ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৭ জুলাই ২০২৫, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২

শরীরের ওপর দিয়ে গেছে বিমান, আমি দেখছি আমার ছেলে পুড়ে যাচ্ছে আগুনে: প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা

প্রকাশিত: ১৭:২৪, ২৭ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ১৭:২৬, ২৭ জুলাই ২০২৫

শরীরের ওপর দিয়ে গেছে বিমান, আমি দেখছি আমার ছেলে পুড়ে যাচ্ছে আগুনে:  প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা

ছবি: সংগৃহীত

২১ জুলাই দুপুরে ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ঘটে ভয়াবহ এক দুর্ঘটনা। যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে আছড়ে পড়ে ক্যাম্পাসে। এই মর্মান্তিক ঘটনায় অনেক শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক প্রাণ হারান কিংবা গুরুতর দগ্ধ হন। তবে সৌভাগ্যক্রমে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসে একটি পরিবার—যেখানে মা শিক্ষিকা, ছেলে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী এবং বাবা সন্তানকে আনতে গিয়েছিলেন স্কুলে। সেদিন যমদূতের মুখোমুখি হয়েও অক্ষত থেকে ফিরে আসা এই পরিবারের অভিজ্ঞতা যেন শিউরে ওঠার মতো।

 

 

মুকুল বিশ্বাস ছিলেন স্কুল ভবনের সিঁড়ির সামনে। ছেলে সূর্যকে নিতে এসেছিলেন বাড়ি। হঠাৎ আকাশ থেকে দেখতে পান যুদ্ধবিমানটি ঠিক তার দিকেই ধেয়ে আসছে। মুহূর্তের মধ্যে রক্ষা পেতে তিনি বামে লাফিয়ে পড়েন। তার ডান পাশে, খুব কাছেই, বিমানটি বিকট শব্দে বিধ্বস্ত হয়। সেকেন্ডের ব্যবধানে মৃত্যু এড়িয়ে যান তিনি। ভয়াবহ শব্দে মনে হয়েছিল, শরীরের অর্ধেক নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। পরে উঠে দাঁড়াতে পেরে তিনি দেখতে পান পুরো বিল্ডিং জ্বলছে আগুনে, ভেতরে রয়েছে তার ছেলে সূর্য এবং আরও বহু শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক।

দুর্ঘটনার সময় স্কুল ভবনের দোতলায় ছিল মুকুলের ছেলে সূর্য। স্কুল ছুটির পর তাকে শিক্ষকরা আরও চার শিক্ষার্থীসহ পাশের একটি রুমে ডিটেনশনে রেখেছিলেন। আর তাতেই বেঁচে যায় তাদের প্রাণ। কারণ, যে শ্রেণিকক্ষে সূর্য সাধারণত থাকত, তার অধিকাংশ সহপাঠীই আগুনে পুড়ে প্রাণ হারায়। সূর্য জানান, ডিটেনশন রুমে ঢোকার ঠিক পরেই বিকট শব্দ ও আগুন দেখতে পান তারা। মুহূর্তেই চারপাশ ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। দম বন্ধ হয়ে আসছিল, মনে হচ্ছিল শরীর পুড়ে যাচ্ছে। দেয়ালের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে একটি জানালা দিয়ে নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করেন তারা।

 

 

 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, সূর্য ভবনের কার্নিশে দাঁড়িয়ে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে প্রার্থনা করছেন। নিজে নামার আগে অন্যদের সাহায্য করছেন নিচে নামতে। সূর্য বলেন, তার পাশে থাকা বন্ধু জারিফ ফারহান তখন আগুনে ঝলসে যাচ্ছিল, তার গায়ের কাপড় পর্যন্ত পুড়ে যায়। ধীরে ধীরে সবাইকে গ্রিল ভেঙে বের করে আনা হয়।

ঘটনার সময় সূর্যের মা শারমিন ইসলাম কলেজের ভেতরেই ক্লাস নিচ্ছিলেন। হঠাৎ বিকট শব্দে দিগ্বিদিক ছোটেন তিনি। আগুনে পুড়ে যাওয়া শিক্ষার্থীদের আর্তনাদ ও নিজের সন্তানের কথা ভেবে তিনি ভেঙে পড়েন। শারমিন বলেন, "আমার শুধু মনে হচ্ছিল আমার ছেলেও কি পুড়ে যাচ্ছে? ও যদি আর ফিরে না আসে? আমার কোল খালি হয়ে যাবে।" আজও চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই মুহূর্তগুলো। শিশুদের কান্না, ভয়, পোড়া গন্ধ—সব মিলিয়ে যেন ঘুম কেড়ে নিয়েছে তাদের পরিবারসহ পুরো জাতির।

 

 

মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিতে ক্ষতবিক্ষত যে অসংখ্য পরিবারের হৃদয়, তাদের একজন মুকুল বিশ্বাস ও শারমিন ইসলাম। আর বেঁচে যাওয়া সূর্য—যে সেদিন শুধু নিজের জীবনই নয়, আরও কয়েকটি প্রাণ বাঁচিয়ে দিয়েছে সাহস, ধৈর্য আর মানবিকতার অনন্য নজির হয়ে।

ছামিয়া

×