ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রফিকুজ্জামান রণি

সমুদ্রে ডোবা বিসুভিয়াস

প্রকাশিত: ০৪:৪৩, ২২ জানুয়ারি ২০১৬

সমুদ্রে ডোবা বিসুভিয়াস

ইংরেজী সাহিত্যের বিপ্লবী কবি পার্শি বিশি শেলি ছিলেন প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধাচরণকারী, আর স্বাধীনতাকামী মানুষের পক্ষে সরাসরি অবস্থান গ্রহণকারী একজন কলমসৈনিক। মাত্র আট বছর বয়সে ঠবৎংবং ড়হ ধ ঈধঃ রচনার মাধ্যমে তিনি নিজের ব্যক্তিত্ব, স্বকীয়তা ও ব্যতিক্রম প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করতে সক্ষম হন। শেলির ব্যক্তিগত মতাদর্শ ও চিন্তাচেতনার কারণে জীবনের পদে পদে তাকে চরমভাবে মূল্য দিতে হয়েছে। অযৌক্তিক রীতিধারায় গা ভাসিয়ে চলার প্রবণতাকে কখনই তিনি প্রশ্রয় দেননি। প্রেম-প্রকৃতি ও দ্রোহ-উল্লাসে বিশ্বময় দাপিয়ে বেড়ানো কবি পার্শি বিশি শেলিকে দেখার পর ম্যাথু আর্নল্ডের মতো গুণীব্যক্তিরা যদিও ‘দেবশিশু’ শব্দজোড়া উচ্চারণ করছিলেন কিন্তু সুঠাম-সৌম্য দৈহিকগড়নের চিরচঞ্চল এই মানুষটিকে কখনই পুরোদস্তুর শান্ত-স্থির হতে দেখা যায়নি। সারাক্ষণ তার অশান্ত মন লৌকিক ধর্ম-সংস্কৃতির বাহুল্য, সামাজিক অবক্ষয়, ক্ষমতার প্রতি, মৌলিক অধিকার হরণকারীদের বিরুদ্ধে তীব্রভাবে বিদ্রোহ ঘোষণা করত। খুব অল্পবয়সে হাজার রকমের হতাশাঘন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার পরও কবিতার ঝুড়িতে যে স্বপ্ন-আশার নুড়ি তুলেছেন তিনি- তা একেবারেই তুলনারহিত। বাংলাসাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো ইংরেজী সাহিত্যের বহুমুখী কবি পার্শি বিশি শেলিও ছিলেন একজন ধনাঢ্য ঘরের সন্তান, বাবা-মায়ের আদরের পুত্তলি। কিন্তু মহান দুজন কবিকেই ধর্মীয় তলোয়ারের তিক্ষè ফলায় ক্ষতবিক্ষত হতে হয়েছে। মাইকেল ধর্মান্তরিত হয়ে হারিয়েছেন মা-বাবা-পরিবার-পরিজনের স্নেহ-সম্পদ; শেলি ধর্মদ্রোহী হয়ে হারিয়েছেন পারিবারিক আভিজাত্যের গৌরবময় অধ্যায়, আর্থিক সহযোগিতা। কেননা, ১৮১১ সালে ঞযব ঘবপবংংরঃু ড়ভ অঃযবরংস তথা ‘নাস্তিকতার প্রয়োজনীতা’ শিরোনামের একটি পুস্তিকা রচনা করে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে শেলি বহিষ্কৃত হন। বেনামিতে বাজারজাতকৃত ঞযব ঘবপবংংরঃু ড়ভ অঃযবরংস বইখানা চারদিকে তুমুলভাবে আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় তুলেছিল। বইটি প্রকাশের সহযোগী হিসেবে কবির সহপাঠী বন্ধু টমাস জেফারসন হগ-কেও সেদিন বিদ্যানিকেতনের ছাত্রত্ব খোয়াতে হয়েছিল। এখানেই শেষ নয়, একই অভিযোগে পরিবার থেকেও শেলিকে বহিষ্কার করেন তার রক্ষণশীল পিতা। শেলির লাগামহীন ধর্মবিরোধী যুক্তি-বাহাসের খেসারতস্বরূপ তার প্রথম প্রেমিকা হ্যারিয়েট গ্রোভও দুজনের মধ্যেকার সম্পর্ক ছেদের অনাকাক্সিক্ষত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছিলেন। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে শেলি কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন বৈকী; কিন্তু তিনি কি আর দমে থাকার পাত্র? শেলির মতো একজন আশাবাদী কবির এ কথা অবশ্যই জানা ছিল যে, ‘শীতের অভিশাপে মৃত্যুকূপে পতিত হওয়া বৃক্ষের ডালপালাতে ভর করেই ছুটে আসে রং বাহারি ফুলেল বসন্ত।’ তাই ১৮১৭ সালে আরেক কালজয়ী বই ঞযব জবাড়ষঃ ড়ভ ওংষধস রচনার সাহস দেখিয়ে পুনরায় তিনি তুমুলভাবে সমালোচনার মুখোমুখি হন। বিরাগভাজন হন দেশ-বিদেশর নানা-কিসিমের মানুষের কাছে। ক্ষেপাটেপনা এই কবি ক্রমশ মা, বাবা আর ভাইদের চক্ষুশূলে পরিণত হলেও- সবর্দাই তার পাশে বোনদের অবস্থান অত্যন্ত দৃঢ় ছিল। সুযোগ বুঝে বোনদেরও তিনি নাস্তিকতার ছবক দিতে শুরু করলেন এবং বোনের হ্যারিয়েট ওয়েস্টব্রুক নামের এক বান্ধবীকে নাস্তিকদীক্ষা দিতে গিয়ে রাতারাতি প্রেমিকা বানিয়ে ফেললেন। তারপর ১৮১১ সালে লন্ডনে পালিয়ে গিয়ে ‘স্বর্গীয় পুষ্পবন্ধনে’ আবদ্ধ হন তারা। কয়েক বছর অতিক্রম করতে না করতেই ১৮১৪ সালে তাদের স্বল্পায়ু সংসারের অবসান ঘটে যায়। শেলিকে বিশ্বসাহিত্যে আলাদাভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য তার বিখ্যাত ঙফব ঃড় ঃযব ডবংঃ ডরহফ কাব্যখানাই যথেষ্ট। ১৮১৯ সালের শরতে লেখা এই কবিতাটি প্রথমবারের মতো ১৮২০ সালে প্রকাশিত হয় ফ্লোরেন্সে। কবিতাটিতে তিনি সৃষ্টি ও ধ্বংসের দ্বৈতবিহারে অবস্থান নিয়ে পৃথিবীকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। দুই হাত ভরে প্রকৃতির সুষমা-সৌন্দর্য ছেঁকে আনার সময় পশ্চিমের বুনো হাওয়ার মধ্যে শুনতে পেয়েছেন শরতের দীর্ঘশ্বাস। তারুণ্যের জয়গান করতে গিয়ে ঘোষণা করেছেনÑ ‘ঘুমের মরণ নয়; চাই জীবনের জাগরণ।’ এবং নতুন ও পুরাতনের বৈপরীত্য আর যৌবন ও বার্ধক্যের মধ্যে সরাসরি পার্থক্য নির্দেশন করে কবি জানান দিয়েছেন- Thy vice, and sudden grwo grey with fear./And tremble and despil themselves;/Oh, hear!/.../If a were a dead leaf thou mightest bear;/If I were a swift cloud to fly with thee;/A wave to pant beneath thy power, and share. প্রতীক-প্রতিমায় ছাওয়া শেলির ঙফব ঃড় ঃযব ডবংঃ ডরহফ নামের কাব্যের মতো গ্রীক সভ্যতার প্রাচীন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট অবলম্বনে লেখা তার বিশ্বনন্দিত ঙুুসধহফরধং কবিতাটিও বিশ্বময় অমরত্ব দান করেছে তাকে। ঐতিহাসিক ডিডোরাসের বর্ণনারীতির সহযোগিতায় নিয়ে লেখা, মাত্র ১৪ লাইনের সনেটীয় স্টাইলের এই গীতিকবিতায় তিন বর্ণনাকারীর মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে গ্রীক সভ্যতার প্রভাব-প্রতিপত্তিসম্পন্ন ঙুুসধহফরধং নামের নিষ্ঠুরতম এক স্বৈরশাসকের সর্বশেষ পরিণতির রহস্য। মরুভূমির একটি ভগ্নদশা প্রস্তরমূর্তির প্রতীকে তিনি পুরো লৌহ সময়ের হালহকিকতের নান্দনিক-ইঙ্গিত দিয়েছেন। গ্রীক পুরাণে শাসক ওজিমানদিয়াসকে (গ্রীকের দ্বিতীয় রাজা রামসেসকে স্থানীয় ভাষায় ঙুুসধহফরধং হিসেবে ডাকা হতো) মনে করা হতো রাজাদেরও রাজা। তার দুর্দান্ত প্রতাপ-প্রতিপত্তির কাছে সবাই ছিল বীতশ্রদ্ধ। কালের প্রবাহে সেই রাজার রাজাও ক্ষমতা শূন্য হয়ে যায়, তলিয়ে যায় তার ধনভা-ার; নিঃশেষ হয়ে যায় সৈন্যসামন্ত। আলোচ্যমান কবিতায় রাজার গু হধসব রং ঙুুসধহফরধং শরহম ড়ভ করহম/ খড়ড়শ ড়হ সু ড়িৎশং, ুব গরমযঃু ধহফ ফবংঢ়ধরৎ!-এই খেদোক্তি থেকে অনুমান করা যায় তার শেষ পরিণতি কতটা ভয়ঙ্কর হয়েছিল। ‘ওজিমানদিয়াস’ কবিতায় তিনি সেই করুণচিত্র সাজিয়ে রেখেছেন শিল্প-প্রাচুর্যের দেয়ালে- ‘পুরাকীর্তির দেশ হতে আসা এক ভ্রমণকারীর সঙ্গে হয়েছে সাক্ষাত সে আমাকে বলেছে অতিকায় দুটো পাথরের পা শরীরবিহীন দ-ায়মান মরুভূমে, একটু দূরেই বালিতে অর্ধঢাকা মুখম-ল ভ্রুকুটিরত আর কুঞ্চিত ভ্রুযুগল তার দিচ্ছে শীতল নির্দেশ, মনে হয় জীবন্ত যেন, এই ভাস্কর্য বলে দেয় প্রচ- রোষের কথা; এ যাবৎ টিকে আছে খোদাই করা জড়রূপে কৃত্রিম দুটো হাত প্রমাণ দেয় নিষ্ঠুরতার বেদিতে উৎকীর্ণ শিলালিপি সে কথা বলে। ওজিমানদিয়াস মোর নাম, রাজার রাজা তাকাও আমার কর্মের পানে, গর্ব আর হতাশায়, নেই, চারপাশে মোর কেউ নেই, শুধু পড়ে আছে বিশাল মূর্তির ধ্বংসাবশেষ শুধুই একা আর সমান লয়ে বালু উড়ে যায় দূরে। [ওজিমানদিয়াস, অনু. খুররম হোসাইন, জয়নুল আবেদীন] স্বাধীনপিয়াসী কবি পার্শি বিশি শেলির কবিতায় দেখা যায় প্রেম ও দ্রোহের যুগলছাপ। তার প্রেম শুধুমাত্র আত্মিক, সেটাকে কোনভাবেই আর্থিক কিংবা দেহলালিত্যময় প্রেমের অপবাদ দেয়া যায় না। এটাকে চষধষড়হরপ ষড়াব হিসেবেও কেউ কেউ আখ্যায়িত করছেন। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক প্লেটো যদিও তার আদর্শ রাষ্ট্র থেকে কবির মতো ভাবুক ব্যক্তিকে নির্বাসনে পাঠানোর কথা বলেছিলেন; তারপরও শেলি ছিলেন প্লোটোর একজন অনুরাগী পাঠক, অন্ধভক্ত। তিনি প্লোটোর প্রেমদর্শনকে সঙ্গীতের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন- Music is then the knowlede of that which relates to love in harmoû and system. In the very sysyem of harmoû in is easy to distinguish love. দুঃশাসন, কুসংস্কার, লৌকিকতা, অসুরশক্তি এবং শৃঙ্খলিত জীবনের বিরুদ্ধে শেলি ছিলেন সোচ্চার। শেলিকে যেমন দেখা যায় প্রেয়সীর দিকে পূজার্ঘ তুলে দিয়ে ঙহব ড়িৎষফ রং too often profaned শিরোনামের কবিতায় আপোসহীনভাবে বলে ওঠতেÑ‘স্বর্গও প্রেমকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে না।’ তাকেই আবার আইরিশ জনগণের ক্যাথলিক মুক্তি আন্দোলন তুঙ্গে ওঠার কালে আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য আয়ারল্যান্ডে এসে একাত্মতা পোষণ করতে এবং আন্দোলনকে আরও চাঙ্গা করার প্রেরণায় Address to The Irish People নামের প্রচারপত্র রচনা করতে। সম্পর্কবিচ্ছেদ, সমাজচ্যুতি, কাঁধে ঘৃণাসমেত নাস্তিক্যবাদের বোঝা, আপন-পরের বৈরী আচরণ এবং বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচাল যখন বিমর্ষ হয় পড়েছিলেন শেলির তখনই পরিচয় ঘটে তার প্রিয় লেখক ও রাজনৈতিক দার্শনিক উইলিয়াম গডউইনের সঙ্গে। দার্শনিক উইলিয়াম গডউইনের ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘চড়ষরঃরপধষ ঔঁংঃরপব’ গ্রন্থখানা পড়ে ইতোপূর্বে শেলি তার ভক্ত বনে গেছেন। গডউইনের দর্শনতত্ত্বের সঙ্গে তিনি নিজের মতাদর্শের মিল খুঁজে পেলেন। ফলে ধীরেলয়ে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। এই সুবাদে গডউইনের প্রতিভাসিক্ত ও স্বর্ণকুন্তলা কন্যা মেরী ওলস্টন ক্রাফটের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠতা বাড়তে শুরু করে। অতঃপর প্রেম এবং বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন। বিয়ের প্রস্তুতিপর্বে শেলিকে ত্যাগ করে চলে যাওয়া তার সাবেক স্ত্রী হ্যারিয়েট ওয়েস্টব্রুক আত্মহনন করেন। মেরিকে বিয়ের পর প্রাক্তন স্ত্রীর হ্যারিয়েট ওয়েস্টব্রুককের পিতা কর্তৃক আদালতে শেলির বিরুদ্ধে মামলা ঠোকা এবং কন্যাদ্বয়কে আইনী প্রক্রিয়ায় দূরে সরিয়ে রাখার ঘটনায় চরমভাবে মর্মাহত হন তিনি। এ সময় জগৎ খ্যাত কবি ইংরেজী সাহিত্যের রোমান্টিক যুগের দিকপাল জন কীটস্ এবং তৎকালীন প্রভাবশালী পত্রিকা ঞযব ঊীধসরহবৎ-এর সম্পাদক লী হান্টের সঙ্গে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে তার সখ্যভাব। এ সময় শেলি ও কীটস দুই বন্ধুর লেখা ঊীধসরহবৎ পত্রিকার সম্পাদক লী হান্ট প্রকাশনায় এনে চারদিকে ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে জোরালো তৎপরতা চালানো শুরু করে দিলেন। কাকতালীয়ভাবে বিশ্বসাহিত্যের দুই ক্ষণজন্মা কবি পার্শি বিশি শেলি ও জন কীটস্রে মধ্যে দ্রুত বন্ধুত্বভাব গড়ে ওঠে এবং মৃত্যু অবধি সে সম্পর্ক অটুট থাকে। কীট্স যেমন শেলি ও তার লেখার প্রতি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল; তেমনিভাবে ব্যক্তি কীটস্ ও তার নৈরাশ্যবাদী সাহিত্যকর্মগুলোকেও খুব পছন্দ করতেন শেলি। সমালোচকদের কেউ কেউ লিখেছেন, শেলির সলিল সমাধিকালে তার পকেটে কবি জন কীটসের বেশ কিছু কবিতা ছিল। শেলির প্রায় দশ দিনের ডুবন্ত লাশ উদ্ধারকালে সঙ্গে কবিতাগুলোও পাওয়া গিয়েছিল। তবে কীটসকে যে কতটা ভালবাসতেন তিনি তা জীবদ্দশাতেই কবিতার মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন শেলি। যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত মৃত্যুপথযাত্রী কবি জন কীটসকে অনেকবার নিজের এলাকা ছেড়ে শেলির কাছে চলে আসার নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ডাক্তারী পরামর্শও ছিল রোগীকে পারিবারিক পরিবেশের বাইরে গিয়ে অবস্থান করার। কিন্তু মানসিকভাবে বিধ্বস্ত কীটস বন্ধুর সান্নিধ্য নিতে রাজি হননি, ভ্রাম্যমাণ রোগ শরীরে বহন করে বন্ধুকে ঝামেলায় ফেলতে চাননি। শেলি অবশ্যই জানতেন কীটসের মরণব্যামোটা তাকেও আক্রমণ করতে পারে; তারপরও বন্ধুত্বের কাছে সেই রোগ তুচ্ছ জ্ঞান করেছেন তিনি। হয়তোবা জন কীটসও বন্ধুকে যক্ষ্মা-রোগের আক্রমণ থেকে বাঁচানোর জন্য দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করেছেন। রোগটা তো পেয়েছিলেন পারিবারিক সূত্রেই। তাই অন্য কাউকে এই রোগের অংশীদারিত্ব দিয়ে বিপদে ফেলতে চাননি। বন্ধুকে তো নয়-ই। মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়েসে যক্ষ্মা রোগের কাছে পরাহত হয়ে চিরতরে হারিয়ে যাওয়া জন কীটসের মৃত্যুতে শেলি রচনা করেছেন অফড়হধরং শিরোনামের ৫৫ স্তবকের ৪৯৫টি পঙ্ক্তির সুদীর্ঘ শোকগাথা। প্রিয়বন্ধু আর্থারের মৃত্যুতে ইংল্যান্ডের ‘পয়েট লরিয়েট’ খ্যাত ভিক্টোরিয়ান যুগের কবি আলফ্রেড লর্ড টেনিসনের লেখা ‘ইন মেমোরিয়াম’ শোকগাথাটির মতো শেলির অফড়হধরং কাব্যটিও পৃথিবীতে ঐতিহাসিক দলিলের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়ে আছে। কবিতার একাংশে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেছেন- চির অমর কীটসকে কালের ঝাপটা নির্বাপিত করতে পারবে না।’ কীটসের জন্য বিশ্বমাতাকেও ক্রন্দন করার জন্য তিনি আহ্বান জানিয়েছেন কবিতায়।- `Oh, weep for adonis—he is dead!/Wake, melancholy mother, Wake and weep!/Yet wherefore? quench within their bunning bed/ Thy fiery tears, and let thy loud heart keep/ Like.../ He will awake no more, oh, never more!/ Wake thou, cried misery, childless mother rise.../ His head was bound with pansies overblown,/ And faded violets, White, and pied, and blue’ কীটস্রে বিয়োগে যখন কাব্যিকতা মিশিয়ে শেলি উচ্চারণ করেনÑ ঐব রিষষ ধধিশব হড় সড়ৎব, ঙয, হবাবৎ সড়ৎব! তখন পাঠকমহলেরও শোকে মুহ্যমান না হয়ে উপায় থাকে না। ইংরেজী সাহিত্যের দুই কিংবদন্তির বন্ধুত্বের গভীরতাকে মৃত্যু যেন আরও প্রগাঢ় করে দিল, দিল পূর্ণতার ছোঁয়া। মৃত্যুও যেন দুজনের বিচ্ছিন্নতাকে মেনে নিতে পারেনি। তাই কীটসের মৃত্যুর ঠিক এক বছরের ব্যবধানে শেলিও পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। প্রিয়বন্ধু জন কীটস ১৮২১ সালে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার এক বছরের মাথায় স্পেজিয়ার কাসা মগনীতে এক সন্ধ্যাকালীন নৌভ্রমণে ঝড়ের কবলে পড়ে, ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে বন্ধু উইলিয়ামের সঙ্গে বিশ্বসাহিত্যের কালজয়ী এই কবি সমুদ্রে ডুবে মারা যান, মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে। সলিল সমাধির মাধ্যমে অবসান ঘটে বিসুভিয়াসের অগ্নিসঞ্চারি তপ্ত লাভার মতো একটি প্রতিবাদমুখর জীবনের। তবে তার রেখে যাওয়া মলাটবদ্ধ প্রতিবাদ ভাষ্যের আবেদন এখনও ফুরিয়ে যায়নি, হয়তোবা ফুরাবেও না কখনও। কীটস এবং শেলি দুই বন্ধু ঘুমিয়ে আছেন রোমের প্রোটেস্টেট সমাধি ভূমিতে। মৃত্যুর আগে জন কীটস নিজের সমাধি ভূমির জন্য যে এফিটাপ লিখে রেখে গিয়েছিলেন, সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন- ‘এখানে শায়িত আছেন এমন একজন ব্যক্তি যার নাম ছিল জলরেখায় লিখিত।’ [Here lies one whose name was write in water]’— কীটসের ব্যক্তিগত এফিটাপে উল্লিখিত এই বক্তব্যটি প্রিয়বন্ধু পার্শি বিশি শেলির সলিল সমাধির পূর্ব-ইঙ্গিত ছিল কি-না, এমন প্রশ্ন যদি কেউ তোলেন তাহলে- সেটা কি একেবারেই অবান্তর বলে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ আছে? তথ্যঋণ : ০১. নির্বাচিত (ইংরেজী) কবিতা, প্রবন্ধ ও ছোটগল্প-খুররম হোসাইন ০২. নির্বাচিত ইংরেজী কবিতা-জয়নুল আবেদীন ০৩. এগুচ্ছ কবিতা, প্রবন্ধ ও ছোটগল্প- মোহাম্মদ মনজুর রহমান ০৪. বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকী ০৫. ইন্টারনেট
×