
ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার সড়কের পাশে তাল গাছ
‘বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই, “কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই,
আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে
তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টির, ঝড়ে।” বাবুই হাসিয়া কহে, “সন্দেহ কি তাই?” রজনীকান্ত সেনের বিখ্যাত কবিতার চিরচেনা বাবুই পাখির স্বাধীনতা আর সুখ দুই-ই আজ হুমকির মুখে। কারণ দিন দিন কমে যাচ্ছে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষাকারী অর্থকরী উদ্ভিদ তাল গাছ। ভোলা কৃষি বিভাগের হিসাবে গত ৫ বছরে ১ লাখ ১৩ হাজার ২২২টি তাল গাছ কমেছে । এতে পরিবেশের যেমন বিরূপ প্রভাব পড়ছে। তাল গাছ কমে যাওয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে শৈল্পিক বাসার কারিগর বাবুই পাখি।
এসব কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে পড়েছে দেশের বৃহত্তম দ্বীপ জেলা ভোলা। এই জেলায় দিন দিন বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে শুধু কোটি কোটি টাকার সম্পদেরই ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে না, প্রতি বছর বহু মানুষ, গবাদিপশুও প্রাণ হারাচ্ছে। এমনকি, নিরাপদ বাসস্থান হারিয়ে বাবুই পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। যার কারণে ভোলায় পরিবেশের বির্পযয় দেখা দিচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ১০ মাসে ভোলায় বজ্রপাতে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাই দুর্যোগ মোকাবিলায় দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী।
তাল গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Borassus flabellifer। বাংলাদেশের পরিবেশ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৃক্ষ। এটি শুধু ফল বা কাঠের জন্য নয়, পুরো গাছটাই মানুষের কাজে লাগে।
তাল গাছের উপকারিতার বিভিন্ন দিক : তাল গাছ খাদ্যসহ বিভিন্নভাবে আমাদের জন্য উপকারী। খাদ্য হিসেবে তাল ফল, তালশাঁস, তালমিছরি, তালের পিঠা, তালের বড়া , তাল গুড়, তালের রস সংগ্রহ করে তা দিয়ে সুস্বাদু গুড় ও গুড়ের মিষ্টান্ন তৈরি হয়। তালের পাতা দিয়ে বানানো তেল কানের ব্যথা ও ত্বকের সমস্যায় ব্যবহার হয় (লোকজ চিকিৎসা)। এছাড়াও তাল গাছের কাঠ অত্যন্ত শক্ত, টেকসই এবং পানি প্রতিরোধী।
তাল গাছ ঘরের খুঁটি, সেতু নির্মাণ ও আসবাবপত্র তৈরিতে ব্যবহার হয়। পরিবেশগতভাবে বজ্রপাত প্রতিরোধে সাহায্য করে (উঁচু হওয়ায় বজ্রপাত শোষণ করে, গ্রামে জীবন বাঁচায়)। মাটির ক্ষয় রোধ করে ও ছায়া দেয়। জলবায়ু সহনশীল অল্প পানি ও উষ্ণ পরিবেশেও বেড়ে ওঠে। বাবুই পাখির বাসা বানানোর জন্য আদর্শ গাছ। গাছে থাকা বিভিন্ন পোকামাকড়, কীট ও পাখির খাদ্য হিসেবে ভূমিকা রাখে। তাল গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকায় ব্যাঙ, কাঁকড়া ও ছোট প্রাণীর বাসস্থান হয়।
তালপাতা দিয়ে হাতপাখা, চাটাই, বই বাঁধাই, পুঁথি লেখার কাজে ব্যবহার হয়। পাতা শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার হয়। এছাড়াও আর্থ-সামাজিকভাবে গ্রামীণ জনগণের জীবিকা নির্বাহে ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে গুড় তৈরি, পাখা বানানোসহ বিভিন্নভাবে অর্থ উপার্জন হয় এই তাল গাছ থেকে। তালপণ্য বিক্রির মাধ্যমে স্থানীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখে।
বাবুই পাখি : নিপুণ শিল্পকর্মে গড়ে তোলে কুঁড়ে ঘর দৃষ্টিনন্দন ঝুলন্ত বাসা তৈরির জন্য বাবুই পাখি বিখ্যাত। নলখাগড়া ও হোগলা পাতা দিয়ে বাবুই বাসা বুনে থাকে। সেই বাসা যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি মজবুত। শক্ত বুননের বাসা সহজে ছেঁড়া যায় না। প্রচ- ঝড়ে ছিঁড়ে পড়ে না। বাবুই পাখিকে অনেকে তাঁতিপাখিও বলেন। এই পাখির বাসা মানুষের মানবিক ও সৌন্দর্যবোধকে জাগ্রত করার পাশাপাশি দেয় স্বাবলম্বী হওয়ার অনুপ্রেরণা। বাসা বানানোর জন্য বাবুই খুব পরিশ্রম করে।
ঠোঁট দিয়ে ঘাসের আস্তরণ ছড়ায়। পেট দিয়ে ঘসে গোল ও মৃসণ করে। শুরুতে দুটি নি¤œমুখী গর্ত থাকে। পরে একদিকে বন্ধ করে ডিম রাখার জায়গা হয়। অন্যদিকে লম্বা করে প্রবেশ ও প্রশস্ত পথ তৈরি করে। কথিত আছে, নাগরিক সুবিধা পেতে রাতে বাসায় আলো জ্বালাবার জন্য বাবুই জোনাকি ধরে এনে গোঁজে। বাবুই সাধারণত গ্রামের নারকেল, খেজুর, রেইনট্রি ও আখ খেতে এবং বিশেষ করে তাল গাছে দলবেঁধে বাসা বোনে।
এরা সাধারণত বিভিন্ন ফসলের বীজ, ধান, পোকা, ঘাস, ছোট উদ্ভিদের পাতা, ফুলের মধু ও রেণু প্রভৃতি খেয়ে জীবনধারণ করে। ভোলার বিভিন্ন গ্রামগঞ্জ, পাড়া-মহল্লায় এক সময় সারি সারি তাল গাছ দেখা যেত। তাল গাছে শোভা পেত বাবুই পাখির ঝুলন্ত বাসা। ঝড়, বৃষ্টি, বাতাসেও ঝুলত সেই দৃষ্টিনন্দন নিখুঁত বাসা। কিন্তু সেই তাল গাছ কমে যাওয়ায় বাবুই পাখিও এখন বিলুপ্তির পথে।
ভোলা সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. কামাল হোসেন জানান, তাল গাছ কমে যাওয়ায় মানুষের পাশাপাশি পাখিকুলের ক্ষতি হচ্ছে। বিশেষ করে তাল গাছ কমে যাওয়ায় বাবুই পাখি কমে যাচ্ছে। এতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে ।
ভোলা কৃষি বিভাগের এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ২০২০ সালে ২৬ হেক্টর জমিতে তালের চারা ছিল ৩ লাখ ১২ হাজার। মাত্র ৫ বছরের ব্যবধানে তাল গাছের সংখ্যা ও আবাদকৃত জমির পরিমাণ ব্যাপকহারে হ্রাস পেয়েছে। চলতি বছরে তাল গাছের আবাদকৃত জমির পরিমাণ ২০ হেক্টরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে এবং তাল গাছের সংখ্যা কমে হয়েছে ১ লাখ ৯৮ হাজার ৭৭৮টি।
গত ৫ বছরে ভোলা জেলায় তাল গাছের সংখ্যা কমেছে ১ লাখ ১৩ হাজার ২২২টি। অপরদিকে গেল ৫ বছরে তালগাছ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে মোট ৮ হেক্টর জমিতে ৭৪ হাজার ৮ শতটি তালের চারা রোপণ করা হয়েছে। কিন্তু তাল গাছের চারা রোপণের তুলনায় কমেছে বেশি।
স্থানীয়রা জানান, ভোলায় প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে একাধিক মৃত্যুর ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। বিশেষ করে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বজ্রপাত থেকে রক্ষাসহ পরিবেশের ভারসাম্য ধরে রাখা মানুষের উপাকারী তাল গাছের সংখ্যা ভোলায় দিন দিন নানা কারণে কমে যাচ্ছে। যার ফলে ভোলায় গত কয়েক বছর ধরে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বজ্রপাতে মানুষের প্রাণহানিসহ কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
বিগত দিনে বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা কম হলেও হঠাৎ করেই তা বেড়ে গেছে। সূত্রগুলো জানান, ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার শশীভূষণ সাব- রেজিস্ট্রার অফিসের দলিল লেখক মোশারেফ হোসেন লিটনের ছিল সাজানো সংসার। গত ৫ নভেম্বর বিকেলে মোশারেফ হোসেন লিটন তার পিতা মোফাজ্জল হোসেন নসু মিলিটারিকে সঙ্গে নিয়ে বসতঘরের পাশে গরুর গোয়াল ঘরের সামনে যান। বিকেল ৩টার দিকে হঠাৎ ঝড়-বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাত শুরু হয়। এ সময় বজ্রপাতে লিটনের মৃত্যু হয়।
প্রায় একই সময় চরফ্যাশনের চর ফকিরা গ্রামের মাইনউদ্দিনের ১৩ বছর বয়সী শিশু শিহাবও মৎস্যঘাটে ঝড়-বৃষ্টির সময় বজ্রপাতে প্রাণ হারায়। একদিনেই প্রাকৃতিক দুর্যোগে হারায় দুটি তাজা প্রাণ। বজ্রপাতে সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও ভোলা পুলিশের খাতায় গেল ৩ বছরে ১০ জনের মৃত্যুর রেকর্ড রয়েছে। এর মধ্যে চলতি বছরের ১০ মাসে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এভাবে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন স্থানীয় সাধারণ মানুষ।
পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলার) নেটওয়ার্ক মেম্বার এস এম বাহাউদ্দিন জানান, তাল গাছ কেটে ফেলার পর নতুন করে তেমন গাছ রোপণ করা হয়নি। যার ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের যে হাওয়া তা এই উপকূলে লেগেছে। এর থেকে পরিত্রানের জন্য গবেষণা ও পরিকল্পনা প্রয়োজন। তা না হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আরও ভয়াবহ আকারে সামনে আসছে।
ভোলা জজ কোর্টের আইনজীবী অ্যাভোকেট মনিরুল ইসলাম জানান, পরিবেশবান্ধব তাল গাছ কর্তন ও গাছের চারা রোপণে কার্যকরী বন আইন প্রণনয় না হওয়ার কারণে পরিবেশের বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি গাছ কর্তন ও গাছ লাগানো বিষয়ে আদালতে একটি রুল জারি করা হয়। কিন্তু তা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। যার কারণে ভোলায় পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। পরিবেশবান্ধব গাছ কর্তন ও গাছের চারা রোপণে কার্যকরী বন আইন প্রণনয়নের দাবি জানান তিনি।
ভোলা সরকারি কলেজের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ফাহমিদা ইসলাম পুষ্প বলেন, শুধু তাল গাছ কেটে ফেলার কারণেই যে ভোলায় তাল গাছ কমে যাচ্ছে তা কিন্তু নয়, জলবায়ুর প্রভাবের কারণেও ভোলায় লবণাক্ততার পরিমাণ মাটিতে বেড়ে যাওয়া ও মাটির উর্বরতা কমে যাওয়ার ফলে দিন দিন তাল গাছ কমে যাচ্ছে। জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য জৈব সারের ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।
ভোলা সরকারি কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. জামাল উদ্দীন জানান, তাল গাছ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে তাল গাছকে কম গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদ মনে করে আগে লাগানো হতো না। যার কারণে তাল গাছ কমে যাচ্ছে। এছাড়াও আগে ঘর তৈরির জন্য তাল গাছ ব্যবহার হতো। অনেক তাল গাছ কাটা হতো।
এই পরিস্থিতি ও অর্থকরী ফসল তালের শাঁসের চাহিদার কারণে লাভজনক হিসেবে প্রচার করা প্রয়োজন। পাশাপাশি কৃষকদের তালের চারা লাগাতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য পরামর্শ দেন তিনি। তিনি আরও বলেন, প্রতি বছর অন্যান্য গাছের সঙ্গে তাল গাছ রোপণ করা হলে পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে বলে তিনি আশা করেন।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. হাসান ওয়ারিসুল কবীর জানান, ইট ভাঁটির জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করায় তাল গাছ কমে যাচ্ছে। কৃষি বিভাগ নিয়মিত তালের চারা রোপণ করে যাচ্ছে। কিন্তু শুধু কৃষি বিভাগই নয়, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাকে তালের চারা রোপণের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং সরকারের একটি প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
ভোলা জেলা প্রশাসক মো. আজাদ জাহান গণমাধ্যমকে জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় এ বছর থেকে ভোলা জেলায় আগামী ৩ বছরের জন্য প্রায় ৩০ হাজার তাল গাছ রোপণের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ৬ হাজার চারা রোপণ করা হয়েছে, যাতে এ জেলায় বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমে যায়।