
ছবি: দৈনিক জনকণ্ঠ
নীলফামারীর ডিমলা উপজেলা পরিষদের নবনির্মিত হলরুমের ছাদ ও দেয়ালে নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার মাত্র দুই বছরের মাথায় ফাটল দেখা দিয়েছে। এতে পাঁচ কোটি ১৫ লাখ ৯ হাজার ৪৭৫ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই ভবনটির গুণগত মান এবং নির্মাণ প্রক্রিয়া নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। স্থানীয়রা বলছেন, এটি কেবল একটি ভবনের সমস্যা নয়, বরং দেশের সরকারি নির্মাণ খাতে চলমান অনিয়ম, দুর্নীতি ও তদারকির অভাবের প্রতিচ্ছবি।
ঝিনাইদহ জেলার আরাবপুরের ‘ইউনিক কন্সট্রাকশন’ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) আওতায় এই হলরুমটি নির্মাণ করে। ২০২১ সালের মার্চে কাজ শুরু হয়ে ২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর এটি জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। গুরুত্বপূর্ণ সভা, সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য এটি ব্যবহৃত হয়ে আসছিল।
তবে, উদ্বোধনের অল্প সময় পরেই, চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে ভবনের বিভিন্ন অংশে ফাটল দেখা দিতে শুরু করে। বর্তমানে ফাটলগুলো আরও বিস্তৃত হয়েছে এবং কিছু জায়গায় পলেস্তারা খসে পড়ছে, যা ভবিষ্যতে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা তৈরি করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নির্মাণ বিশেষজ্ঞের মতে, ভবনটিতে পলেস্তার জন্য যথাযথ অনুপাতে সিমেন্ট, বালু ও পানি ব্যবহার না করায় ফাটল ধরেছে। এছাড়া, নিম্নমানের ও মাটিযুক্ত বালু ব্যবহারের অভিযোগও উঠেছে। ফাটলের আরেকটি বড় কারণ হতে পারে পর্যাপ্ত কিউরিং না করা।
রংয়ের কাজে নিয়োজিত একজন শ্রমিক জানান, "ভালো মানের উপকরণ চাইলে ঠিকাদারের নির্দেশে কমদামী ও নিম্নমানের সামগ্রী দিয়েই কাজ করতে হয়। লাভের আশায় তারা খরচ কমায়।"
এ ধরনের সরকারি প্রকল্পে প্রতিটি ধাপে প্রকৌশলী ও তদারকি কর্মকর্তাদের নিয়মিত পরিদর্শনের কথা থাকলেও ডিমলার হলরুমের ক্ষেত্রে সেই বিষয়টি কার্যকর ছিল কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, তদারকি না থাকায় ঠিকাদার অনায়াসেই নিম্নমানের নির্মাণ কাজ চালিয়ে গেছেন।
এ বিষয়ে ডিমলা উপজেলা প্রকৌশলী শফিউল আলম বলেন, "ফাটল ধরেছে কিনা জানি না। কোথায় ধরেছে তাও আমার জানা নেই। রং ফাটল ঢাকার জন্য করা হয়নি, এটি নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অংশ।"
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইমরানুজ্জামান বলেন, "আমি উপজেলা প্রকৌশলীর কাছে শুনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।"
নীলফামারী এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী ফিরোজ হাসান জানান, "আমি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নই। দ্রুত পরিদর্শন করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"
বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারি নির্মাণে দুর্বল তদারকি এবং ঠিকাদার-প্রকৌশলীর যোগসাজশের কারণেই এমন অনিয়ম ঘটে। পূর্বেও দেখা গেছে—উদ্বোধনের আগেই স্কুল ভবন, সড়ক কিংবা কালভার্টে ফাটল ধরা, যা দুর্নীতির পরিণতি। নকশায় সমস্যা না থাকলে নির্মাণ প্রক্রিয়াতেই ত্রুটি ছিল—এমন অবস্থায় প্রকৌশলীরা দায় এড়াতে পারেন না। অনেক সময় দায় এড়াতে নকশা ত্রুটির অজুহাত দেওয়া হয়, যা সত্যিকারের কারণ থেকে মনোযোগ সরানোর কৌশল।
জনগণের করের টাকায় নির্মিত একটি ভবন যদি মাত্র দুই বছরেই ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়, তাহলে সেটি রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় এবং নাগরিক নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে বিবেচিত হবে। স্থানীয়দের দাবি, এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত। নির্মাণের পুরো প্রক্রিয়া—দরপত্র আহ্বান থেকে কাজ শেষ পর্যন্ত—আলোচনায় এনে দায়ীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন।
ডিমলা উপজেলা পরিষদের এই হলরুমের ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি দেশের বহু সরকারি নির্মাণ প্রকল্পে প্রচলিত অনিয়ম ও দুর্নীতির একটি উদাহরণ। টেকসই অবকাঠামো নিশ্চিত করতে নির্মাণ সামগ্রীর গুণগত মান রক্ষা, কার্যকর তদারকি এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে 'জিরো টলারেন্স' নীতি বাস্তবায়ন অপরিহার্য। অন্যথায় "নবনির্মিত" ভবনগুলোই পরিণত হবে জনগণের অর্থ ও জীবনের হুমকিতে
ফারুক