ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অঞ্জন আচার্য

আত্মজীবনীতে দাউদ হায়দার

প্রকাশিত: ০৪:৩৭, ২২ জানুয়ারি ২০১৬

আত্মজীবনীতে দাউদ হায়দার

নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দারের বহুল আলোচিত আত্মজীবনীর প্রথম পর্ব ইল্লিন ঝিল্লিন। তার নির্মিত নিজস্ব গদ্যশৈলীতে, স্পষ্ট উচ্চারণে তুলে ধরেছেন তার শৈশব, কৈশোর ও ষাট দশকের উত্তাল রাজনীতির দিনপঞ্জি। একটি কবিতা লেখার দায়ে ১৯৭৪ সালে জেলে যেতে হয় কবি দাউদ হায়দারকে। এ পর্বে থাকছে সেই জেলযাপনের বিচিত্র জীবনকথা। একদিকে পাবনার দোহারপাড়া গ্রামে কবির বেড়ে ওঠার কাহিনী, অন্যদিকে ষাট দশকের শেষ ভাগ থেকে তার কবি ও বহুমাত্রায় প্রেমিক হয়ে ওঠার সত্য গল্পের সঙ্গে লিপিবদ্ধ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের খ- ছবি। বলা যায়, কবি দাউদ হায়দারের প্রথম বাইশ বছরের জীবনচর্চার সঘন শব্দরূপ এই গ্রন্থ। বড় ব্যতিক্রমী এক জীবন দাউদ হায়দারের। দোহারপাড়া-ঢাকা-দোহারপাড়া। ছুটে চলেছেন তিনি। চারটি খ-াংশে রচিত পর্বগুলোর শিরোনাম হলো : দোহারপাড়া, বেচারাম দেউরি, ১৪/২ মালিবাগ, হরিণবাড়ি। জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় পরবাসে। নির্বাসিত জীবনেও ভোলেননি প্রিয় মাতৃভূমিকে। সুদূর জার্মানির বার্লিন থেকে লেখা আত্মজীবনী উৎসর্গ করেছেন বাল্যের প্রিয়, ইছামতি নদীকে। ব্যতিক্রমী দাউদের আত্মজীবনীর নামও ব্যতিক্রম ‘ইল্লিন ঝিল্লিন।’ ’৬৯, ’৭১ আমাদের জীবনের প্রধানতম ঘটনার বয়ান তার রচনায়। স্বল্প দিনে ভেঙ্গে যাওয়া একটি বিয়ের কথাও বলেছেন তিনি। যদিও পাত্রীর নামের ব্যাপারে থেকেছেন নীরব। ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ লিখে তিনি পান খ্যাতি এবং বিড়ম্বনা। জীবনী লেখা সবচেয়ে কঠিন, বঙ্গভূমে। এ স্বীকারোক্তিও দিয়েছেন ইল্লিন ঝিল্লিনের শুরুতেই। দাউদ লিখেছেন, ‘আমার জন্মের সাল-তারিখ নিয়ে মতভেদ আছে। একেকজন আত্মীয় একেক রকম বলেন এবং দাবি করেন তারাই ঠিক। ... জন্মদিন কী জিনিস, দোহারপাড়ায় থাকতে কোনদিন দেখিনি। জনাব মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর জন্মদিনে স্কুল ছুটি থাকত, ওইটুকুই। ... আমার পুরো নাম শেখ আবু দাউদ মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন হায়দার। পাবনা গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউটে (জিসিআই) এই নামই আছে। ঢাকায়, সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুলে ভর্তির সময় ‘আবু দাউদ হায়দার’ রেখে শুরু ও মাঝখানে কেটে দিই। ম্যাট্রিকের ফরম পূরণের সময় ‘আবু; ছাঁটাই। ... জিলাপাড়ার বিশাল দোতলা বাড়ি ছিল আমার প্রিয়। ভূগোলটা এই রকম : পেছনে জিলা স্কুল, সামনে পলিটেকনিক্যাল, ফৌজদারি ও জজকোর্ট, ডিএম অফিস, জেলখানা, বড়ো রাস্তা এবং বীথিদি’র বাড়ি।’ ... দোহারপাড়া থেকে গেলুম ঢাকায়। ১৯৬২ সালে। স্বপন, আমি আর মা।’ শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের মৃত্যুর দিন সম্পর্কে দাউদ হায়দারের বর্ণনা : ‘মা’র জন্য পান কিনতে গিয়েছি। পথে জনতার ঢল। বলাবলি করছে ‘বাংলার বাঘ মারা গেছে। আমি ভাবলুম, গত সপ্তাহে চিড়িয়াখানায় যে বাঘ দেখে এসেছি, হতে পারে সেটা। তার জন্য কেন মানুষের সারি? হয়ত, বাঘটাকে শেষ দেখা দেখতে যাচ্ছে। দোকানি বিষণœ। কে একজন বললে, ‘শেরে কা বাংলা। একদিন ইংরেজকেও কাঁপিয়ে দিয়েছেন। আহা, মারা গেলেন। তা, বয়স হয়েছিল।’ ... জিজ্ঞেস করি, নূরী আপাকে, বাঘ মারা গেছে তো লোক কাঁদছে কেন? কেনই বা লোকে দলে দলে মরা বাঘ দেখতে যাচ্ছে চিড়িয়াখানায়? নূরী আপা : মরা বাঘের জন্য লোকে কাঁদছে? ঠিক দেখেছ? আমি : ওই দেখুন, রাস্তায় গাদাগাদা লোক। সব মরা বাঘ দেখতে যাচ্ছে। বলছে শের কি বাংলা। নূরী আপা হেসে বলেন, উনার নাম আবুল কাশেম ফজলুল হক। লোকে বলে শেরে বাংলা। বাংলার বাঘ। বাঘের মতো তেজি ও সাহসী ছিলেন। পল্টনে বন্ধু ইউসুফের বাড়িতে আড্ডায় এক তরুণীর সঙ্গে দাউদের পরিচয় প্রেম ও বিয়েতে গড়ায়। তার বর্ণনায়, ‘শেলী-আলিয়ারই বান্ধবী, থাক, নামের দরকার নেই এসেছিলেন ওই গুলজারে। এসেছিলেন এক দিনই। ঠিক সেই দিনেই হাজির আমি। ‘দৃষ্টি বিনিময়’ দু’জনের। কথা নয় কোন। গল্প উপন্যাসে বর্ণিত ‘প্রথম দর্শনে প্রেম’ এবং এও কেচ্ছা ‘চোখের চাহনিতে প্রেম।’ ‘ধনী-দরিদ্রের প্রেম’ (বাংলা-হিন্দী ফিল্ম আর কী!)। দু’জনের চোখের ভাষায় মূল ব্যাকরণ কী, সমাস ও তৎসমসহ, পাকা হলো। Ñ হ্যাঁ, ওকে বিয়ে করেছিলুম, গোপনে। কেউ জানে না। আমি তখন ঢাকা কলেজ থেকে পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার অপেক্ষায়। আমার বধূ ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেবেন। স্বামী-স্ত্রী সাতদিনও সাকল্যে কাটাইনি। ... ‘গোপন কথাটি রবে না গোপনে।’ আমার মেজ আপা জ্যোৎস্না, কী করে জানলেন বিয়ে করেছি?’ ‘তিন মাস পরে জেলে গেলুম। জেলে থাকাকালীনই শুনলুম, আমার ঘরনি পর-ঘরনি। কী আর করা। মনের দুঃখে শ্যামল মিত্রের গান গাইলুম ‘যা গেছে তা যাক।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে পড়াকালীনই সংবাদ-এর সাহিত্য সম্পাদক এবং প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ প্রকাশিত। প্রগতি প্রকাশনী থেকে। নবেম্বর ১৯৭৩ সালে। ... কয়েকদিন ধরেই মাথায় একটি লম্বা পদ্য চক্কর দিচ্ছে। দেশের পরিস্থিতিই মুখ্য বিষয়। পুরাণ ধর্ম রাজনীতি ঢুকে পড়ছে। ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নার কালো কন্যায়’ লিখি গোটা রাত জেগে। সংবাদ-এর সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪। এ কবিতার সূত্রেই কারাগারে যেতে হয় দাউদ হায়দারকে। কারাগারে তখনকার গণকণ্ঠ সম্পাদক এবং কবি আল মাহমুদের সঙ্গে মোলাকাত, আলাপের বর্ণনাও দিয়েছেন দাউদ। মুসলিম লীগ নেতা খান-এ-সবুরও তখন ছিলেন কারাগারে। সেখানে জাসদ নেতা আ স ম রব, এমএ জলিল তর্কে লিপ্ত হতেন তার সঙ্গে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরাজয় ঘটত তাদের। দেশান্তরের সেকি হৃদয়ভেদী বর্ণনা করেছেন কবি : ‘সকালে উঠেই হেমার চিৎকার, ‘খোকন ছেলে, খোকন ছেলে।’ কাঁধ থেকে নামে না। মা’র কাছে বসি। মাথায় হাত রাখেন। ঠা-া হাত। মানিব্যাগে কেবল ভারতীয় ষাট পয়সা। প্লেন উড়ল। জানালা দিয়ে দেখি ক্রমেই মিলিয়ে যায় আমার আবাল্য প্রিয় ঢাকা, অসম্ভব ভালোবাসার দেশ।’
×