
অর্থনীতির অন্যতম সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে পানের নাম উল্লেখযোগ্য। পানের চাহিদা দেশ-বিদেশে রয়েছে এবং এটি একটি লাভজনক কৃষিভিত্তিক খাত। সঠিক পরিকল্পনা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে পান চাষ দেশের অর্থনীতিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
পান একটি গুরুত্বপূর্ণ কৃষিজাত পণ্য এবং এটি বাংলাদেশের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। পানের চাহিদা কেবল অভ্যন্তরীণ বাজারেই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও রয়েছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পানের চাহিদা বেশ ভালো।
আমাদের বাঙালিদের চায়ের অভ্যাসের মত পান খাওয়ার অভ্যাস সেই সুদীর্ঘকাল থেকেই। বিয়ে জন্মদিন, মেজবানসহ নানা উৎসবের খাওয়া শেষে পান দিয়ে আপ্যায়ন একটি চিরায়ত ঐতিহ্য। আমাদের গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে একসময় দেখা যেতো মা–খালা, দাদা–দাদি, নানা–নানিদের বিছানার পাশে পান খাওয়ার নানা উপকরণসহ একটি পানের বাটা। সেই পানের বাটার ওপরে রাখা হতো সুপারি কাটার একটা বিশেষ যন্ত্র। চট্টগ্রামের ভাষায় একে ‘ছোরতা’ বলা হয়। বাড়িতে কোনো মেহমান এলে তাকে প্রথমেই পান দিয়ে আপ্যায়ন করার একটি স্বতঃসিদ্ধ রীতি প্রচলিত ছিলো। এখনো গ্রাম বাংলার অনেক মহিলার শাড়ির গোছায় পান বাঁধা থাকে।
সেই সুদীর্ঘকাল থেকেই ভারতবর্ষের রাজা, সম্রাটদের অন্দরমহলেও পান খাওয়ার প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। ইতিহাসের তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায় সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রিয়তমা স্ত্রী নূরজাহানেরও পান খাওয়ার অভ্যাস ছিল এবং তিনি তা অন্দরমহলের অন্যান্যদের নিকট জনপ্রিয় করে তোলেন। এই অন্দরমহলে পান খাওয়ার সংস্কৃতিটা বাঙালিদের জন্য যেন চিরকালীনই হয়ে গেছে।
চট্টগ্রামে মহেশখালীর পান একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বাংলাদেশের এই দ্বীপাঞ্চলের পান স্বাদে অনন্য। মহেশখালীর মিষ্টি পান নিয়ে শিল্পী ও গীতিকার সনজিত আচার্যের জনপ্রিয় আঞ্চলিক একটি গান আছে এবং চট্টগ্রামের মানুষের কাছে তা বেশ সমাদৃত। ‘যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম মইশখাইল্যা পানর খিলি তারে বানাই খাবাইতাম’–অসাধারণ এই জনপ্রিয় গানটি এখনো লোকের মুখে মুখে ফেরে। শুধু চট্টগ্রামের নয়, প্রমিত বাংলা গানেও পানের ব্যবহার হয়েছে চমকপ্রদভাবে। কিংবদন্তি সংগীত শিল্পী রুনা লায়লার কণ্ঠে ‘পান খাইয়া ঠোঁট লাল করিলাম, বন্ধু ভাগ্য হইলো না’ গানটির কথা কে না জানে ? মহেশখালীর মিষ্টি পান মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। অধিকন্তু, এখানকার পানের সুনাম দেশের সীমানা পেরিয়ে এশিয়া মহাদেশ ছাড়াও ইউরোপ–আমেরিকাতেও ছড়িয়ে রয়েছে। কারও কারও মতে আফ্রিকা মহাদেশের কিছু কিছু দেশেও এর সুনাম রয়েছে। পরিসংখ্যানগত তথ্যে জানা যায়, সমগ্র বাংলাদেশের দুই তৃতীয়াংশ মিষ্টি পান মহেশখালী দ্বীপে উৎপাদিত হয়ে থাকে। পান অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি ফসল। সাধারণত বরজ তৈরি করে পানের চাষ করতে হয়।
চট্টগ্রাম ছাড়াও ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও ঢাকায় মহেশখালীর পান সরবরাহ হয়। সৌদিআরব, সিঙ্গাপুর, হংকং, থাইল্যান্ড, আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশেও রফতানি হয় মহেশখালীর মিষ্টি পান। কিন্তু তার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য নয়। পান ক্ষেতকে বলা হয় পানের বরজ। পান চাষের জন্য উপকরণ শন, উল, বাঁশ, কীটনাশক, সার, খৈল ইত্যাদির প্রয়োজন হয়। এসব উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন পান চাষ ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে। অনেক চাষিরা জীবিকার তাগিদে এখনো মহাজনের কাছ থেকে উচ্চ সুদে টাকা ধার নিতে বাধ্য হন। ফলে লাভের বড় অংশটি চলে যায় মহাজনের ঘরে। পান দেশের অন্যতম একটি কৃষিজ উৎপাদশীল খাত। এই পান চাষ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে হয়ে উঠতে পারে দেশের আয়ের অন্যতম উৎস।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি ও হাটহাজারীর পানের কথাও এখানে বলা যায়। মহেশখালীর পান বেশ মিষ্টি। আর ফটিকছড়ি ও হাটহাজারীর পান ঝাল। আকারে কিছুটা বড়। উত্তর চট্টগ্রামসহ বিশেষ করে খাগড়াছড়িসহ তিন পাহাড়ি জেলায় ফটিকছড়ি ও হাটহাজারীর পানের কদর সবচেয়ে বেশি।
পান চাষের প্রধান ঝুঁকি অতি বৃষ্টি। সেপ্টেম্বরের শেষের বর্ষা অর্থাৎ পানচাষ মৌসুমের শুরুতে বর্ষা দেখা দিলে অনেক বরজ নষ্ট হয়ে যায়। বৃষ্টির মাত্রা অধিক হলে চাষিরা লোকসানের মুখে পড়ে। চাষিদের প্রশিক্ষণ, সহজ কিস্তিতে ঋণপ্রদান করলে পানচাষ হবে আরো সমৃদ্ধ এবং চট্টগ্রামের এ অঞ্চল পান উৎপাদনে দেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রেখে রপ্তানিমুখী কৃষি পণ্য হিসাবে অর্থনীতিতেও রাখতে পারে বিশাল অবদান।
Jahan