত নিষ্ঠাবান সঙ্গীত শিক্ষকদের কাছে তালিম শুরু করে সঙ্গীতের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষা জীবনে প্রতি পদক্ষেপে হিন্দী বন্দেজের পাশাপাশি বাংলা ভাষায় ধ্রুপদ খেয়ালের বন্দেজের চিন্তা আমার মাথায় ঘুরপাক খেত। কিন্তু বিরোধী মতের সবার সঙ্গে তর্ক-যুক্তিতে কুলিয়ে উঠতে পারতাম না কিন্তু ছাড়তাম না। ক্ষুব্ধ হতাম সেটা হতে পারে আমার বয়স হতে পারে পারিপার্শ্বিকতার কারণে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবন দক্ষতার আলোকে প্রতিপক্ষকে সপক্ষে নিয়ে আসার চেষ্টায় পায়ের নিচে মাটি শক্ত করার সাধনায় প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকতাম। কাঁটাময় পথ চলার রাস্তা পরিষ্কার করে সঙ্গীতের বিধি-বিধানের আলোকে যৌক্তিকতা দিয়ে প্রমাণ হাজির করতাম। দলভারের সংস্কার, অযৌক্তিক চিন্তা, আপন ভাষার প্রতি অবহেলা প্রভৃতি নানা বিষয়ের কারণে বাংলা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কথা তেমনভাবে তখন প্রকাশ করা যেত না। সেই কারণে আমার মনোভাব চেপে রাখতাম সকলের সামনে নিয়ে আসতাম না। যখন বুঝতে পারলাম আর অপেক্ষা করলে সময় পাওয়া যাবে না তাছাড়া ইতোমধ্যেই মাতৃভাষাকে ভালবেসে মানুষ প্রাণ দিতে এগিয়ে আসছে। সেই আপন ভাষার মমতায় ঢাকার রাজপথ রক্তে রাঙ্গা হয়েছে। নিজস্বতাকে রক্ষা করার সঙ্গ্রাম শুরু হয়ে গেছে। জীবন দানের সেই মহান সঙ্গ্রাম ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বহু মানুষের প্রাণ বিসর্জনে মুক্তিযুদ্ধের সফলতায় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলা ভাষা হয় রাষ্ট্রভাষা। তাই ভাষা আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধ, বাংলা ভাষা নিয়ে, কাজ করার বড় সুযোগ করে দিয়েছে। এ সুযোগ প্রাণ পনে আঁকড়ে ধরলাম বুঝতে পারছিলাম এবার সময় এসেছে আমি বাংলা খেয়াল নিয়ে এগিয়ে যেতে পারব তখন থেকেই শুরু হয় বাংলা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, বাঙালীর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের নতুন পথ চলার প্রচেষ্টা। একে একে সঙ্গে এসে মিলতে থাকে অনুরাগী। আমার স্বকণ্ঠে স্বরচিত প্রথম বাংলা খেয়ালের এলপি রেকর্ড প্রকাশিত হয়। অতীতের কোন বাঙালীর বাংলা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পরিপূর্ণ রেকর্ড নেই বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত ব্যক্ত করেন। আমার এ রেকর্ডটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়। এ রেকর্ডটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ভারত বর্ষের বিখ্যাত ধ্রুপদি স্বর্গীয় নিমাই চাঁন বড়াল, সম্মানিত সাংস্কৃতিবিষয়ক লেখক শ্রী শংকর লাল। বাংলাদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তি ড. রফিকুল ইসলাম, নাট্য বিশেষজ্ঞ সাঈদ আহমেদ তারা সকলে রেকর্ডের বিলম্বিত বন্দেজ এবং দ্রুত বন্দেজ রচনা এবং আমার গাওয়ার ভঙ্গি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অলঙ্কার প্রয়োগ ভাষার গুরুত্ব সর্বোপরি সার্বিক উপস্থাপনার ভূয়সী প্রশংসা করেন। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বাংলা খেয়াল নিয়ে এই অসাধারণ কাজের জন্য আমাকে অভিনন্দন জানান। অনুষ্ঠানটিতে সভাপতিত্ব করেন বয়োজ্যেষ্ঠ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মোঃ নাছিরউদ্দিন। তিনিও এই নবতরো সৃষ্টির অকুণ্ঠ প্রশংসা করেন। তারপর থেকে শত বাধার মুখেও আমি চলার গতি কমাইনি, থামাইনি। সঙ্গে সঙ্গে দেশপন্থী, ম্ক্তু-চিন্তাশীল ভাষা অনুরাগী মানুষের সমর্থনও পেয়েছি। দেশ ও দেশের বাইরে যারা উচ্চাঙ্গসঙ্গীতচর্চারত রয়েছেন যারা বাংলার প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করেছেন তাদের সকলকে আমার এই ঘরানার বন্দেজ কণ্ঠে তুলে দিয়ে তার কাঠামো এবং উপস্থাপনা সম্পর্কে সঠিক রূপ অনুধাবন করার বিষয়ে পরামর্শ দানের পর সেটা যথাযথভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করেছি এবং তারই ধারাবাহিকতায় এখনও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে যাচ্ছি। যেমন ভাবে মা তার সন্তানের পরিচর্যা করে আমরাও বাংলা ভাষার নবদিগন্ত বাংলা খেয়াল নিয়ে ব্যস্ত রয়েছি। বিশ্বের সকল ভাষায় রচিত জ্ঞান ভা-ার বাংলাভাষী মানুষের কাছে বাংলায় তুলে ধরার লক্ষ্যে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বাংলা ভাষার আদিরূপ চর্যাগীতির উল্লেখিত সঙ্গীত ধারা রাগসঙ্গীত এবং উচ্চাঙ্গসঙ্গীত বাংলায় রচনা করা, প্রচার করার দায়িত্ব আমরা বিনীতভাবে পালন করছি। আমাদের প্রতিষ্ঠান ‘সংস্কৃতি কেন্দ্র সেন্টার ফর এ্যাডুকেশন, ক্রিয়েটিভ এ্যান্ড পারফর্মিং আর্টস’ এর মাধ্যমে আমরা বাংলা উচ্চাঙ্গসঙ্গীত নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। দেশ ও জাতির প্রতি দায়বদ্ধ এবং নিবেদিত প্রাণ বহু মানুষ আমাদের সঙ্গে একাত্মতা জানাচ্ছেন এটাই আমাদের বড় প্রাপ্তি। আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠান ‘সংস্কৃতি কেন্দ্র’ থেকে নিয়মিতভাবে বাংলা খেয়ালের চর্চার জন্য সচেষ্ট রয়েছি। শুধু আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো ফেব্রুয়ারি মাসেই নয় বছরের ৩৬৫ দিন প্রতি মুহূর্তে এই দায়িত্বপূর্ণ কর্ম নিয়ে আমি ব্যস্ত থাকার বিষয়ে অঙ্গীকারাবদ্ধ। সংস্কৃতি কেন্দ্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে অনেকেই আমার সঙ্গে রয়েছেন তাদের প্রতিও আমার কৃতজ্ঞতা রইল। বাংলা উচ্চাঙ্গসঙ্গীত বাংলা ধ্রুপদ, বাংলা খেয়াল, লঘু উচ্চাঙ্গসঙ্গীত বাংলা টপ্পা, বাংলা ঠুমরী, বাংলা গজল, বাংলা দাদরা, বাংলা কাজরি এবং বাংলা রাগাশ্রিত গান শেখানো হচ্ছে এবং প্রচারে সহযোগিতা করা হচ্ছে। সঙ্গীত অনুরাগী ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গীতের বিষয় শেখা-জানা-বোঝার লক্ষ্যে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ও সঙ্গীতের যথার্থ সমঝদার সৃষ্টির বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান হচ্ছে। সুকণ্ঠের অধিকারী, সঙ্গীত শিক্ষার্থী, নবীন-প্রবীণ শিল্পীদের ধ্রুপদ, খেয়াল প্রভৃতি গান শিখিয়ে তা রপ্ত করার জন্য আমাদের সাধ্য অনুযায়ী সবধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। অনুরাগী নানান বয়সী শিল্পীদের বাংলা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত নিয়মিত অভ্যাসের মাধ্যমে আয়ত্ব করার জন্য যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করানো হচ্ছে। আমি বাংলা উচ্চাঙ্গসঙ্গীত, বাংলা খেয়াল, বাংলা ধ্রুপদ, বাংলা লঘু উচ্চাঙ্গসঙ্গীত- বাংলা টপ্পা, বাংলা ঠুমরী প্রভৃতি গান বানাই একটি পক্রিয়ায়। কোন কোন গান বহু বছর লেগে যায় পরিপূর্ণ রূপ পেতে। বহু বছর আগে হয়ত একটি গান করেছি তা আমি গেয়েছি আমার পরিবারের সদস্য কিংবা ছাত্রছাত্রীদের শিখিয়েছি এবং নিবিড়ভাবে লক্ষ্য রেখেছি পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন, বিয়োজনের মাধ্যমে তা যখন মনে হয়েছে যথার্থ উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের রূপ লাভ করেছে। তখনই শিল্পীদের দিয়ে তা পরিবেশন করানোর ব্যবস্থা নিয়েছি। এক্ষেত্রে শিল্পীকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শিল্পীর দক্ষতা, ব্যক্তিত্ব, বিশেষ রাগের প্রতি আকর্ষণ, কণ্ঠ উপযোগী অলঙ্কারে প্রয়োগ এবং তার সর্বোচ্চ ব্যবহারের দিকে আমার দৃষ্টি থাকে। শিল্পীর পরিবেশনায় শৈল্পিক মান যাতে যথাযথভাবে প্রকাশিত হয় তার জন্য সকল দিক দিয়ে সজাগ থাকার চেষ্টা করি। প্রতি মুহূর্তে আলোচনা বিশ্লেষণের মাধ্যমে তা এগিয়ে যেতে থাকে আবার তাৎক্ষণিকভাবে শিল্পীর আকর্ষণ অনুযায়ী নতুন বন্দেজ বানিয়ে দেয়া হয়। বলা যেতে পারে ব্যক্তির মাপ অনুযায়ী দর্জি যেমন জামা-কাপড় বানায় একইভাবে শিল্পীর সাঙ্গীতিক যোগ্যতার পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটানোর লক্ষ্যে আমি গান বানাই। অবশ্যই রাগ-রাগিণীর বিধি-বিধান মেনেই তা করতে হয়। সেই কারণেই যারা বাংলা খেয়াল চর্চা করছেন তারা সকলেই মঞ্চ, টিভি, বেতারে অংশ নিয়ে সফল হন। সংস্কৃতি কেন্দ্র এর মাধ্যমে ইতোমধ্যেই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কয়েকটি সঙ্গীত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বেতার, টেলিভিশন এবং মঞ্চে যারা আমাদের অনুষ্ঠান দেখেছেন শুনেছেন তারা ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। আমাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত বাংলা খেয়াল অনুরাগী শিল্পীদের নিয়ে বিটিভি, চ্যানেল আই, এটিএন, এনটিভি, বাংলাদেশ বেতার প্রভৃতি প্রচার মাধ্যমে অনুষ্ঠান প্রচার হয়েছে। এ ছাড়াও বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রচার মাধ্যম বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, ডয়েচেভেলে, এনএইচকে প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান থেকে আমার বাংলা খেয়ালের অনুষ্ঠান এবং প্রতিবেদন প্রচারিত হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ১৪০০ সালে শুরুতে শতবর্ষের উল্লেখযোগ্য সঙ্গীতকর্ম আখ্যায়িত করে আমার বাংলা খেয়ালের একক সঙ্গীতসন্ধ্যা অনুষ্ঠান করেছিল। সেজন্য জাতীয় জাদুঘর এর কর্মকর্তাবৃন্দকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। দেশের উচ্চাঙ্গসঙ্গীত অনুরাগী বিশিষ্ট জন এই সঙ্গীতকর্মের প্রশংসা করেছেন। ভারতের শান্তি নিকেতন, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সঙ্গীত একাডেমিতে বাংলা খেয়ালের ওয়ার্কশপ এবং অনুষ্ঠান হয়েছে। একপর্যায়ে ২৯ আগস্ট ২০১২ তারিখে একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর সপ্তাহে ২ দিন শুক্রবার ও শনিবার সকাল ৬.৩০ মিনিট চ্যানেল আই এ বাংলা খেয়ালের অনুষ্ঠান প্রচার করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন এবং সেই অনুযায়ী বাংলা খেয়াল প্রচারিত হয়েছে। ১০ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে চ্যানেল আইয়ের গানে গানে সকাল শুরু অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার জন্য আমাদের সংস্কৃতি কেন্দ্রকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ওই অনুষ্ঠান চলাকালীন অনুষ্ঠানের মাঝে চ্যানেল আই এর বার্তা সম্পাদক শাইখ সিরাজ ঘোষণা করেন ১ ফেব্রুয়ারি বাংলা খেয়াল দিবস পালিত হবে। চ্যানেল আই তা সরাসরি দেশ-বিদেশে প্রচার করবে। সেই অনুযায়ী ১ ফেব্রুয়ারি ‘বাংলা খেয়াল উৎসব ২০১৫’ অনুষ্ঠিত হয়। ৩১ জানুয়ারি ২০১৫ সন্ধ্যা ৬.৩০ মিনিট থেকে ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সকাল ৯টা পর্যন্ত ‘বাংলা খেয়াল উৎসব ২০১৫’ উপলক্ষে প্রায় ১৫ ঘণ্টা চ্যানেল আই এ বাংলা উচ্চাঙ্গ এবং লঘু উচ্চাঙ্গসঙ্গীত প্রচারিত হয়। প্রথমবারের মতো এই ধরনের একটি অনুষ্ঠান প্রচার করে চ্যানেল আই একটি জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছে বলে জ্ঞানী-গুণীরা মন্তব্য করেন। অনুষ্ঠানে এ দেশের ৪০ জন প্রবীণ-নবীন শিল্পীসহ চার শতাধিক শিল্পী বাংলা উচ্চাঙ্গসঙ্গীত পরিবেশন করায় এই অনুষ্ঠান সঙ্গীতের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হয়ে রইল। অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণকারী সকল শিল্পী তাদের উপস্থাপনার জন্য প্রশংসার অধিকারী হয়েছেন। সকলেই আন্তরিকভাবে সচেষ্ট ছিলেন। তাদের সঙ্গীত পরিবেশনের মান উন্নত করার লক্ষ্যে সকলেই একান্তভাবে চেষ্টা করেছেন। প্রয়াত ওস্তাদ ইয়াশিন খানকে ‘বাংলা খেয়াল উৎসব ২০১৫’ আজীবন সম্মামনা দেয়া হয়। যা যথার্থভাবে কাজে লেগেছে কেননা তিনি জীবিত অবস্থায় আমরা তাকে সম্মানিত করতে পেরেছি। বাংলা খেয়াল এবং উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের প্রাসঙ্গিকতায় বলতে চাই, এই মাটিতে জন্মেছিলেন রাগসঙ্গীত এর প্রবাদ ব্যক্তিত্ব ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান। তাঁর সান্নিধ্যে বহু সঙ্গীত শিক্ষার্থী সঙ্গীত সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেছেন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান নিজে যেমন বড় মাপের শিল্পী ছিলেন, শিক্ষাগুরু“হিসেবে অবিভক্ত ভারতবর্ষে বহু শিল্পী তিনি তৈরি করে গেছেন। তাঁর পুত্র ওস্তাদ আলী আকবর খান, কন্যা অন্যপূর্ণা, জামাতা প-িত রবি শংকর এরা সকলেই বিশ্ব বিখ্যাত সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব। তাই এই মাটির সন্তান ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানকে নিয়ে আমরা গর্ব করি। তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে নিয়েও আমরা গর্ব করি। কিন্তু অতি দুঃখের বিষয় এই বরেণ্যশিল্পী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান তাঁর জন্মভূমির এই মাটিকে ভারত বিভাগের আগে বা পরে পূর্ব পাকিস্তান পরবর্তীকালে বাংলাদেশকে কর্মক্ষেত্র হিসেবে গ্রহণ করেননি। তাঁর পুত্র, কন্যা এবং জামাতাও একই পথ অনুসরণ করেন। ওই সময়ের অনেক জ্ঞানী-গুণী উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের দিকপাল জন্মেছেন আমাদের এই ভূ-খ-ে। যেমন ময়মনসিংহ গৌরিপুরের শ্রী বীরেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী যিনি রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়ান মিউজিক পড়াতেন তিনি ছিলেন এই মাটির সন্তান। বেঙ্গল মিউজিক কলেজের অধ্যক্ষ শ্রী ননি গোপাল ব্যানার্জী এই মাটির সন্তান, আমার গুরু“বাঙালী অপ্রতিদ্বন্দ্বী খেয়াল গায়ক সঙ্গীতাচার্য শ্রী তারাপদ চক্রবর্তী তিনি ছিলেন এই মাটির সন্তান। অপ্রতিদ্বন্দ্বী সেতার শিল্পী ওস্তাদ বেলায়েত খান এই মাটির সন্তান। এঁরা সকলেই আমাদের গর্ব। তবে তাঁরা কেউই এদেশকে কর্মস্থানরূপে গ্রহণ করতে পারেননি। এরজন্য আমরাই দায়ী কেননা এদেশের রাগ সঙ্গীত নিয়ে পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় আমরা যেহেতু উচ্চাঙ্গসঙ্গীতকে মর্যাদা দিতে কুণ্ঠিত, সেই কারণেই আমাদের দেশে উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শিল্পীরা টিকতে পারেননি। রুজি রোজগারের অনিশ্চিয়তা। এছাড়া পেশাভিত্তিক কর্মের মর্যাদা না পেলে সে স্থানে ওই পেশার কোন ব্যক্তির থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। রাজা-বাদশা জমিদারদের সময় উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শিল্পীরা গুণাগুণ অনুযায়ী কিছু স্বীকৃতি পেলেও পরবর্তী পর্যায়ে রাজা বাদশাহদের স্থলাভুক্ত নেতানেত্রীদের কাছে বিষয়টি কেন মর্যাদাহীন হয়ে আছে তার যৌক্তিক কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। বুদ্ধিজীবী এবং প্রগতিশীলরাও এ বিষয়ে কার্যকরী ভূমিকা না নিয়ে তারা আমাদের অবাস্তব স্বপ্ন দেখান কিংবা নীরব থাকেন। স্বাভাবিকভাবেই সঙ্গীতের জ্ঞানী-গুণীরা এদেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের বংশের আর একজন গুণী শিল্পী ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খান এমনই অনেক প্রতিকূলতার কারণে এদেশ ছেড়ে কলকাতায় নিজের সঙ্গীতচর্চার স্থান করে নিয়েছিলেন। তিনি ঢাকায় এবং এদেশের উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের জ্ঞানী-গুণীদের কদরহীন অবস্থা এবং পৃষ্ঠপোষকতার অভাব সম্পর্কে প্রায়ই আলাপ করতেন। সেই কারণে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের স্বীকৃতিহীনতার বিষয়টি তখন থেকেই আমি অবগত। আমি তখন ভারতে ‘গোপেশ্বর সঙ্গীত সংসদ’ সঙ্গীত শিক্ষালয়ে অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত ছিলাম। এ ছাড়া কলকাতায় কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শেখাতাম এবং কলকাতায় ‘মিস প্রিয়ংবদা’ ছায়াছবির সঙ্গীত পরিচালনার কাজে নিয়োজিত। ১৯৬৪ সালের দিকে আমি ঢাকায় এসে ছায়ানটে উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শেখাতে শুরু করি এবং সঙ্গীত শিক্ষক, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক, সঙ্গীত প্রযোজক হিসেবে রেডিও পাকিস্তানে যোগদান করি। কিছু দিনের মধ্যেই আমি আর একবার উপলব্ধি করি একান্ত নিষ্ঠা, সাধনা কঠোর পরিশ্রমে রাগসঙ্গীত বিদ্যা আয়ত্বের পর সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের শুধুমাত্র মৌখিক বাহবা নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। তাই আমি নিজের প্রাণের তাগিদে উচ্চাঙ্গসঙ্গীত সাধনা, শিক্ষকতা এবং গবেষণার কাজ চালিয়ে গেলেও রুজি রোজগার-জীবন ধারণের জন্য চলচ্চিত্র সঙ্গীত পরিচালনা, বেতারের চাকরি, বিজ্ঞাপন চিত্র নির্মাণ, চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছি এবং এসব কাজের উপরেই আমাকে নির্ভর করতে হয়েছে। তবে অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও উচ্চাঙ্গসঙ্গীতচর্চা থেকে কখনো দূরে সরে যাইনি। শত ব্যস্ততার মাঝেও বাংলা খেয়াল নিয়ে একান্তভাবে কাজ করেছি। (চলবে)
×